ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মালয়েশিয়া

মালয়েশিয়া থেকে জাকারিয়া মন্ডল

মালয়েশিয়ায় জেঁকে বসতে পারে বাংলাদেশ

জাকারিয়া মন্ডল, সিনিয়র আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৪৫ ঘণ্টা, মে ১৯, ২০১৬
মালয়েশিয়ায় জেঁকে বসতে পারে বাংলাদেশ ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

কুয়ালালামপুর থেকে: বাংলাদেশিদের জন্য ব্যবসা-বাণিজ্যের অবারিত সুযোগ আছে মালয়েশিয়ায়। কিন্তু সঠিক তথ্যের অভাবে পোড় খাওয়া বাংলাদেশিরা ওই পথ না মাড়িয়ে পিষ্ট হচ্ছে শ্রমিক জীবনের জাঁতাকলে।



অথচ চাইলেই ব্যবসা-বাণিজ্যে বিনিয়োগ করতে পারে বাংলাদেশিরা। ঝেড়ে ফেলেতে পারে সস্তা শ্রমিকের তকমা। আর তাদের সাহসী অভিযাত্রায় ভর করে বাংলাদেশ জেঁকে বসতে পারে মালেয়েশীয় অর্থনীতিতে।

বর্তমানে কেবল হোটেল, রেস্টুরেন্ট আর কনসালট্যান্সিতেই নিজেদের আটকে রেখেছে বাংলাদেশিরা। অথচ তাদের সামনে রয়েছে কোম্পানি খুলে আর সব দেশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বড় বড় ব্যবসার সুযোগ। উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে রিয়েল স্টেট নেগোশিয়েটিং, কৃষি খামার, বৃক্ষ চাষ, এমনকি কিয়স্কের মতো স্বল্পপুঁজির লাভজনক ব্যবসার সম্ভাবনাও।

এখানকার বাংলাদেশি উদ্যোক্তা হাফিজুর রহমানের মতে, মালয়েশিয়ার মতো কম খরচে বিশ্বের আর কোথাও ব্যবসা করা যায় না। সিঙ্গাপুরের ব্যবসা করতে হলে এখানকার তিন গুণ খরচ করতে হয়। এখানে ব্যবসার খরচ কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চেয়েও কম।

বর্তমানে বাংলাদেশেও একটা দোকান বা অফিস নিতে ১৫/২০ লাখ টাকা খরচ হয়। কিন্তু মালয়েশিয়ায় অফিস নেওয়া যায় লাখ টাকার মধ্যেই। কুয়ালালামপুরে কেন্দ্রে অফিস নিতে বড় জোর ৫ হাজার রিঙ্গিত খরচ হবে। আর একটু ভেতরের দিকে তো আরো কম।

এখানে এসডিএন, বিএইচডি (সেনডারিন বারহাত) বা প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির রেজিস্ট্রেশন নিতে খরচ হয় মাত্র ৩ হাজার রিঙ্গিত (১ রিঙ্গিতে ২০ টাকা)। এ টাকায় যে কেউ প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি খুলতে পারে। সঙ্গে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে ২ হাজার রিঙ্গিতে। ওটা মূলত জামানত। তুলে নেওয়া যাবে পরে।
 

একটি কোম্পানি খুললে করা যাবে তিন ধরনের বিজনেস। যেমন: আমদানি রপ্তানি, রিয়েল স্টেট নেগোশিয়েটিং ও স্টুডেন্ট কনসালটিং। এরপর আরো কোম্পানি করতে চাইলে শুধু শাখা বাড়ালেই হবে। করা যাবে কনসট্রাকশন আর প্ল্যানটেশন বিজনেসও।

অপর এক বাংলাদেশি ব্যবসায়ী বলেন, এখানে সুযোগ আছে রিয়েল এস্টেট নেগোশিয়েটর হিসেবে কাজ করার। ধরা যাক, কোনো কনডোমিনিয়ামে (ফ্ল্যাট কমপ্লেক্স) ১ হাজার ফ্ল্যাট। প্রতিটির ভাড়া দেড় হাজার রিঙ্গিত। আপনি যদি সেখানে তিন ফ্ল্যাটের ভাড়া ঠিক করে দিতে পারেন, তাহলে এক মাসের ভাড়া বা দেড় হাজার রিঙ্গিত পেয়ে যাবেন আপনি।

