ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মালয়েশিয়া

শুদ্ধতার ঢেউয়ে ভাসা ‘সামান’

মাজেদুল নয়ন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩২৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১৫
শুদ্ধতার ঢেউয়ে ভাসা ‘সামান’ ছবি: মাহেসান সেল্লাদুরাই/বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

কুয়ালালামপুর থেকে ফিরে: কুয়ালালামপুরে কঠিন আর অন্ধকার সব বিষয়ের সঙ্গে মিশতে মিশতে নিজেকে হারিয়ে ফেলছিলাম ক্ষণে ক্ষণে। সেখানেই যেন খুঁজে পেলাম সত্যকে কেড়ে নেওয়ার শক্তি।

বিস্তীর্ণ শস্য রাশির ঢেউয়ে খেলা করেছিলো আমার মন, যেখানে খুঁজে নেয়া যায় শুদ্ধতাকেও।

১৩ অক্টোবর রোববার দুপুর থেকেই বেশ ব্যস্ততা। প্রবাসী মানুষের পাওয়া না পাওয়ার খতিয়ান, দুঃখ-কষ্টের গল্পগুলো, আর একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগের টালি খাতা আমাকে ঢোক দিয়েই গিলতে হচ্ছিল। আগের রাতের মায়ানমারের সাউ মান থাবিনের ( Shwe Man Thabin) নজর কাড়া নৃত্য পরিবেশনা আমাকে মুগ্ধ করেছিল। তাই পুসাকার (PUSAKA) পরবর্তী পরিবেশনা ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশের গায়ো জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী‘সামান’ (Saman) নৃত্য দেখার সুযোগ হারাতে চাইছিলাম না। মাথা থেকে সব ঝেড়ে রাত আটটার মধ্যেই হাজির হই কোতারায়ার পার্শ্ববর্তী মেদান পাশারে (Medan Pasar)।

খোলা জায়গায় যে মঞ্চটি করা হয়েছে, সেটিকে খুব বেশি আলো ঝলমলে বলা যাবে না। মেদান পাশারের ওপর দিয়ে অনেকবারই হেঁটে গিয়েছি আমি। দু’একবার ছবিও তোলা হয়েছে। জায়গাটা বেশ সুন্দর। প্যারিসের কোন খোলা চত্বরের সঙ্গে সহজেই মিলিয়ে নেওয়া যায় স্থানটিকে। পরিচিত কয়েকজন বাংলাদেশিকে ফোন দিয়ে আমন্ত্রণ জানালাম। কিন্তু কেউ সাড়া দিলো না, অগত্যা একাই।

দেখা মিললো সাউ মান থাবিনের প্রশিক্ষক শাও মান ইউ উইন মংয়ের(Shwe Mann U Win Maung) সঙ্গে। এই ফাঁকে কিছু কথা বলার সুযোগ হলো বিশ্বখ্যাত এই নৃত্য প্রশিক্ষকের সঙ্গে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা হয় নৃবিজ্ঞানী (Anthropologist) ও গবেষক লিলিয়ান ফানের (lilianne Fan) সঙ্গে। ১৯৯৯ সাল থেকেই ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশে কাজ করছেন তিনি। ভিন্ন জাতির দেশ মালয়েশিয়ায় এবারের পুশাকা উৎসবে ইন্দোনেশিয়ার বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে পরিচিত করিয়ে দিতে চেষ্টা করেছেন তিনি, তবে এর মধ্যে অবশ্যই সামান অন্যতম।

রাতের উৎসবের মাঝামাঝি সময়ে মঞ্চে প্রবেশ করেন সামান শিল্পীরা। সবার পোশাক একই রকম। কালো পোশাকের ওপর আরো বিভিন্ন রংয়ের এমব্রয়ডারি। পোশাকে রয়েছে প্রকৃতি আর সরলতার ছবি।

