ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

লন্ডন

মানুষকে চুম্বকের মতো টানে মস্কোর রেড স্কয়ার

শামীম খান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৫৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০২০
মানুষকে চুম্বকের মতো টানে মস্কোর রেড স্কয়ার .

মস্কো (রাশিয়া) থেকে ফিরে: ঐতিহাসিক নিদর্শন এবং দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য নিদর্শনে সমৃদ্ধ এক পর্যটনকেন্দ্র মস্কোর রেড স্কয়ার বা লালচত্বর। এর ইতিহাস-ঐতিহ্যের টানে প্রতিদিন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের হাজার হাজার ভ্রমণপিপাষু মানুষ এই রেড স্কয়ারে ছুটে আসেন। রাশিয়ার প্রশাসনিক ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু ক্রেমলিন সংলগ্ন এই রেড স্কয়ারের প্রতিটি ভবনের যে নির্মাণশৈলী, কারুকার্য ও স্থাপত্যরীতি তা মানুষকে বার বার আকর্ষণ করে।

রাশিয়ার রাজধানী মস্কোর প্রাণকেন্দ্রে এই রেড স্কয়ার অবস্থিত। রেড স্কায়ারের প্রতিটি ভবনই সুউচ্চ, স্থাপত্যশৈলী, শৈল্পিক কারুকার্যসজ্জিত ও নান্দনিক সৌন্দর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

নানা শৈল্পিক নিদর্শনে পরিপূর্ণ রেড স্কয়ারের চার দিকের প্রতিটি ভবনই এক একটি ভাস্কর্য হিসেবে ফুটে উঠেছে। এখানকার অধিকাংশ ভবনের রংই লাল। কোনো কোনো ভবনের রং পুরোপুরি লাল না হলেও অন্যান্য রঙের সঙ্গে লালেরও ছোঁয়া রয়েছে। সাধারণভাবে বলা হয় ভবনের লাল রঙের কারণেই এই চত্বরের নাম হয়েছে রেড স্কয়ার বা লাল চত্বর। তবে শুধু রঙই নয় নামকরণের পেছনে অন্য কারণও আছে বলে ধারণা করা হয়। রাশিয়াতে লালকে সুন্দরের প্রতীক হিসেবেও তৎকালে গণ্য করা হতো।

রেড স্কয়ারকে ঘিরে রয়েছে প্রাচীন এবং জার শাসনামলের অনেক নির্দশন। যার মধ্য দিয়ে রাশিয়ার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ফুটে উঠেছে। আধুনিককালে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর এই রেড স্কয়ার কমিউনিস্ট বিপ্লবের স্মৃতিবিজড়িত স্থান হিসেবেও পরিচিত। এই রেড স্কয়ার ছিলো মস্কোর প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র। তবে জার শাসনামল-পরবর্তী সোভিয়েত আমল এবং বর্তমানে রাশিয়ার জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানও এখানে উদ্‌যাপন করা হয়। বর্তমানে এটি রাশিয়া তথা বিশ্বের অন্যতম সেরা পর্যটনকেন্দ্র। প্রতিদিন এখানে হাজার হাজার মানুষ ভিড় করেন এর ঐতিহাসিক ও দৃষ্টিনন্দন নিদর্শনগুলো দেখার জন্য।

এই রেড স্কয়ারে শায়িত আছেন রুশ বিপ্লবের মহানায়ক ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন। কমিউনিস্ট বিপ্লব যেটি অক্টোবর বিপ্লব হিসেবে বিশ্বে পরিচিত সেই বিপ্লবের জন্ম দিয়ে ৯৬ বছর আগে লেলিন মৃত্যুবরণ করেন। ভি আই লেনিনের মরদেহ(মমি) এই রেড স্কয়ারে সংরক্ষিত রয়েছে। একইভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে ইতিহাসের আরেক মহানায়ক, লেনিনের উত্তরসুরি যোসেফ স্তালিনের মরদেহ। এ কারণে কমিউনিস্ট মতাদর্শের সমর্থকদের কাছেও এই স্থানটির এক আলাদা আকর্ষণ ও স্মৃতিকাতরতা রয়েছে।

কমিউনিস্ট বিপ্লবের শত বছর পেরিয়ে গেছে, সমাজতন্ত্রের স্মৃতি বিজড়িত স্থান হিসেবেও এই স্কয়ার দর্শনের জন্য হাজার হাজার মানুষ এখানে ছুটে আসেন আজও । কমিউনিস্ট মতাদর্শের প্রতি দুর্বলতা না থাকলেও রেড স্কয়ারে আসা সব মতাদর্শের পর্যটক লেনিনের সমাধিসৌধে যান। এখানে সংরক্ষিত লেনিনের মমি দেখার জন্য এখনও প্রতি দিনই পড়ে যায় দীর্ঘ লাইন। লেনিনের মমির কাছে পৌঁছাতে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে মানুষকে অপেক্ষা করতে হয়।
.এই রেড স্কয়ার সংলগ্ন রাশিয়ার আরেক গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান ক্রেমলিন চত্বর। রেড স্কয়ারের পশ্চিম পাশে রশিয়ার রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু এই ক্রেমলিন অবস্থিত।  ক্রেমলিনেই বর্তমান রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের বাসভবন। ১৯১৭ সালে অক্টোবর বিপ্লবের মধ্য দিয়ে  সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার পর ভি আই লেনিনের বাসভবনও ছিলো ক্রেমলিনে। সোভিয়েত আমলে এই ক্রেমলিন ছিলো বিশ্বে একটি আলোচিত নাম। বিশ্বের দুই সামরিক পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়েনের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধকালে হোয়াইট হাউজ(যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের বাসভবন ও অফিস) ও ক্রেমলিনের নাম ছিলো সমানভাবে উচ্চারিত। সোভিয়েত-পরবর্তী সময়ে বিশ্বপ্রেক্ষাপটে ক্রেমলিনের প্রভাব কিছুটা কমলেও গত এক দশকেরও বেশি সময়ে তা আবার ফিরে এসেছে। সোভিয়েত আমলের শেষ দিকে ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইনিউয়নের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হিসেবে রেড স্কয়ার ও ক্রেমলিনকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ বা বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ইউনেস্কো।

