ঢাকা, মঙ্গলবার, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মালয়েশিয়া

রাজনৈতিক সংকটে আগামীর মালয়েশিয়া

রাজিউল হাসান, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬০১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৪, ২০১৫
রাজনৈতিক সংকটে আগামীর মালয়েশিয়া ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা: ওয়ানএমডিবি বিতর্কে বেশ বেকায়দায় আছেন ক্ষমতাসীন ইউনাইটেড মালয় ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনের (ইউএমএনও) প্রেসিডেন্ট ও মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক। অনেকে এ বিতর্কেই তার রাজনীতির ইতি দেখছেন।

আবার কেউ কেউ বলছেন, শুধু নাজিব রাজাকই নন, রাজনৈতিক সংকটে পড়েছে পুরো মালয়েশিয়াই।

ইতিহাস বলছে, মালয়েশিয়ায় নাজিবের আগে আর কোনো প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় থাকাকালে এভাবে কোনো বিতর্কে জড়িয়ে পড়েননি। কোনো প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করে বিক্ষোভে উত্তালও হয়নি দেশ। কিন্তু এবার হয়েছে। আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে রাজধানী কুয়ালালামপুরে সরকারবিরোধী আন্দোলনের ডাক দেয় নাজিববিরোধী জোট বার্সিহ। এরই ধারায় ২৯ ও ৩০ আগস্ট মারদেকা অভিমুখে ৠালি অনুষ্ঠিত হয়। এতে যোগ দেন লক্ষাধিক মানুষ।

সমালোচকরা বলছেন, এবার সত্যিই বেশ চাপে পড়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তারওপর এ আন্দোলনে সমর্থন জানিয়ে দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আধুনিক মালয়েশিয়ার জনক ড. মাহাথির মোহাম্মদ রাজপথে নামায় নাজিবের অবস্থান আরও নাজুক হয়ে পড়েছে বলে মত তাদের।

আর বিশ্লেষকরা বলছেন, মালয়েশিয়ায় সরকারের ক্ষমতাসীন জোট ও বিরোধী জোট, উভয় জোটেই দিনে দিনে দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে উঠছে। তাদের মতে, এ দ্বন্দ্বের চরম প্রকাশ ঘটতে পারে ২০১৮ সালের নির্বাচনেই।

ক্ষমতাসীন দলে দ্বন্দ্ব

ক্ষমতাসীন দলে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত মূলত ২০১৩ সালের নির্বাচন থেকে। ১৯৫৭ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর এখন পর্যন্ত দেশটির ক্ষমতায় আছে ইউএনএমও। এ দলের বর্তমান প্রেসিডেন্ট নাজিব রাজাক ২০০৯ সাল থেকে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে কখনও জনপ্রিয়তায় ভাটা না দেখলেও ২০১৩ সালের নির্বাচনে দলটিকে তা দেখতে হয়।

নির্বাচনের পরপরই দলের মধ্যে শুরু হয় গুঞ্জন। দলের কোনো কোনো সদস্য মনে করেন, নাজিব রাজাকের পরিকল্পনায় ও পদক্ষেপে ত্রুটি থাকাতেই এমন দিন দেখতে হচ্ছে তাদের। অনেকে ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিরোধীজোটের কাছে হেরে যাওয়ার আশঙ্কাও করছেন।

এই গুঞ্জন চলার মাঝেই চলতি বছর জুলাই মাসে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে প্রকাশিত হয় একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন। এতে মালয়েশীয় প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়া ও অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার অভিযোগ তোলা হয়। প্রতিবেদনে জানানো হয়, ওয়ানএমডিবি ফান্ড থেকে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ২ দশমিক ৬ বিলিয়ন রিংগিত (৫ হাজার ১৮৪ কোটি ৭৫ লাখ টাকা) জমা করা হয়েছে।

এরপর থেকেই ইউএনএমও-তে নাজিবের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কথা বলতে শুরু করেন অনেক নেতা। অবস্থা বেগতিক দেখে মন্ত্রিপরিষদ রদবদলের নামে গত ২৮ জুলাই তিনি উপ-প্রধানমন্ত্রী মুহিদ্দিন ইয়াসিনকে বরখাস্ত করেন। তার এ পদক্ষেপ ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয় দলে। কারণ মুহিদ্দিন ইয়াসিন ইউএনএমও’র ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়ার পাশাপাশি দলের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় একজন নেতা ছিলেন। নাজিবের উত্তরসূরি মনে করা হতো তাকে।

এদিকে, নাজিবের সবচেয়ে বড় সমালোচক মাহাথির মোহাম্মদ এরই মধ্যে রাজপথে নেমে পড়েছেন। তার সঙ্গে যদি প্রকাশ্যে মুহিদ্দিন ও অন্যান্য নেতারা যোগ দেন, তাহলে পরিস্থিতি আরও ঘোলা হয়ে উঠবে বলে আশঙ্কা বিশ্লেষকদের।

মালয়েশিয়ায় যে ঘটনার নজির নেই, সে ঘটনাও ঘটে যেতে পারে। নাজিবের কট্টোর অবস্থানের কারণে ভেঙ্গেও যেতে পারে ইউএনএমও। এর পেছনে শক্ত যুক্তিও পাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

৩১ আগস্ট মালয়েশিয়ার জাতীয় দিবসে স্থানীয় সময় সকালের ভাষণেই নাজিব বুঝিয়ে দিয়েছেন, তিনি পদত্যাগ তো করবেনই না, উপরন্তু কঠোর হাতে আন্দোলন দমন করবেন।