লিলিয়ান ফানের লেখা থেকে জানতে পারি, সেলানো এবং এমব্রয়ডারি করা সামানের জন্যে বিশেষ পোশাককে বলা হয় কেরাওয়াং। এখানে রংগুলোর কিছু বিশেষ অর্থ থাকে। কালো রঙ ঐতিহ্যকে প্রকাশ করে, সাহসের প্রতীক লাল, আন্তরিক অভিপ্রায়ের ভাষার রঙ সাদা, সবুজের মানে সংকল্প ও অধ্যাবসায়। আর হলুদ রঙ মনোযোগিতাকে নির্দেশ করে।

সামান পরিবেশনায় মঞ্চে কোন বাদ্যযন্ত্র নেই। ঝাকড়া চুলের সুঠাম দেহের অধিকারী গায়ো জনগোষ্ঠীর এ শিল্পীরা খালি হাতেই এসে বসেন। তারা একজন আরেকজনের সঙ্গে গা লাগিয়ে বসেন। প্রথম দেখায় মনে হবে হাঁটুমুড়ে যেন এক প্রতিরক্ষা বুহ্য তৈরি করতে চেয়েছিলেন শিল্পীরা।

কুয়ালালামপুরে ভ্যাপসা গরম। তবে শীতের নীরবতাকে যেনো ভাঙে শুকনো পাতার মরমর ধ্বনি। একসঙ্গে ছোট ছোট তালির আওয়াজ সুর হয়ে ওঠে। বুকে, উরুতে চাপড়াতে থাকে শিল্পীরা। শিষ ধ্বনির মতো আওয়াজ ভেসে আসে। কখনো যেনো মনে হচ্ছিলো, সাগরের স্রোত জোয়ারে ভেসে আসছে। ঢেউয়ের সঙ্গে ঢেউ জড়িয়ে যাচ্ছে অথবা একে অপরকে ভাসিয়ে দিচ্ছে সামনের দিকে, উর্দ্ধগতিতে কম্পন তৈরি হচ্ছে।

তবে হঠাৎ করেই আবার বিদ্যুতের মতো ১৫টি দেহ ঝলকে উঠে। নজরুলের মতোই যেনো আহ্বান জানায়, ‘কে আছো জোয়ান হও আগুয়ান, হাকিছেঁ ভবিষ্যৎ…’। বাতাসের সঙ্গে মিশে যায় হাতগুলো, বাতাস থেকেই যেনো সুর বের করে আনে।

এবার যেনো সাগরের ঢেউ তীরে আছড়ে পড়ছিলো। এই জনগোষ্ঠীর ভাষা আমার বোধগম্য নয়। তবে সুরের মাঝে ‘আল্লাহ্’ এবং কিছু ইসলামিক শব্দ বলে দিচ্ছিলো এ পরিবেশনায় ধর্মের কথা রয়েছে। শরীরি ভঙ্গিমায় ইবাদতের ভাষা রয়েছে।

লিলিয়ানসহ দেশ বিদেশের গবেষকরা সামান নৃত্যকে অনেকভাবে আখ্যায়িত করেছেন। কেউ বলেছেন ধর্মের কথা আবার কেউ ভূতাত্ত্বিক বিশ্লেষণও করেছেন। তবে শরতে সবুজ ধান ক্ষেতের শীষ ধ্বনি পাচ্ছিলাম আমি। গায়োদের শরীরগুলো যেন সবুজ শিষের মতো বাতাসে দোল খাচ্ছিলো কখনো কখনো। প্রশান্তির বাতাস উত্তর থেকে দক্ষিণে বয়ে যাচ্ছিলো।

সুমাত্রার আচেহ প্রদেশের গায়ো জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি অংশ এই সামান নৃত্য। ২০১১ সালে সামানকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে চিহ্নিত করে ইউনেস্কো। ২০১৪ সালের ২৪ নভেম্বর বিশ্ব সামান দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং এদিন একই সঙ্গে ৫ হাজার ৫ জন সামান শিল্পী নৃত্য পরিবেশন করেন।