এ কাজে মাসে ৩০ হাজার রিঙ্গিত আয় করা কোনো কঠিন কাজ না। তবে এজন্য আগে কোম্পানি খুলে নিতে হবে আপনাকে। বাঙালিরা এখনো এ পেশাটা ধরতে পারেনি। আর এ পেশাতেই কোটিপতি বনে গেছে চায়নিজরা। বাংলাদেশিরা বরং তাদের হয়ে খাটছে।

আর মালয়েশিয়াতে বড় ধরনের বিনিয়োগ করতে হলে প্রয়োজন হবে ১ মিলিয়ন রিঙ্গিতের পেইড আপ ক্যাপিটাল এর কোম্পানি। এরপর ভিসা। এ টাকা বিনিয়োগ করলে অন্তত দু’জনকে পরিচালক হিসেবে আর দুই থেকে চারজনকে ম্যানেজার হিসেবে আনা যাবে মালয়েশিয়ায়। তবে সঙ্গে মালয়েশীয়দের নিলে ভালো। না নিলেও ঠেকবে না। স্থানীয়দের ৫১ শতাংশ শেয়ার দিলে সেটা হবে মালয়েশীয় কোম্পানি। আর তাদের শেয়ার ৫১ শতাংশের কম হলে হবে বিদেশি কোম্পানি।
 

শহরের বাইরে হাজার হাজার একর জমি লিজ নিয়ে করা যাবে কৃষিকাজ। ফলানো যাবে গাছ। চাষ করা যাবে মাছ। প্রথমে লোকাল পার্টনারকে সঙ্গে নিয়ে শুরু করে পরে জমি কিনেও ফেলা যাবে।

বিশাল বিশাল পতিত পুকুর আছে মালয়েশিয়ায়। এসব পুকুরে ইলিশের মতো সুসু, সার্ডিন, টুনা, কার্প জাতীয় মাছ, তেলাপিয়া, রুই-কাতলা চাষ হয়। এখানকার পাঙ্গাস বেশ সুস্বাদু। এখানে মাছের চাহিদা বেশি। অনেকেই মাছ চাষ করে কোটিপতি বনেছেন। সবচেয়ে বড় সুবিধা এখানে কারো সঙ্গে কারো শত্রুতা নেই। কেউ বিষ ঢালবে না আপনার পুকুরে।
আরো আছে কলা, আখ চাষসহ সব ধরনের শাক-সবজি আবাদের অবারিত সুযোগ। এখানকার মাটি এতো উবর্ব যে, মাত্র ১৫/২০ দিনেই শাক-সবজি বিক্রির উপযোগী হয়।
 

এখানে ১ হাজার রিঙ্গিতে এক একর জমি লিজ পাওয়া যায় ৮০ বছরের জন্য। এসব জমিতে ফলে পাম্প গাছসহ আম, জাম আর কাঁঠালের মতো ফল।

এসবের বাইরে আছে স্বল্প পুঁজির হোম স্টে ব্যবসা। এই ব্যবসাটা করতে পারে ছাত্ররাই। একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে ফার্নিশড করে পর্যটকদের ভাড়া দিয়ে মাসে ১০/১২ হাজার রিঙ্গিত কামানো ব্যাপার না। পেনাং, জোহর, মালাক্কায় এখন এমন ব্যবসার চল আছে।

মাত্র ৫ হাজার রিঙ্গিতে শুরু করা যায় কিয়স্ক বা ছোট খাবারের দোকান। এটাও কোম্পানি খুলে করতে পারে ছাত্ররা। কেবল ১ জন সেলসম্যান, একটা ছোট ফ্রিজ আর গোটা তিন ব্লেন্ডার বসানোর জায়গা হলেই হবে। কলা, আম, নারিকেল জুস বিক্রি হবে। মালয়েশিয়া গরমের দেশ। এখানে দিনে ৩শ’ গ্লাস জুস বিক্রি ব্যাপার না। এক গ্লাস ৩ টাকা হলে দিনে ৯শ’ রিঙ্গিত আয় হবে। তাহলে ছাত্রদের আর দিনে ১২/১৪ ঘণ্টা অন্যের কারখানায় খাটতে হবে না।

করা যাবে ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম বিজনেস। এটা হবে চেইন বিজনেস। এয়ারপোর্ট থেকে পিক করে নিজের হোটেলে থাকা ও খাওয়া এবং ভ্রমণ স্পটে নিতে হবে।

