ঢাকা, মঙ্গলবার, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

লাইফস্টাইল

ঈদে নিঝুম দ্বীপ

মাহবুব আলম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭২২ ঘণ্টা, নভেম্বর ১, ২০১১
ঈদে নিঝুম দ্বীপ

নিঝুম দ্বীপ! সে এক অজানা মায়াবী রহস্যের দ্বীপ। ধীরে ধীরে অবগুষ্ঠন খুলে উন্মোচন করছে নিজেকে।

দূর সমুদ্র থেকে হাতছানি দেয় সে। চপলা লাস্যময়ীর মতো ইশারায় কাছে ডাকে যেন।

সমুদ্রের ডাক শুনতে সবাই ছুটে যায় কক্সবাজার। বাংলাদেশে সমুদ্রসৈকত বলতে আমরা বুঝি কক্সবাজার-টেকনাফ কিংবা কুয়াকাটা। অথচ নিঝুম দ্বীপের বিস্তীর্ণ সমুদ্র ও তার মায়াবী হাতছানি এখনও অনেককে হাতছানি দিয়ে ডাকে।

অনেকদিন থেকেই যাব যাব করেও যাওয়া হয় না। একদিন কয়েক বন্ধু মিলে চললাম সেই বিখ্যাত দ্বীপে।

এই দ্বীপটিকে অদ্ভুত এক মায়াবী নির্জনতা ঘিরে রেখেছে । সৈকতে দাঁডালে গভীর সমুদ্র থেকে তরঙ্গে ভেসে আসে সমুদ্রের আহ্বান। হৃদয়ে বেজে ওঠে অপূর্ব সুরের মূর্ছনা।

পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি নিঝুম দ্বীপে জনবসতি শুরু হয়। মূলত হাতিয়ার জাহাজমারা ইউনিয়ন হতে কিছু জেলে পরিবার প্রথম নিঝুম দ্বীপে আসে।

নিঝুম দ্বীপ সংলগ্ন এলাকায় প্রচুর ইচা মাছ (চিংড়ি) ধরা পড়ত বলে জেলেরা এই দ্বীপের নাম দেয় ইছামতির দ্বীপ। এ দ্বীপের মাটি চিকচিকে বালুকাময়, তাই জেলেরা নাম দিলেন বইল্যারচর বা বালুর চর। এই দ্বীপটিতে মাঝে মাঝে বালির ঢিবি বা টিলার মতো ছিল বিধায় স্থানীয় লোকজন এই দ্বীপকে বাইল্যার ডেইল বলেও ডাকত।

বর্তমানে সমগ্র নিঝুম দ্বীপের প্রায় তিন হাজার একরে মানুষের বসতি আছে এবং অবশিষ্ট অংশে ম্যানগ্রোভ বন রয়েছে।

আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র:
একটি অঘোষিত আকর্ষণীয় লাভজনক পর্যটন কেন্দ্র নিঝুম দ্বীপ যেন স্বর্গভূমিতে পরিণত হয়েছে। দ্বীপের দক্ষিণ বৃত্তাকার প্রায় ১২ কিলোমিটার জুড়ে রয়েছে সমুদ্র সৈকত।

চিকচিকে মোটা বালুকাময় এ সৈকত ঢালু হয়ে চলে গেছে সমুদ্রের অভ্যন্তরে। প্রতিদিন জোয়ার ও ভাটায় যেন স্নান করায় প্রকৃতি এ বেলাভূমিকে । আর এ  বেলাভূমিতে সাগরের ফেনিল ঊর্মিমালা আছড়ে পড়ার অপূর্ব দৃশ্য কারও হৃদয় আলোড়িত না করে পারে না। যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে সমুদ্র।

