ঢাকা, শনিবার, ১৩ পৌষ ১৪৩১, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

লাইফস্টাইল

সেই প্রিয়মুখ অগ্নিলা

জয়ন্ত সাহা | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪১৩ ঘণ্টা, আগস্ট ৭, ২০১০

টিফিন পিরিয়ডে সবাই মেতে উঠেছে গোল্লাছুট নয়তো বৌচিতে। ভীষণ পড়ুয়া একটি মেয়ে আর সবার চেয়ে আলাদা হয়ে ঠাই নিয়েছে কাসের কোণে।

দুনিয়ার সব ভুলে ডুব দিয়েছে সত্যজিৎ রায়ের  ‘প্রফেসার শঙ্কু’ বা জুল ভার্নের ‘দ্য মিস্ট্রিরিয়াস আইল্যান্ড’ এ। মোহাম্মদপুরের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার্স গ্রীন হেরাল্ড স্কুলের চুপচাপ ধরনের এই মেয়েটি নিজের ভুবন নিয়েই মেতে থাকে সারাণ। সেদিনের সেই অন্তর্মুখী মেয়েটিই হচ্ছেন প্রিয়াংকা অগ্নিলা ইকবাল।

একুশে টিভির জনপ্রিয় ধারাবাহিক ‘বিপ্রতীপ’র দীপা চরিত্রের অভিনেত্রী সেই মিষ্টি মেয়েটিই হলো অগ্নিলা। তাকে নিয়ে  স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিলেন নির্মাতাদের অনেকেই। হাজারো তরুণের রাতের ঘুম কেড়ে নেওয়া লাস্যময়ী অগ্নিলাকে খ্যাতির মোহ ছুঁতে পারে নি এতটুকু। ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে আলো ছায়ার ভুবন ছেড়ে  সপরিবারে পাড়ি জমান কানাডায়। দীর্ঘ প্রবাস জীবনের পর অগ্নিলা ফিরে এসেছেন প্রিয় মৃত্তিকা, প্রিয়তম স্বদেশের টানে। কিন্তু কী আশ্চর্য! এতটুকু বদলান নি তিনি। আগের সেই লাজুক হাসিটি এখনও অমলিন।   শ্রাবনের এক বিকেলে বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর অগ্নিলার মুখোমুখি হয়েছিল। প্রিয়াংকা অগ্নিলা ইকবাল শুনিয়েছেন তার প্রবাস জীবনের নানা কথা।

ছোটবেলা থেকেই ভীষণ পড়ুয়া অগ্নিলার ছিল চারপাশের সবকিছুতেই ভীষণ আগ্রহ। অনুসন্ধানী চোখে খুঁজে ফিরেন না জানা হাজারো প্রশ্নের উত্তর। চিত্রশিল্পী বাবা সৈয়দ ইকবাল ও মা শাহানা ইকবাল তাদের একমাত্র মেয়ের এই আগ্রহে খুব খুশি। মেয়ের হাতে তার তুলে দিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, হুমায়ুন আহমেদ, জাফর ইকবাল, ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী। মিষ্টি হাসির এই মেয়েটি স্বপ্ন দেখতেন মাদাম কুরী হবেন। কাউকে কিচ্ছু না জানিয়ে নিউমার্কেট থেকে একগাদা টেষ্টটিউব, স্পিরিট এনে পড়ার ঘরটিকে ছোটখাটো একটি ল্যাবরেটরীই বানিয়ে ফেললেন। কিন্তু সে স্বপ্নেও জল ঢেলে দিল একটি দুর্ঘটনা। খুব মনযোগী হয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাতে গিয়ে স্পিরিট ছিটকে এসে লাগল মুখে। এখানেই শখ মিটে গেল ডাক্তার বা  ইঞ্জিনিয়ার হবার। কিন্তু এতটুকুও দমে যান নি তিনি। গৎবাঁধা নোট বইয়ের নোট মুখস্ত না করে নিজের ভাষায় লিখতে পছন্দ করতেন। কাস এইটে পড়ার সময় স্কুলের বার্ষিক পুরস্কার বিতরণের দিন ‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’র পোর্সিয়া চরিত্রে অভিনয় করে সবাইকে চমকে দেন। এরই মধ্যে মা মেয়েকে দেশে ফেলে রেখে কানাডায় উড়াল দিলেন আর্টিষ্ট বাবা সৈয়দ ইকবাল।

