ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মালয়েশিয়া

ভাগ্যাহত বাংলাদেশিদের ক্রীতদাস জীবন মালয়েশিয়ায়

জাকারিয়া মন্ডল, সিনিয়র আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৪৯ ঘণ্টা, মে ১৯, ২০১৬
ভাগ্যাহত বাংলাদেশিদের ক্রীতদাস জীবন মালয়েশিয়ায় ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

পুত্রাজায়া থেকে: নারী শ্রমিকদের লজ্জার বালাই নেই এখানে। যদিও নিষিদ্ধ পল্লী নয় এটা।

তবে ওদের বেশভূষা আর চলনে-বললে ওই কথাটাই বাড়ি খাবে মাথার ভেতর।

মাত্র কয়েক একরের সরু এক ফালি জায়গাটা টিন দিয়ে ঘেরা। লম্বা সরু রাস্তাটায় ছোট ছোট নুড়ি পাথরের বিছানা। দু’পাশে টিন-কাঠের ঘর। অধিকাংশই আবার দোতলা। কাঠের পাটাতনের খোলা ব্যালকনি প্রতিটি ঘরের সামনে। দোতলায় ওঠার জন্য সিঁড়ির বদলে মই সাঁটা দেওয়ালের গায়ে। নিত্য ব্যবহার‌ পোশাক ঝুলছে প্রতিটি ঘর থেকে।

ঘরের আড়ালে পড়া ছায়ায় বসেছে মদের আসর। শেষ মাথায় জুয়ার আসর ঘিরে দিনজমুরের জটলা। খোলা ডাস্টবিন থেকে ছড়িয়ে পড়া গন্ধ ভাসছে বাতাসে।

সরু ফটকের সামনে খোলা আকাশের নিচে রকমারি জিনিসের পসরা সাজানো। সাবান,শ্যাম্পু, কসমেটিকস, স্যান্ডেল-জুতা, টি শার্ট-প্যান্ট, পাতলা কম্বল সবই আছে এই ওপেন মার্কেটে। দরকষাকষি চলছে ক্রেতা-বিক্রেতার মাঝে। আগন্তুকদের দিকে উৎসুক দৃষ্টি সবার।

এখানকার অধিবাসীদের অধিকাংশই অবৈধ অভিবাসী। বাইরে যাওয়ার ঝুঁকি আছে। পুলিশ ধরলে নির্ঘাত জেল। বাধ্য হয়ে তাই স্বল্প পরিসর এই বসতিতেই থাকতে হয় তাদের। কেনাকাটাটাও করতে হয় ভেতর থেকেই। ভালো-মন্দের কোনো প্রশ্ন নেই। কেনাকাটা যে করা যায় তাই-ই সই।

নিচতলায় প্রতিটি ঘরের ভেতরে দু’পাশে পাটাতন দিয়ে অর্ধতলার শেপ দেওয়া হয়েছে। নিচের অংশে ঢুকতে হয় মাথা নিঁচু করে শরীর বাঁকিয়ে। পাটাতনের ওপরে চাল-ডাল, তরি-তরকারি আর রান্নার সরঞ্জাম।   ঘরের মাঝখানে লুঙ্গি-গামছা আর ভেজা কাপড় ঝুলছে। দরোজার পাশেই স্বল্প পরিসর অংশে রান্না ঘর। টয়লেট কমন জোনে।

এমনই এক ঘরের সামনে রেখে হাওয়া হয়ে গেলেন এক রোহিঙ্গা যুবক (সঙ্গত কারণেই নাম প্রকাশ করা হলো না)। ঘরের ভেতরে নিজেদেরই রান্না করা খাবার খাচ্ছেন জনা দুই বাংলাদেশি। বাড়ি তাদের শরীয়তপুরে। জানা গেলো, সম্পর্কে বাপ-ছেলে তারা। ঝোলে ডোবানো তেলাপিয়া মাছে খাওয়াটা শেষ করেছেন সবে। সামনে রেড বুল এনার্জি ড্রিস্কের ক্যান পড়ে আছে।

বাবা ছাত্তার (সঙ্গত কারণেই ছদ্মনাম)মালয়েশিয়ায় এসেছেন বছর তিনেক আগে। তিনিই সম্প্রতি নিয়ে এসেছেন ছেলে লিটনকে (ছদ্মনাম)। একটু বাদে জামান (ছদ্মনাম) নামে কক্সবাজারের এক যুবক এসে যোগ দিলো আড্ডায়।

কাছেই বহুতল এক ভবনের নির্মাণযজ্ঞে উদয়াস্ত খেটে দিনে ৫২ রিঙ্গিত (১ রিঙ্গিতে ২০ টাকা) পান ছাত্তার। ছেলে পায় তার চেয়ে ৪ টাকা কম। ৫২ রিঙ্গিত। দু’জনে মিলে যা আয় করেন তার প্রায় পুরোটাই পাঠিয়ে দেয় দেশে। নিজেদের জন্য থাকে কেবল ন্যুনতম খরচটুকু।

