ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

লাইফস্টাইল

তবুও থেমে নেই ফারাহ্‌স ওয়ার্ল্ডের সফলতার গল্প

লাইফস্টাইল ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৪১ ঘণ্টা, আগস্ট ২৭, ২০১৯
তবুও থেমে নেই ফারাহ্‌স ওয়ার্ল্ডের সফলতার গল্প সামিয়া ফারাহ্ ও ফারাহ্‌স ওয়ার্ল্ডের পোশাকে শাওন

সামিয়া ফারাহ্, ডাক নাম শাওন। সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম তার, পরিবারের প্রথম সন্তান। সরকারি কর্মকর্তা বাবা, স্নেহময়ী মায়ের সংসারে তাদের দুই বোনকে নিয়ে জীবন ছিল রূপকথার মতো সাজানো। 

কিন্তু সময় তার নিজের গতিতে চলে। যার মাঝে থাকে সাজানো জীবনের নানা বাঁক নেওয়ার গল্প। বিশ্বের ১১টি দেশে নিজের ডিজাইন করা পোশাক অনলাইনে বিক্রি করেন, জনপ্রিয় ও সফল নারী উদ্যোক্তা সামিয়া ফারাহ্। বাংলানিউজের পাঠকদের সঙ্গে তিনি শেয়ার করেছেন, ফারাহ্‌স ওয়ার্ল্ডের সফলতার পেছনের গল্প।  

সামিয়া ফারাহ্ বলেন, ছোটবেলা থেকেই জানি, হয় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক বা ব্যাংকারের ক্যারিয়ার গড়তে হবে। অর্থনীতিতে অনার্স-মাস্টার্স করলাম।

মাষ্টার্স পরীক্ষার রেজাল্টের অপেক্ষায় ধানমন্ডিতে বাসার কাছেই একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষক হিসেবে জয়েন করলাম। সঙ্গে চললো বিসিএস-এর প্রিপারেশন।  

কিছুদিনের মধ্যে বিয়ে হয়ে গেল। নামকরা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পদস্ত চাকুরে পাত্র। শ্বশুর বাড়ি বনানী হওয়াতে স্কুলের চাকরি ছেড়ে দিলাম। এরপর স্ট্যান্ডার্ড চ্যাটার্ড ব্যাংকে চাকরি পেলাম। খুব শখ ছিল মাল্টিন্যাশনাল প্রতিষ্ঠানে চাকরির। এর মধ্যেই নিজের ভেতর ছেলের অস্তিত্ব টের পেলাম। চাকরি ছাড়তে হলো। খুব মন খারাপ হলেও মেনে নিলাম। নিজের সন্তানকে সময় দেব, ভেবে নিজেকে সান্তনা দিলাম।

রাজপুত্র আমার কোলে এলো। ওকে নিয়েই কেটে যাচ্ছিল দিন-রাত্রি। আমার বর ব্যস্ত মানুষ, তিনি কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। আমার বা ছেলের জন্য তার তেমন সময় হয় না। এদিকে আমি ছেলেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও এক ধরনের বিষন্নতায় ভুগতে শুরু করলাম।  

আমার অবস্থা বুঝতে পারলো একমাত্র ছোট বোন। সেই পরামর্শ দিল ডিজাইনিং নিয়ে কাজ শুরু করতে। ছোট বেলা থেকেই ছিলাম ফ্যাশন সচেতন। রেডিমেড কাপড় পড়তে চাইতাম না। চাঁদনী চক থেকে নিজে গজ কাপড় কিনে নানা রকম ডিজাইন দিয়ে ড্রেস বানাতাম। আমার জামা অন্য কারো সঙ্গে মিলতে পারবে না। সেটা অবশ্যই হতে হবে ইউনিক। যাই হোক ছোট বোনের পরামর্শে একটা ডায়েরিতে ডিজাইনের স্কেচিং শুরু করলাম। আমার অনেক শখের মধ্যে একটা ছিল পত্রিকা জমানো। দেশ বিদেশের নানান রকমের ম্যাগাজিন। সেগুলো আইডিয়া পেতে খুব কাজে দিল। নিজের জমানো মাত্র পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে শুরু করলাম।  

আম্মুর কাছে বাবুকে রেখে লোকাল মার্কেট ঘুরে ঘুরে কিছু কাপড় কিনলাম। খুঁজে খুঁজে অভিজ্ঞ কারিগর বের করলাম। বেশ কিছু ড্রেস বানালাম। ফ্যামিলি এবং বন্ধুদের মাঝে খুব ভালো সাড়া পেলাম। জামাগুলো বিক্রিও হয়ে গেলো দ্রুত। আমি খুব উৎসাহ পেলাম।  
ভাবলাম ডিজাইনিং-এ যেহেতু কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, একটা ডিপ্লোমা কোর্স করে ফেলি। ভর্তি হলাম ধানমন্ডির রেডিয়েন্ট ফ্যাশন ইন্সটিটিউটে। শুরু করলাম খুব আগ্রহ নিয়ে। প্রথম পরীক্ষায় প্রথম স্থান।  

