ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মালয়েশিয়া

পরিচয় নির্ধারণে দীর্ঘসূত্রতা

বারবার পাচারের শিকার বাংলাদেশিরা

মাজেদুল নয়ন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮২৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ৮, ২০১৫
বারবার পাচারের শিকার বাংলাদেশিরা ছবি: বাংলানিউজেটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: মানবপাচারের শিকার হয়ে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার পথে বিভিন্ন দেশে উদ্ধার হওয়া বাংলাদেশিরা আবারো মানবপাচারের শিকার হচ্ছেন। মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে গত মে মাসে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশ থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও মায়ানমারে উদ্ধার হন কয়েক হাজার বাংলাদেশি।

দেশে ফিরিয়ে আনতে দীর্ঘসূত্রতার কারণেই  ফের পাচারের শিকার হচ্ছেন।
 
গত ৫ নভেম্বর ইন্দোনেশিয়ায় মেদান থেকে উদ্ধার করা হয় ৭ বাংলাদেশিকে। কুয়ান্তা পুলিশ ক্যাম্পে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের খবর নিশ্চিত করে। এরা সবাই লাংসা ক্যাম্প থেকে পাচারকারীদের শরণাপন্ন হয়ে মালয়েশিয়া পৌঁছানোর চেষ্টা করেছিলেন।
 
লাংসা ক্যাম্পে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই ক্যাম্প থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩৫ জন বাংলাদেশি মালয়েশিয়ার উদ্দেশে বিভিন্ন সময়ে পালিয়েছেন।
 
এদিকে গত ১৫ অক্টোবর মালয়েশিয়া পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল তান শ্রী খালিদ আবু বকর জানিয়েছেন, সেলানগর এবং নেগ্রি সেমবিলানে ২ মাস অভিযান চালিয়ে পাচারকারীসহ ৫০ জন বাংলাদেশিকে আটক করা হয়েছে। এদের মধ্যে ইন্দোনেশিয়ার আচেহ ক্যাম্প থেকে পলাতকরাও ছিলেন।
 
ইন্দোনেশিয়ার আচেহ ও মালয়েশিয়ার পাচারকারী সিন্ডিকেট সর্ম্পকে ক্যাম্পে অবস্থানরত বাংলাদেশিরা বাংলানিউজকে বলেন, এখানে বেশ কয়েকজন ফোন ব্যবহার করেন এবং পরিবারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করেন। পাচারকারীরা বিষয়টি জানতে পেরে তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ও আবারো ক্যাম্পে থাকা বাংলাদেশিদের মালয়েশিয়া পাঠানোর প্রস্তাব দেন।
 
ক্যাম্পের বাংলাদেশিরা বাংলানিউজের কাছে কক্সবাজার জেলার রামু উপজেলার মন্ডলপাড়ার আফসার নামে এক যুবকের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়েছেন। গত ৫ নভেম্বর ইন্দোনেশিয়ার মেদানে আটক হওয়া ৭ জনের মধ্যে আফসারও রয়েছেন।
 
ক্যাম্পে অবস্থানরতরা জানান, মালয়েশিয়া গমনেচ্ছুদের পরিবার রামুতে আফসারের বড় ভাইয়ের হাতে ১ থেকে ২ লাখ টাকা দিয়ে আসেন। এরপর আফসার তাদের মেদান হয়ে নিরাপদ কোনো জায়গায় পাচারকারীদের হাতে তুলে দিতেন। সেখান থেকে তাদের সাগর পথে নৌকা বা স্পিড বোটে মালয়েশিয়ার পৌঁছে দেওয়া হয়। আফসারের সঙ্গে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পাচারকারীদেরও যোগাযোগ রয়েছে।
 
মালয়েশিয়া পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল আবু বকরের ভাষ্যমতে, সেলানগর থেকে এই সিন্ডিকেটটি পরিচালিত হয় আর এটি বাংলাদেশ এবং ইন্দোনেশিয়ায় বিস্তৃত।
 
এদিকে দ্বিতীয়বারের মতো পাচার হওয়ার কারণ হিসেবে সরকারের প্রতিনিধিত্বকারীদের দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা। ৬ মাসেও নিজের দেশের মানুষদের চিহ্নিত করে নিয়ে আসতে ব্যর্থ হয়েছেন তারা। আর এ কারণেই বারবার মানবপাচারের শিকার হচ্ছেন মানুষগুলো।
 
আচেহ-তে অস্থায়ী ক্যাম্পে রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশিদের নিয়ে কাজ করছে বেসরকারি সংস্থা ইয়াইয়াসান গুতানিয়ো। সংস্থাটির আর্ন্তজাতিক পরিচালক লিলিয়ান ফ্যান বাংলানিউজকে বলেন, বাংলাদেশিদের দেশে প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি দেরি হওয়ার ফলে তারা এখন আঞ্চলিক মানবপাচারের প্রধান টার্গেটে পরিণত হচ্ছেন।
 