আর এজন্য কি পরিশ্রমটাই না করতে হয় তাদের। ছাত্তারের ভাষায়, অনেক কষ্ট এখানে। আর লিটনের বক্তব্য, যেমন রোদের তেজ, তেমনি কাজের কষ্ট। এখানকার মতো কষ্ট আর কোনো কাজে নেই।

তারা জানায়, এক দিনও ছুটি মেলে না মাসে। তাদের মতো আরো ৫/৬শ’ বাংলাদেশি আছে এই স্বল্প পরিসর বসতিতে। সব মিলিয়ে তারা এই টিনঘেরা বসতির অর্ধেক। বাকিরা ভিয়েতনামিজ, ইন্দোনেমীয়, পাকিস্তানি আর রোহিঙ্গা শ্রমিক। নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ভারতীয় আর নেপালীরা।

কেউ এসেছে স্টুডেন্ট ভিসায়। কেউবা ৩ মাসের ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে এসে থেকে গেছে। নৌকায় করেও জীবনের ঝুঁকি নিয়েও এখানে এসেছে অনেকে। কেউবা বহু ঘাট মাড়িয়ে আশ্রয়(!) নিয়েছে এখানে। তারপর পাসপোর্ট না থাকায় আটকে গেছেন ভাগ্যাহতদের এই চৌহদ্দির মধ্যে।

দু’তিন বছর এখানে থেকে তারা স্থানীয় ভাষাটা মোটামুটি শিখে যায়। বুঝে যায় কি করে চলতে হবে, পুলিশ ধরলে কি বলতে হবে। তারপর তারা বাইরে যায়।

তার আগ পর্যন্ত তাদের অবস্থা অনেকটা ক্রীতদাসের মতো। যেমন খুশি খাটিয়ে নেয় মালিক। ইচ্ছে হলে গালি দেয়। মনে চাইলেই মারধর করে। বেতনটা ঠিকমতো দেয় কি দেয় না। কিন্তু ভাগ্য বিড়ম্বিত এই মানুষগুলো অসহায়। পড়ে পড়ে মার খেতে খেতে স্বপ্নের জগতে বেঁচে থাকে তারা। নিজের শ্রমে-ঘামে তৈরি করে কোটিপতির অট্টালিকা।  

শ্রমিক অধিকার আর মানবাধিকারের স্বরূপ জানে না তারা। বোঝে না কি করে আইনি সহায়তাটা নিতে হয়।
নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কখনো কখনো হতে হয় যৌন হয়রানির শিকার।

একটু দূরে আর একটি শ্রমিক বসতিতে অবস্থা এখানকার মতো এতো খারাপ নয়। তবে ওখানেও মাসের পার মাস বেতন না পাওয়া শ্রমিক পাওয়া গেলো বেশ ক’জন। ২/৩ লাখ টাকা খরচ করে মালয়েশিয়ায় এসে দালালের খপ্পরে পড়ে ঠাই হয়েছে এখানে।

এতো কষ্টের ভেতরেও তবু দেশে ফেরায় অনীহা অনেকের। ধার-দেনা করে যারা এসেছেন তারা তো ধারের টাকা তোলার জন্যও থেকে যেতে যান সুদূর বিদেশে।

ভদ্রলোকদের প্রবেশ নিষেধ এখানে। ঝুঁকি আছে ছবি তোলায়। সুযোগ বুঝে তবু কিছু চিত্র ধরা গেলো মোবাইল ফোনের ক্যামেরায়। বোঝা গেলো, আইনের দেশ মালয়েশিয়ায় কি করে মার খাচ্ছে মানবতা।

জায়গাটা সাইবারজায়ার উপকণ্ঠে। মালটিমিডিয়া সুপার করিডোরের অংশ হিসেবে সেলানগর রাজ্যের সেপাং জেলায় এই সায়েন্স পার্কটি গড়ে তোলা হয়। ১৯৯৭ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ এই সায়েন্স পার্ক উদ্বোধন করেন। বিশ্বের সব বড় বড় সাইবার কোম্পানির অফিস আছে এখানে। বাসিন্দাদের অধিকাংশই বিদেশি।

পুত্রাজায়ার উত্তর পশ্চিমের এই শহরে এখনো ব্যাপক উন্নয়ন কাজ হচ্ছে। নির্মাণ হচ্ছে বহুতল ভবন। তাই প্রয়োজন পড়ছে শ্রমিকের। আর নির্মাণকাজের ঠিকা নেওয়া কোম্পানিগুলোর কাছে জিম্মি হয়ে পড়ছে পাসপোর্ট-ভিসাহীন শ্রমিকরা।

শ্রমিক অধিকার নিয়ে কাজ করা এনজিও মাইগ্র্যান্ট-৮৮ এর নির্বাহী পরিচালক আশিকুর রহমানের মতে, এটা আইনের দেশ। সব অধিকার রক্ষার জন্যই সুনির্দিষ্ট আইন আছে এখানে। কিন্তু ঠিকঠাক আইন না জানা থাকায় বিড়ন্বনার শিকার হচ্ছে ভাগ্য বিড়ম্বিত মানুষগুলো।

বাংলাদেশ সময়: ০৯৩৯ ঘণ্টা, মে ১৯, ২০১৬
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

মালয়েশিয়া এর সর্বশেষ