আর অমাবস্যার চাঁদে জোয়ার ভাটায় এর মনোমুগ্ধকর দৃশ্য এক স্বর্গীয় অনুভূতি সৃষ্টি করে। জোস্নার আলোয় ফেনিল ঊর্মিমালার শীর্ষে শীর্ষে যেন এক একটি মণি মুক্তা জ্বল জ্বল করে জ্বলতে থাকে। দ্বীপের দক্ষিণ প্রান্ত থেকে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখা যায়।

এ দ্বীপকে পর্যটন দ্বীপ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য কয়েকটি সরকারি-বেসরকারি রেস্ট হাউস করা হয়েছে।
একটি বেসরকারি পর্যটন প্রতিষ্ঠান পর্যটকদের জন্য হাতি, ঘোড়ারও ব্যবস্থা করেছে। যেভাবে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন পর্যটক এ দ্বীপের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছে, এ আগ্রহকে কাজে লাগিয়ে এখানে গড়ে উঠতে পারে অত্যন্ত আকর্ষণীয় পর্যটন জোন। এ থেকেও আমাদের দেশ উপার্জন করতে পারে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা।

ইতোমধ্যে নিঝুম দ্বীপ হয়ে উঠেছে একটি চমৎকার স্বাস্থ্য নিবাস। যে কেউ এখানে এসে সুন্দর সূর্যস্নাত দিনে সমুদ্র অবগাহনে হবেন পুলকিত। বছরের ঝুঁকিপূর্ণ ঝড়ঝঞ্ঝার দিনগুলো বাদে বিশেষ করে শীত-হেমন্তে ভ্রমণ বেশ জমে ওঠে।

এখানে শহরের মতো গাড়ির ধোঁয়া নেই। ধূলি বালির আধিক্য নেই। কান ফাটানো গাড়ির হর্ন নেই। কেবল সমুদ্রের নির্মল বাতাস, শান্তস্নিগ্ধ পরিবেশ, বায়ু পরিবর্তনকারীদের জন্য এ দ্বীপটি এক স্বর্গরাজ্য। মাত্র কয়েক ঘণ্টার অবস্থানেই শরীর ও মন হয়ে উঠবে ঝরঝরে তাজা।


যাওয়ার উপযুক্ত সময়:
শহরের ব্যস্ত ও যান্ত্রিক জীবনে যখন হাপিয়ে উঠেন তখন জীবনকে অর্থবহ করতে নিঝুম দ্বীপে ঘুরে আসতে পারেন। শীত মৌসুমে সাগর শান্ত থাকলেও বছরের যে কোনো সময় এখানে আসা যায়। এপ্রিল থেকে সাগর ধীরে ধীরে অশান্ত হতে থাকে। তখন ঢেউয়ের উচ্চতাও বৃদ্ধি পায়। তখন সাগরে নামলে দুর্ধর্ষ অভিযাত্রীর মতো মনে হবে নিজেকে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা পিকনিক করতে এসছে এখানে। তাদের মধ্যে হাসান ,রিজন, সেলিম রেজা বলেন,‘এ সময় সমুদ্র পাড়ি দিতে জীবনের রোমাঞ্চকর বুক-কাঁপানো অভিজ্ঞতা অর্জন হয়েছে আমাদের। অভিজ্ঞতার পাল্লা ভারি হলে জীবনও হয়ে ওঠে অর্থপূর্ন। আমরা প্রথমে ভয় পাচ্ছিলাম এখানে আসতে । কিন্তু এখন দারুণ লাগছে’।

কোথায় থাকবেন:
নিঝুম রিসোর্ট নামে নিঝুম দ্বীপে থাকার জন্য একটি ভালো মানের রিসোর্ট। নোয়াখালীর হাতিয়ায় নিঝুম রিসোর্টের ইনচার্জ  বাংলানিউজকে জানান, এখানে ২ শয্যার কক্ষ ভাড়া ১০০০ টাকা, ৩ শয্যার কক্ষ ১২০০, ৪ শয্যার কক্ষ ১৮০০ , ৫ শয্যার ডরমিটরির ভাড়া ১০০০  এবং ১২ শয্যার ডরমিটরি ২৪০০ টাকা।