তিনি বলেন, আচেহতে এখন যেসব বাংলাদেশিরা রয়েছেন, তারা দেশে পরিবারের কাছে ফেরার জন্যে উন্মুখ হয়ে আছেন। আচেহ সরকার এবং মানুষেরা তাদের উদারভাবেই তাদের গ্রহণ করেছে। এখন বাংলাদেশ সরকারের দ্বায়িত্ব যারা পরিবার থেকে দূরে এখানে যন্ত্রণায় দিন কাটাচ্ছেন, তাদের দ্রুত দেশে ফিরিয়ে নেওয়া। বেশ কয়েকমাস হলো তারা পরিবার থেকে দূরে এবং দুচিন্তায় রয়েছেন।
 
মালয়েশিয়ায় অভিবাসী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা ক্যারাম এশিয়ার আঞ্চলিক সমন্বয়ক হারুন আল রশিদ বাংলানিউজকে বলেন, মে মাসের ওই ঘটনার পর মায়ানমার, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় এখনো বাংলাদেশিরা রয়েছেন। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় এই মানুষগুলোকে ফিরিয়ে আনতে এত দীর্ঘসূত্রতার কারণটা কী? রাষ্ট্রের যে প্রতিনিধিরা তথ্য দেশে পাঠাচ্ছেন, তাদের সমস্যা নাকি যখন তথ্য দেশে পাঠাচ্ছেন, সেখানে তদন্তে সমস্যা হচ্ছে? সেটা খুজেঁ বের করতে হবে। এই বিপর্যয় যখন ঘটেছিল, তখনই দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল।
 
হারুন আল রশিদ আরও বলেন, সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের নাগরিক যেখানেই যে অবস্থায় সমস্যায় পড়ে, তাকে দ্রুত রক্ষা করার দ্বায়িত্ব সরকারের। আটকে পড়া অভি‍বাসীদের বিষয়ে যারা রাষ্ট্রকে প্রতিনিধিত্ব করছেন তারা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন।
 
মালয়েশিয়া বা থাইল্যান্ডের পাচারকারীদের সঙ্গে এখনো বাংলাদেশের পাচারকারীদের যোগাযোগ রয়েছে। অথচ সরকার পাচারকারীদের এখনো আইনের আওতায় আনতে পারেনি- ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন হারুন আল রশিদ।
 
মানবাধিকার কর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক নূর খাঁন লিটন বাংলানিউজকে বলেন, রাষ্ট্র অন্য বিষয়গুলোকে যেমন গুরুত্ব দিয়েছে অভিবাসনে ইচ্ছুক এসব বাংলাদেশিদের বিভিন্ন দেশ থেকে ফিরিয়ে আনতে সরকারের আন্তরিকতা ততটুকু নেই। অথচ বিষয়টি স্পর্শকাতর।
 
ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, এই রাষ্ট্র অভিবাসন চায় তার রেমিট্যান্স বাড়াতে। কিন্তু যারা রেমিট্যান্স পাঠায় তাদের গুরুত্ব নেই, নাগরিকরা বিপদে পড়লে তাদের দ্বায়িত্ব নিয়ে গড়িমসি করে। বিভিন্ন দেশে আটকে পড়া এসব মানুষদের দ্রুত দেশে ফিরিয়ে না আনায় তারা আবারো পাচারের শিকার হচ্ছেন। এর দায় রাষ্ট্রের ওপরই বর্তায়।
 
বাংলাদেশে আর্ন্তজাতিক অভিবাসন সংস্থা, আইওএম এর মুখপাত্র অনিন্দ্য দত্ত বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের কাছে সরকারের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় কাগজ পাঠানোর পরপরই বিমানের টিকিট দিয়ে পাঠানোর ব্যবস্থা করি। তবে অনেক সময়ই ভেরিফিকেশনের কারণেই ফেরত পাঠাতে সময় লাগছে।
 
বর্তমানে ইন্দোনেশিয়ার আচেহ ক্যাম্পে রয়েছেন ৪৮ জন বাংলাদেশি। জাকার্তায় নিযুক্ত ঢাকার রাষ্ট্রদূত নাজমুল কাওনাইন শনিবার (০৭ নভেম্বর) বাংলানিউজকে বলেন, আমরা হাজারের ওপর মানুষকে ফেরত পাঠিয়েছি। ইন্দোনেশিয়া সরকার ও জনগণ আমাদের খুব সাহায্য করেছে।
 
তবে আগামী দিনগুলোতে এ ধরনের পাচারের ঘটনা যেন না ঘটে সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে বলেও মন্তব্য করে রাষ্ট্রদূত বলেন, আমরা এটা বন্ধ করতে না পারলে এই দেশের সরকারের সঙ্গেও বন্ধুত্বপূর্ণ সর্ম্পক হয়তো কিছুটা খারাপ হতে পারে।
 
বাংলাদেশ সময়: ০৭২৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৮, ২০১৫
এমএন/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

মালয়েশিয়া এর সর্বশেষ