অগ্নিলার দীপা হয়ে উঠার গল্পটা খুব মজার। গ্রীন রোডের বাসায় ব্যালকনিতে বিকেল হলেই মেতে উঠতেন প্রিয় কুকুর টমি কে নিয়ে। এই দৃশ্যটি ক্যামেরাবন্দি করলেন পাশের ফ্যাটের এক শখের ফটোগ্রাফার নাসরিন আকতার। তার বন্ধু ছিলেন নাট্যকার ও পরিচালক গিয়াসউদ্দিন সেলিম। টিনএজারদের বয়োসন্ধির নানা সমস্যা নিয়ে লেখা ‘ বিপ্রতীপ’ নাটকটির প্রধান চরিত্র ‘ দীপা’র জন্য তখন তিনি নতুন মুখ খোঁজ করছিলেন। নাসরিন আকতারের তোলা ছবি দেখে অগ্নিলাকেই মনে ধরল পরিচালকের। এক নাটকে অভিনয় করেই প্রিয়মুখ হয়ে উঠলেন ছোটপর্দার।

অভিনয়ের সেই অভিজ্ঞতার স্মৃতিচারণ করে অগ্নিলা বলেন, প্রথম ক্যামেরা সামনে দাঁড়াতেই পা ঠক ঠক করে কাঁপতে শুরু করেছিল আমার। সেলিম আংকেল আমাকে নিয়ে অনেক কষ্ট করেছেন। একটা শট পাঁচবার দিতে হয়েছে। পরে অবশ্য ধীরে ধীরে আমার ক্যামেরা-ভীতি ঠিক হয়ে যায়। অগ্নিলা জানালেন, অভিনয় জীবনের প্রথম দিকে পেয়েছেন বিপাশা হায়াত, চিত্রলেখা গুহদের মত বড় মাপের মানুষদে ¯েœহ। চিত্রলেখা গুহ বাসা থেকে খাবার এনে নিজের হাতে খাইয়ে দিতেন তাকে। স্যারদের ভয় ছিল ‘মেয়েটা অভিনয়ে নেমেছে পড়াশোনার না জানি কী হাল হয় ’ এই ধারণাকে মিথ্যে প্রমাণের দায় ছিল তার। এখানেও বাঁচিয়ে তাকে বাঁচিয়ে দিয়ে ছিলেন গিয়াসউদ্দিন সেলিম। ছুটির দিনগুলোতেই অগ্নিলাকে নিয়ে  শুটিং করেছিলেন তিনি। সাত পর্বের ধারাবাহিক নাটক ‘বিপ্রতীপ’-এ সবাইকে ছাড়িয়ে আলোচনার কেন্দ্রে উঠে আসেন অগ্নিলা। তারপর অভিনয় করেছেন গিয়াসউদ্দিন সেলিমের ‘স্বপ্ন শকট’ নাটকেও। কয়েকটি বিজ্ঞাপন চিত্রে কাজ করেছিলেন তিনি। সেগুলো হল হাবিব ফ্যান , কোকাকোলা. মরটিন ও পেপসোডেন্ট টুথপেষ্ট।

২০০২ সালে বাবা রতাদের সপরিবারে কানাডায় নিয়ে যান। সেখানে অগ্নিলা ভর্তি হলেন ইষ্টার্ন স্কুল অব কমার্সে। মেধার স্বার রাখলেন অগ্নিলা কানাডাতেও । কানাডার হায়ার স্কুল ডিগ্রী ওএসডিডি’তে ভাল  রেজাল্টের জন্য ‘কুইন এলিজাবেথ এইম ফর দ্য টপ স্কলারশিপ’ এবং কানাডা সরকার থেকে ‘অন্টারিও স্কলার অ্যাওয়াডর্’  অর্জন করেন। এবার বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির পালা। ২০০৬ সালে ভর্তি হলেন বিশ্বের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অব টরেন্টো আন্তজার্তিক উন্নয়ন বিভাগে।