এছাড়াও ঢাকা থেকেও এ রিসোটের বুকিং দেওয়া যায়। ঢাকায় ১৭ নিউ ইস্কাটনের  শামসুদ্দিন ম্যানশন’র ১০ম তলায় অবস্থিত অবকাশ পর্যটন লিমিটেড এ বুকিং দেয়া যাবে। ফোন-৮৩৫৮৪৮৫, ৯৩৪২৩৫১, ০১৫৫২৪২০৬০২ এবং নিঝুম রিসোর্টে ইনচার্জ, নোয়াখালীর হাতিয়া থানায় নিঝুম রিসোর্টে যোগাযোগ করা যাবে। ফোন-০১৭২৪-১৪৫৮৬৪।

তাছাড়া এখানে বন বিভাগের একটি চমৎকার বাংলো আছে। পাশেই আছে জেলা প্রশাসকের ডাকবাংলো। এ গুলোতে আগেভাগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে থাকার ব্যবস্থা করা যায়।

এছাড়াও রেড ক্রিসেন্ট ইউনিট ও সাইক্লোন শেল্টারেও থাকার ব্যবস্থা করা যায় বলে স্থানীয়রা জানায়।
এ দ্বীপে অনেকেই আছেন খুব বন্ধুবৎসল। পর্যটকদের এরা খুব সম্মানের চোখে দেখেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী কাজল, সাহেদ, অর্থনীতির সাদেক বলেন, স্থানীয়রা পর্যটকদের খুব সম্মানের চোখে দেখেন। যে কোনো অসুবিধা দূর করতে আগ্রহ করে তারা নিজেরাই এগিয়ে আসেন।


নিঝুম দ্বীপে হরিণের সংখ্যা অনেক । হরিণ দেখতে হলে এখানে ভ্রমণ কালীন কিছু বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। বনে ঢুকলে নিঃশব্দে চলাচল করতে হবে। সামান্য হইচই করলেও এখানে হরিণের দেখা মেলা ভার ।

নিঝুম দ্বীপে বিদ্যুতের সরবরাহ নেই। তবে নামা বাজার এলাকায় রাত এগারটা পর্যন্ত জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করেছে স্থানীয় লোকজন।

কীভাবে যাবেন:
ঢাকা থেকে নিঝুম দ্বীপ যাওয়ার সহজ রুট সদরঘাট থেকে লঞ্চে করে হাতিয়ার তমরুদ্দি। এ পথে এমভি পানামা এবং এমভি টিপু-৫ নামে দুটি লঞ্চ নিয়মিত চলাচল করে। যোগাযোগের ফোন-০১৯২৪০০৪৬০৮ এবং ০১৭১১৩৪৮৮১৩।

ভাড়া ডাবল কেবিন ১২০০ আর সিঙ্গেল ৬৫০ টাকা। ডেকে জনপ্রতি ২০০ টাকা খরচ হবে। ল্ঞ্চগুলো ঢাকা থেকে ছাড়ে বিকেলে আর তমরুদ্দি থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছাড়ে দুপুর সাড়ে বারটায়। আর তমরুদ্দি থেকে স্কুটারে বন্দরটিলা ঘাট খরচ হবে ৪৫০-৫৫০ টাকা। আর সেখানে ট্রলারে চ্যানেল পার হলেই বন্দরটিলা । এরপর নিঝুম দ্বীপের নামা বাজার রিকশায় করে যেতে হবে ।

অন্যদিকে নিঝুম দ্বীপে ভ্রমণ প্যাকেজের আয়োজন করে থাকে লংমার্চসহ বিভিন্ন টুরিস্ট সংস্থা । এই ঈদে আপনিও সবান্ধব ঘুরে আসতে পারেন রহস্যময় এ দ্বীপটিতে।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।