এর পরপরই খবরে জানা যায়, বার্সিহ আন্দোলনে যোগ দিয়ে নাজিবের বিরুদ্ধে ড. মাহাথির মোহাম্মদ যে অভিযোগ তুলেছেন, তা ব্যাখ্যা করতে পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে হবে তাকে। এতে সংকট আরও বাড়িয়ে দিয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ জনগণের মধ্যে আধুনিক মালয়েশিয়ার জনক মাহাথিরের ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে।

এসব ঘটনায় মাহাথির-মুহিদ্দিনসহ ইউএনএমও’র যে নেতারা নাজিবের ওপর নাখোশ, তারা যদি দল ভেঙ্গে নতুন দল গঠনের উদ্যোগ নিয়ে বসেন, তাহলে মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে রীতিমত বিস্ফোরণ ঘটবে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।

বিরোধী জোটেও সংকট

ঠিক যে মুহূর্তটার সুযোগ লুফে নেওয়ার কথা ছিল, সে সময়ই সংকটে ভুগছে মালয়েশিয়ার বিরোধীদলীয় জোটও। মালয়েশিয়ার সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম পরবর্তীতে ইউএনএমও থেকে বেরিয়ে পিপল’স জাস্টিস পার্টি (পিকেআর) গঠন করেন। এরপর বাকি দুই বিরোধী দল প্যান-মালয়েশিয়ান ইসলামিক পার্টি (পিএএস) ও ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন পার্টিকে (ডিএপি) নিয়ে তিনি বিরোধী জোট পাকাতান রাকায়েত (পিআর) গঠন করেন।

কিন্তু পুরুষকামীতার কারণে চলতি বছর ফেব্রুয়ারিতে পাঁচ বছরের জেল হয় আনোয়ার ইব্রাহিমের। তার এ অনুপস্থিতিতে ধীরে ধীরে বন্ধন হাল্কা হতে শুরু করেছে জোটে। পিএএস ও ডিএপি’র আদর্শগত পার্থক্যকে এর মূল কারণ বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। পিএএস মালয়েশিয়ার একটি ইসলামিক রাজনৈতিক দল, আর ডিএপি হলো মধ্য-বামপন্থি দল। এই আদর্শগত পার্থক্যের কারণে দল দু’টোর মধ্যে সম্পর্কে শীতলতা নেমে এসেছে। এর ফলে কার্যত বিরোধী জোট পাকাতান রাকায়েত বলতে গেলে নিষ্ক্রীয় হয়ে পড়েছে।

শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ডিএপি ও আনোয়ার ইব্রাহিমের পিকেআর জোটের অপর শরিক পিএএসকে বাদ দিয়েই জোট গঠনের চেষ্টা করছে। এর ফলে নাজিবের ইউএনএমও’র সঙ্গে পিএএস’র ভিড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ফলে আগামীর মালয়েশিয়া হয়তো মালয়-মুসলিম রাজনৈতিক জোটের সরকার দেখতে চলেছে।

তবে এ সম্ভাবনা শুধু কাগজ-কলমের হিসেবেই দেখা যাচ্ছে। কারণ পিএএস একটি রক্ষণশীল দল। দলটি এরই মধ্যে জোট সরকার গড়ায় ইউএনএমও’র সঙ্গে কাজ করার ব্যাপারটি প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, মালয়েশিয়ার রাজনীতি এমন এক অধ্যায়ে ঢুকতে চলেছে, যার বর্ণনা শুধু ভবিষ্যতই দিতে পারবে।

এরপর কি?

ক্ষমতাসীন দলে কিংবা বিরোধী জোটে দ্বন্দ্বগুলো এমন এক সময় চলছে, যখন পরবর্তী নির্বাচন থেকে মালয়েশিয়া মাত্র তিন বছর দূরে রয়েছে। আপাতদৃষ্টে এ সময় অনেক বড় বলে মনে হলেও সংকটের বিচারে তা খুবই কম। প্রশ্নটা উঠছে, ক্ষমতাসীনরা বা বিরোধীরা কি এই সময়ের মধ্যে নিজেদের সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠতে পারবে?

যদি পারে, তাহলে হয়তো এ সংকটকে সাময়িক বলে চালিয়ে দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু যদি না পারে, তাহলে মনে রাখতে হবে, ২০২০ সালের টার্গেট থেকে মাত্র পাঁচ বছর পেছনে আছে মালয়েশিয়া। ওই বছর দেশটির উন্নত দেশগুলোর তালিকায় ঠাঁই করে নেওয়ার কথা। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মাহাথির মোহাম্মদ এ ডেডলাইন নির্ধারণ করেছিলেন।

প্রশ্নটা উঠছে, এ রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে মালয়েশিয়া তার সামনে এগিয়ে যাওয়াটা কি ধরে রাখতে পারবে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভবিষ্যতে যাই ঘটুক, তাতে বর্তমানে রাজনীতিতে চলমান দ্বন্দ্বই যে মুখ্য ভূমিকা রাখবে, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।

** বিতর্কেই কি রাজনীতির ইতি মালয়েশীয় প্রধানমন্ত্রীর?

বাংলাদেশ সময়: ১৬০০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৪, ২০১৫
আরএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

মালয়েশিয়া এর সর্বশেষ