কিন্তু আবারও বিধিবাম। একদিন আমি ক্লাসে থাকা অবস্থায় ছেলের জ্বর আসলো। ফোন সাইলেন্ট করা থাকায় শ্বশুরের ফোন শুনতে পেলাম না। উনি আমার আম্মুকে ফোন করে অভিযোগ করলেন। সেদিনের পর আর ক্লাসে যাইনি।  

২০১১ তে সেই ছোট বোনই ফেইসবুকে একটা পেইজ খুলে দিল। তার আগে পর্যন্ত সব পরিচিত মানুষরা আমার ক্লায়েন্ট ছিল, পেইজ খোলার পর ক্লায়েন্ট সংখ্যা বাড়লো।  
ছেলের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসাও বড় হতে লাগলো। দেশের বাইরে থেকে প্রচুর অর্ডার পেতাম। ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। কিন্তু আমার এই ব্যস্ততা অনেকেরই ভালো লাগলোনা। হাসব্যান্ড সুপ্রতিষ্ঠিত কোম্পানির ডেপুটি ম্যান্যাজিং ডিরেক্টর তাও কেন আমাকে ব্যবসা করতে হবে।  

এবার শক্ত হয়ে থাকলাম। আমিও একটা মানুষ। আমারও আইডেন্টিটি দরকার আছে। আমার মধ্যে সৃষ্টিশীলতা আছে। আমি কেন বসে থাকবো? আর যেখানে শুধু কাপড় কালেকশান বাদে বাকি সব কাজই আমি বাসায় বসেই করতে পারছি। সংসারকে প্রায়োরিটি দিয়েই সব কাজ করছিলাম। কিছুদিন পর বাসার নিচে একটা শোরুম দিলাম। একটা মেয়ে রাখলাম। ভালোই চলছিল সবকিছু, দিনগুলো মন্দ ছিল না।

ফারাহ্‌স ওয়ার্ল্ডের পোশাকজীবনে যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো। আমার হাসব্যান্ড চাকরিচুত্য হলেন। একের পর এক বিপর্যয় ঘটতে লাগলো। অবিশ্বাস্য সব ব্যাপার। আমি জানতে পারলাম উনি মাদকাসক্ত। ওনার মাথায় প্রায় ৭০ লাখ টাকার লোনের বোঝা। এত টাকা উনি কি করেছেন কোনো সদুত্তর দিতে পারলেন না। এক মাসের মাথায় আমার ছবির মতো সাজানো সংসার তছনছ হয়ে গেলো। লোন পরিশোধের জন্য চাপ আসতে থাকলো। গাড়ি বিক্রি করে দেওয়া হলো। আমার জমানো টাকা, গহনা সব দেওয়া হলো। কিন্তু ৭০ লাখ অনেক টাকা, আমার শ্বশুর ঢাকায় ওনার জমি বিক্রি করে দিলেন।  

এর মধ্যেই আমার হাসব্যান্ড মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেললেন। তাকে রিহ্যাবে দেওয়া হলো। শুরু হলো আরেক অনিশ্চিত জীবন। আমি আমার ছেলে নিয়ে আব্বু আম্মুর কাছে চলে আসলাম।  

আমার বর পুরোপুরি সুস্থ হলেন না। বাসাতে যখন থাকতেন সারাক্ষণ মানসিক অত্যাচার করতেন, বাজে সন্দেহ, আজেবাজে কথা, ওষুধ খেতেন না, কিছু বললেই আত্মহত্যার হুমকি দিতেন। আমি ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলাম। ছেলেটাও চোখের সামনে এগুলো দেখছিল যেটা আমি চাইতাম না।  

এক সময় বাধ্য হয়েই ডিভোর্স নিয়ে নিলাম। এরপর শুরু হলো ছেলেটাকে নিয়ে একা চলার যুদ্ধ। চাকরির চেষ্টা করলাম প্রথম। কিন্তু ততদিনে অনেক গ্যাপ হয়ে গেছে।  

আবার নতুন করে ব্যবসা শুরু করলাম। এবার আর শখ করে নয়। এবার আমি আরও বেশি সিরিয়াস, আরও বেশি ম্যাচিউরড আর অনেক বেশি প্রফেশনাল। আমার ব্যবসার মূল মূলধন ছিল আমার সততা এবং আমার ভালো ব্যবহার। দ্রুতই প্রচুর ক্লায়েন্ট হয়ে গেলো। পেইজ একটিভ দেখে পুরোনো ক্লায়েন্টরাও যোগাযোগ শুর করলেন। কাপড়ের মান নিয়ে কখনোই কম্প্রোমাইজ করিনি আমি। আর আমি বরাবরই আফটার সেল সার্ভিসকে খুব গুরুত্ব দেই। একজন কাস্টমার কাপড় কিনলেন, টাকা পেয়ে গেলাম, সেখানেই শেষ নয় বরং আমার নীতি অনুযায়ী সেখানেই শুরু।  


Farah's World এখন একটা সুপরিচিত এবং বিশ্বাসযোগ্য পেইজ। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর ১১ টি দেশে আমার ডিজাইন করা পোশাক যাচ্ছে। একদিন একটা ফ্যাশন স্টুডিও হবে আমার, সেই স্বপ্ন দেখি।  

 

বাংলাদেশ সময়: ১২৪০ ঘণ্টা, আগস্ট ২৭, ২০১৯
এসআইএস

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।