মেদান পাশারে এই দলটির নেতা সারির মাঝখানে বসেছিলেন। তিনি আয়াত আওড়ানোর মতোই সুরগুলোকে নেতৃত্ব দেন।

তালিতে তালিতে সৃষ্টি হয়ে উঠা সুর এক আধ্যাত্মিকতার পথ প্রদর্শন করে, কখনো বলে ধর্মের কথা, কখনো প্রেমের কথা অথবা রসাত্মক জীবনের কথা। ৩ শতাধিক দর্শককে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে এই আদিবাসী শিল্পীরা। তাদের আঙ্গুলের মোচড়ে আওয়াজ হয় এবং সুতার মতোই শরীর বাঁকাতে থাকে। তালের সঙ্গে তাদের শরীর ও মাথা আছড়ে পড়ে। সহশিল্পীর সঙ্গে তারা মিশে যায় অথবা সমর্থন দিতে থাকে তাদের ভঙ্গিমার। ঝাকড়া চুলের ঝাঁকুনিও যেনো সুরের মূর্চ্ছনা তৈরি করে।

গায়ো জনগোষ্ঠী সুন্নী মুসলিম। আচেহর মুসলিম ইতিহাসে এগারোশ’ শতকে অনেক আওলিয়ার উপস্থিতি ছিলো। তবে সামান শিল্পীদের শারীরিক ভঙ্গিমার সঙ্গে ভারতীয় উপমহাদেশের শিয়া মুসলিমদের তাজিয়া মিছিলের সঙ্গে কিছুটা হলেও মিল খুজেঁ পাই আমি। নেচে নেচে ‘হায় হোসেন’ বিলাপের সঙ্গে শরীরের বিভিন্ন অংশে আঘাত করা হয় তাজিয়া মিছিলে। আর সামান শিল্পীরা সুরের মূর্চ্ছনায় শরীরি ভঙ্গিমায় যেনো ইবাদত করেন আল্লাহর দরবারে।

তাদের শরীরের এ আন্দোলন গায়ো জনগোষ্ঠীর প্রাত্যহিক জীবন এবং তাদের স্বাভাবিক পরিবেশকেই ফুটিয়ে তোলে। বর্তমানে বিয়ের উৎসব, জাতীয় এবং ধর্মীয় দিনগুলো উদযাপনে সামান পরিবেশন করা হয়। গ্রামের একটি দলের সঙ্গে আরেকটির মেলবন্ধন তৈরি করে এই পরিবেশনা।

এশিয়া প্যাসিফিকে শাওয়ানে প্রকাশিত ‘সামান এর সন্ধানে’ প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, ইসলাম ধর্মাবলম্বী গায়ো জনগোষ্ঠী এ পরিবেশনার মাধ্যমে ধর্মের স্তুতি গায়। গায়োদের একজন ধর্মীয় গুরু শেখ সামানের নামানুসারেই আজকের সামান পরিবেশনা। তিনি এ পরিবেশনার মাধ্যমে বিশেষ দাওয়াত দিতেন এবং ইসলামের শিক্ষা প্রচার করতেন। তবে শুধু ইসলামের প্রচারই সামানের মূল বিষয় নয় বলে জানান তিনি।

মেদান পাশারে প্রায় ২০ মিনিট ধরে ১৫ জন গায়ো’র পরিবেশনায় যেন চোখের পলক ফেলতে পারছিল না উপস্থিত দর্শকরা।

সামান পরিবেশনার কিছু পরে বিদায় নিতে যাচ্ছিলেন শাও মান ইউ উইন মং। চোখাচোখি হয়। ছোট্ট শব্দে বললেন, ‘অবর্ণনীয় সুন্দর’।



বাংলাদেশ সময়: ১৩২৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১৫
এমএন/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

মালয়েশিয়া এর সর্বশেষ