এখানে ৭৫ রিঙ্গিতে টি-শার্ট কিনলে ৩ মাসও টেকে না। বাংলাদেশ থেকে পোশাক এনে এখানে বিক্রি করা যাবে। সরকারের ট্যাক্স বেশি না। ইনকাম ট্যাক্স কম। তারওপর একটি কোম্পানির লাইসেন্সেই বের করা যাবে পত্রিকা। এখানে শুধু গার্মেন্টস সেক্টর বা এডুকেশন সেক্টর, কৃষি বা ব্যবসাভিত্তিক মাসিক ম্যাগাজিন বের করে বিজ্ঞাপন থেকে লাভ করা যায়।

এছাড়া আরো অনেক ক্রিয়েটিভ বিজনেস আছে মালয়েশিয়ায়। এখানে ওয়ার্কাররাও কোম্পানি খুলতে পারে। অনেকে কনসালট্যান্সি করে চায়নিজদের গাট ফুলিয়ে দিচ্ছে। ওই ব্যবসাটা নিজেরাই করতে পারে বাংলাদেশিরা। আর ব্যবসা করে এখানে স্থায়ী বসবাসের সুযোগ ও নাগরিকত্বের আবেদনও করার সুযোগ আছে।  

হোটেল মার্ক এর অপারেশন ম্যানজার নাহীদুল হক এর মতে, আমাদের বুঝাতে হবে যে বাংলাদেশিরা কেবল ওয়ার্কার নয়। মালয়েশিয়ার অর্থনীতিতে আমাদের করার অনেক কিছু আছে।

ইঞ্জিনিয়ার সাব্বির চৌধুরী বলেন, মালয়েশিয়াতে বাংলাদেশের অনেক সোনার ছেলে আছে। কিন্তু কিছু লোক দোকান খুলে, আদম বেপারি হয়ে বসে আছে। তাই বাংলাদেশিদের ইমেজ এখানে ভালো না। লেট'স থিংক আউট সাইড দি বক্স।

মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশিদের বিনিয়োগ ও ব্যবসার সম্ভাবনা সম্পর্কে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী, ওয়ার্ল্ড ওয়াইড মাইগ্রেশন কনসালট্যান্টস লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও চিফ কনসালট্যান্ট ড. শেখ সালাহউদ্দিন আহমেদ রাজু বলেন, বিজনেস রেসিডেন্স ভিসায় মাত্র পাঁচ বছরে স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি পাওয়া যাবে মালয়েশিয়ায়। আন্তর্জাতিক কোম্পানির অধীনে বিজনেস রেসিডেন্স ভিসা করলে কোনো মালয় নাগরিকের সুপারিশেরও প্রয়োজন হবে না। এমনকি অন্য কোনো সংস্থা থেকেও কোনো প্রত্যয়নপত্র (রিকমেন্ডেশন লেটার) প্রয়োজন হবে না। আর ব্যবসায়ী ভিসা নিলে মালয়েশিয়া থেকে পৃথিবীর ৭৩টি দেশে মাত্র ৩ শতাংশ ট্যাক্স দিয়ে রি-এক্সপোর্ট বিজনেস করা সম্ভব।

ড. রাজু জানান, আন্তর্জাতিক কোম্পানির অধীনে বিজনেস রেসিডেন্স ভিসা পেতে পূর্ণ জীবনবৃত্তান্ত ও বিজনেস প্রোফাইল তৈরি করে নিতে হবে। প্রয়োজন হবে পাসপোর্টের ফটোকপি, শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ, ব্যাংকের বিবৃতি, সাদা ব্যাকগ্রাউন্ডের চারটি পাসপোর্ট সাইজের ছবি আর স্থানীয় কমিশনার বা চেয়ারম্যানের কাছ থেকে চারিত্রিক সনদ।

সব কাগজ ঠিক থাকলে ৩০ থেকে ৪০ দিনের মধ্যেই পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা সম্ভব বলে জানান ড. রাজু।


***টিনঘেরা চৌহদ্দিতে ক্রীতদাস জীবন!
***লজ্জা নয় ওরা অহংকার
***মেডিকেল ট্যুরিজমের পালে হাওয়া মালয়েশিয়ায়
*** বাংলাদেশি পরিচয়েই যতো লজ্জা!
***এক ঋতুর দেশে
**বাংলাদেশি আবহে জাঁকিয়ে বসেছে হোটেল মার্ক
**অন টাইমে রিজেন্টে উড়ে মালয় দ্বীপে
**মালয়েশিয়া থেকে খবর দিচ্ছেন বাংলানিউজের জাকারিয়া মণ্ডল

বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৪ ঘণ্টা, মে ১৯, ২০১৬
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

মালয়েশিয়া এর সর্বশেষ