ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

লাইফস্টাইল

গোপন সত্য

রওশন জাহান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩০২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৩
গোপন সত্য

ব্যাংক থেকে বেরিয়েই বুকে একটা ধাক্কা লাগে রেবুতির। তমাল দাঁড়িয়ে আছে।

ঢিলে ময়লা জিন্সের প্যান্ট, খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর দু আঙুলের ফাঁকে আধ খাওয়া সিগারেট । গায়ের রঙ একটু ফর্সা হওয়া ছাড়া কোন পরিবর্তন নেই। প্রথমে নিজেকে আড়াল করতে চাইলেও অতিরিক্ত ভয় পেলে মানুষ যেমন হঠাৎ সাহসী হয়ে উঠে তেমনি রেবুতি সরাসরি তমালের দিকে তাকিয়ে রইল। তমাল! ব্যাংকের দেয়ালে হেলান দিয়ে আজ দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটি তার কি না হতে পারত! এই দিনটিকে এত বছর এড়িয়ে চলার চেষ্টা বৃথা গেল রেবুতির। শেষ পর্যন্ত দেখা হয়েই গেল দুজনের।  

গোছানো, মেধাবী ছেলে বলে খ্যাতি ছিল তমালের। রেবুতির খুব কাছের আত্মীয় সে। কিশোরী বয়স পেরিয়ে ভুল করার বয়সে একদিন তমাল বলেছিল তুই জানিস, রেবুতি একটি তারার নাম? সেই তারাটিকে খুব কাছে রেখে আমার সারাজীবন দেখার সাধ হয়রে!

এরপর নৌবাহিনীর ক্যাডেট হয়ে প্রশিক্ষণের জন্য পতেঙ্গা চলে যায় সে লম্বা সময়ের জন্য। সেখান থেকে নিয়মিত চিঠি লিখত তমাল। এত আবেগ মাখা, সুন্দর চিঠি বুঝি পৃথিবীতে কোন প্রেমিক তার প্রিয়ার জন্য লেখেনি। অন্তত রেবুতির তাই ধারণা। নিজ হাতে বানানো নীল খাম, সবুজ খাম আর কখনো বা হলুদ, সাথে থাকত ক্যাম্পের বাগান থেকে চুরি করা গোলাপের পাপড়ি।  

এই চিঠিগুলো পরবর্তীতে স্মৃতির গ্লানি হয়ে রইল তাদের জীবনে। মনিহারের মত ছিঁড়তে গেলে বাজে পড়তে গেলে লাগে। প্রায়ই সে ভাবে ভালবাসার যত সুখ, সীমাহীন যত দুঃখ সে পেয়েছে সে অংশটুকু বাদ দিলে তার জীবনের বেঁচে থাকাই বৃথা।  

রেবুতির ব্যাকুল চাহনী দেখে তমাল তার দিকে তাকাল। কিন্তু কই চোখ ভরা আবেগ নিয়ে কাছে এসে বললনা তো, রাগ করেছিস তারা? ছিঃ। এমন অবুঝ হলে কি চলে? মুনিয়ার কথাটা ভাবতো একবার। আমি পাশে না দাঁড়ালে ওইটুকু শিশু কই ভেসে যেত বল। আমি জানতাম তুই বুঝবি। দাদা যদি হঠাৎ এভাবে চলে না যেত...। এতগুলো বছর বুকের ভেতর পুষে রাখা রেবুতির কষ্টরা ডানা মেলত সেই মুহূর্তে ।

তাদের বিয়ের কয়েকদিন আগে তমালের বড়ভাই নয় মাসের মেয়ে আর অল্পবয়সী স্ত্রী রেখে মারা যায় হঠাৎ। তারপর মুরুব্বীরা তমালের সাথে তার ভাবীর বিয়ে ঠিক করে শিশু মেয়েটির ভবিষ্যৎ ভেবে। কর্তব্যের কাছে ভালবাসা বিসর্জন দিতেই হল। এরপর থেকে সচেতন ভাবেই তারা একে অপরকে এড়িয়ে চলেছে। এত বছর পর আজ দেখা হয়ে গেল। কিন্তু এরকমই কি হবার কথা ছিল দিনটি! এমন বিবর্ণ! ভালবাসার এতটুকু ছোঁয়া কি থাকতে পারতনা! তমাল অথবা তমালের মত দেখতে ছেলেটার অচেনা চাহনি দেখে রেবুতি হতবিহ্বল হয়ে এক ছুটে রাস্তা পার হতে গিয়ে গাড়ি চাপা পড়ল।

আইসিইউ-এর বেডে জীবন মৃত্যুর মাঝে থাকা মেয়েটির মাথায় হাত রাখল কেউ । চোখের জল আজ আর গোপন করার চেষ্টা নেই। নয় বছর বড় দীর্ঘ সময়। মানুষ সব শোক সামলে উঠতে পারে এই লম্বা সময়ে। কিন্তু তমাল হয়তো পারেনি। ডাক্তারদের নিষেধ অগ্রাহ্য করে ব্যাকুল ভাবে কাঁদছে সে। কর্তব্যের সাথে ঘর করলেও ভালবাসার মানুষটিকে অনুভব করে সে প্রতি মুহূর্তে। খুব সংগোপনে বিশ্বাস করে তমাল, এই জীবনে মুনিয়ার ভবিষ্যৎ ভেবে সে যে বিসর্জন দিল, তার পূন্যে পরের জীবনে রেবুতিকে সে পাবে।   

কিন্তু হাসপাতালে বিছানায় অচেতন রেবুতি জানতেও পারলনা এই গোপন সত্যটি।               

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।