এই রেড স্কয়ারে রয়েছে মস্কোর বিখ্যাত ঘড়ি। এখানে স্যাভিয়ার টাওয়ার বা প্যাসকায়া টাওয়ারে ১৬২৫ সালে এই বিখ্যাত ঘড়ি স্থাপন করা হয়। মোট ২৫ টন ওজনের এই ঘড়ির কাঁটা, রিম ও সময় নির্দেশক সংখ্যাগুলো তৈরিতে ২৮ কেজি স্বর্ণ ব্যবহার করা হয়। ২৩৩ মিটার উচ্চতার স্যাভিয়ার টাওয়ারের চারদিকে এই ঘড়ি স্থাপন করা হয়েছে যা মস্কো শহরের সৌন্দর্যের অন্যতম আকর্ষণ এটি।  

রেড স্কয়ারে আরও রয়েছে সেন্ট ব্যাসিলস ক্যাথেড্রাল চার্চ। ষোড়শ শতকে জার ইভান এটি নির্মাণ করেন। খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বিদের উপাসনার জন্য এটি নির্মাণ করা হলেও নানা কারুকার্য অসাধারণ নির্মাণশৈলী ও শিল্পনৈপুণ্যের জন্য এই চার্চটি রেড স্কয়ারের আরেকটি মনোমুগ্ধকর স্থাপনা। বর্তমানে এই চার্চটি একটি জাদুঘর। রেড স্কয়ারে রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শপিং কমপ্লেক্স। রাশিয়ার জার প্রথম আলেকসান্দর ১৮১২ সালে এই বিশাল ভবনটি তৈরি করেন। দৃষ্টিনন্দন এই ভবনটিকে অধুনাকালে শপিং কমপ্লেক্স করা হয়।  
 
রেড স্কয়ারেই রয়েছে ঐতিহাসিক মস্কো স্টেট মিউজিয়াম যেটি ১৮৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই রেড স্কয়ারে আরও রয়েছে অনেক ঐতিহাসিক ও দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা যেসবের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পর্যটকরা বার বার সেখানে ছুটে যেতে পারেন।

রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় পারমাণবিক শক্তি করপোরেশন-রোসাটমের (রুশ উচ্চারণ ‘রুসাতম’) আমন্ত্রণে বাংলাদেশের ৫ সদস্যের একটি সাংবাদিক প্রতিনিধি দল গত ৮ থেকে ১৩ ডিসেম্বর দেশটি সফর করেন। এই দলটিকে রাশিয়ার সর্ববৃহৎ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ’নভোভরোনেস পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র’ ঘুরিয়ে দেখানো হয়। এ সময় এই টিমের সঙ্গে সার্বক্ষণিক সহযোগিতায় ছিলেন রোসাটমের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক কমিউনিকেশন ম্যানেজার মাক্সিম এবং নভোভরোনেস পাওয়ার প্লান্টের ইন্টারন্যাশনাল কমিউনিকেশন অফিসার ইভগিনিয়া ভেলগলোগভা জেনি। নভোভরোনেসে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটির রিয়্যাক্টরসহ বিভিন্ন অংশে ঘোরানোর পর সাংবাদিকদের গত ১২ ডিসেম্বর রাশিয়ার রাজধানী মস্কোর ঐতিহাসিক রেড স্কয়ার ঘুরিয়ে দেখানো হয়।

সকালে মেট্রোরেল স্টেশন থেকে বেরিয়ে রেড স্কয়ারের দিকে এগোতেই দেখা যায় শুন্যের নীচে ৩ ডিগ্রি(-৩) তাপমাত্রার শীত আর ঘন কুয়াশা উপেক্ষা করে ছুটছে হাজারো মানুষ। মূল চত্বরে প্রবেশ করেই নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ বিভিন্ন বয়সের পর্যটকরা একের পর এক বিভিন্ন স্থাপনার সামনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন, ছবি তুলছেন। মানুষ আসছে, যাচ্ছে কিন্তু মানুষের কোনো কমতি নেই। মাক্সিম জানালেন, এটাই এখানকার প্রতিদিনের প্রতি মুহুর্তের চিত্র।

বাংলাদেশ সময় ১২৫৬ ঘন্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০২০
এসকে/জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

লন্ডন এর সর্বশেষ