 এই বিভাগের বাংলাদেশবিদ্বেষী মি. রিচার্ডসের ধারণা পাল্টে দেয়ার গল্পটি গর্বে বুক ভরিয়ে দেবে যেকোন বাঙালির। প্রথম কাসটিতেই অগ্নিলাদের শর্ট স্টোরি লিখতে দেয়া হয়েছিল। মনের মাধুরী মিশিয়ে অগ্নিলা লিখলেন সদ্যই হায়ার স্কুল পাশ করা এক বাঙালি ছেলের ছন্নছাড়া জীবনের গল্প। রিচার্ডস ভাবতেন বাঙালি ছেলেমেয়েদের নকল করার প্রবণতা মারাত্মক। কিন্তু অগ্নিলার খাতাপত্র ঘেঁটে তার ধারণা ভুল প্রমানিত হল । মজার ব্যাপার হচ্ছে, একসময়ের এই বাঙালি বিদ্বেষী এই শিকটি এখন বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক অবস্থান নিয়ে ভীষন উৎসাহী। তিনি মধ্যপ্রাচ্যের শরনার্থীদের উপর গবেষনার জন্য অগ্নিলাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন লেবাননের বৈরুতে। কিন্তু টিভিতে ইসরায়েলী হামলার ভয়াবহতা দেখে আদুরে মেয়েকে মৃত্যুর দুয়ারে ঠেলে দিতে চাইলেন না বাবা মা। বছর দুই না যেতেই অগ্নিলা উৎসুক হয়ে উঠলেন দণি এশিয়ার আর্থ সামাজিক অবস্থান নিয়ে। ভর্তি হলেন রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগে। এখানে তিনি সান্নিধ্য পেয়েছেন জেন্স হ্যানসেন, নোয়া শেইনলিঙ্গারের মত শিকদের। এখানে তিনি ব্যবচ্ছেদ করেছেন প্লেটো, অ্যারিষ্টটল, রুশো, চে গুয়েভারাদের জীবনদর্শণ। আর মাত্র দুই সেমিষ্টার পরই গ্রাজুয়েশন শেষ করে অগ্নিলাকে ছুটতে হবে দণি এশিয়ার আনাচকানচে। খুঁজতে হবে তাকে এ অঞ্চলের সামাজিক বৈষম্যের কারণ।

এক মাসের ছুটিতে দেশে ফিরেছেন অগ্নিলা। অনেক নির্মাতাই তার কাছে ছুটে গেছেন অভিনয়ের প্রস্তাব নিয়ে। কিন্তু কাউকে এখন পর্যন্ত চুড়ান্ত কথা দেননি। ঠিক করেছেন, খুব ভালো কাজ হলে হয়তো করবেন নয়তো না। প্রায় ৮ বছর পর দেশে ফিরে এসে কোন পরিবর্তন ই না কি চোখে পড়েনি তার। ‘ঢাকা শহর আগের মতই আছে। আগের চেয়ে মানুষ জনের সংখ্যা বেড়েছে’, বললেন অগ্নিলা।

কানাডার প্রবাসী জীবনেও অগ্নিলা পড়াশোনার পাশাপাশি সংস্কৃতি চর্চায় জড়িত আছেন। আসছে সেপ্টেম্বরে তার অভিষেক হতে চলেছে মঞ্চনাটকে। নীলিমা ইব্রাহীমের ‘আমি বীরাঙ্গনা’ অবলম্বনে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটকের প্রধান চরিত্র শেফালী চরিত্রে অভিনয় করছেন অগ্নিলা। এটি নির্দেশনা দিয়েছেন  শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর পুত্রবধূ মঞ্জুলী কাজী। তার নির্দেশনায় এ নাটকটিতে উঠে আসবে মুক্তিযুদ্ধে তিন নারীর আত্মত্যাগের গল্প। দেশে অভিনয় করার অভিজ্ঞতাকে এ নাটকে ঝালিয়ে নিচ্ছেন তিনি। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে নাটকটি মঞ্চস্থ হবে কানাডার মন্ট্রিলে। ভবিষ্যতে দেশে স্থায়ীভাবে দেশে ফিরে আসার পর মিডিয়ায় নিয়মিত কাজ করার কথা ভাববেন বলে জানালেন। তবে অভিনয় বা মিডিয়ার কাজকে প্রফেশন হিসেবে নেয়ার তার একদম ইচ্ছে নেই।
 
বাংলাদেশ সময় ১৫৩০, আগস্ট ৭, ২০১০।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।