ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মালয়েশিয়া

নদী সঙ্গমে মসজিদ শহর

জাকারিয়া মন্ডল, সিনিয়র আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০০২ ঘণ্টা, মে ২১, ২০১৬
নদী সঙ্গমে মসজিদ শহর ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

কুয়ালালামপুর: বেদনায় নীল নয়, দূষণে কালচে ঘোলা রূপ নিয়েছে কুয়ালালামপুরে জন্মদাত্রী ক্ল্যাং-গমবাক। ডানে ড্রেনের মতো ওই সরু ধারাটাই কুয়ালালামপুরের প্রধান নদী ক্ল্যাং।

আর তার ১১ উপনদীর অন্যতম গবমাক হলো বাঁয়ের ওই ধারাটা।

এ নদীর মিলনস্থলেই ১৮৫৭ সালে পত্তন হয় ছোট্ট এক বাণিজ্য বসতির। আর সেটা হয় এক টিন খনি আবিষ্কারকে কেন্দ্র করে। খনি শ্রমিকদের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্যের চালান এই নদী পথেই আসতো ছোট-ছোট সাম্পান বেয়ে। ভাটির দিকে ক্ল্যাং নদীর মোহনা থেকে সেই সাম্পান বেয়ে এখানে আসতে অন্তত ৩ দিন তো লাগতোই।

সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বড় হতে থাকে ক্ল্যাং-গমবাক সঙ্গমের বাণিজ্য বসতি। সেই বসতি বড় হতে হতে রূপ নেয় আধুনিক কুয়ালালামপুর শহরে। মালয় ভাষায় এই কুয়ালালামপুর শব্দের অর্থ হলো-পঙ্কিল মোহনা। ধরে নেওয়া হয়, ক্ল্যাং থেকে উৎসারিত কুয়ালা’র সঙ্গে গবমাব এর অপর নাম সুনগাই লামপুরের শেষ অংশটি জুড়ে কুয়ালালামপুর নামটির জন্ম।

সেই পঙ্কিল নদী সঙ্গমেই ১৯০৯ সালে মুঘল স্থাপত্যরীতির অনুসরণে গড়ে তোলা হয় কুয়ালালামপুরের ইট নির্মিত প্রথম মসজিদ। তিন মুঘল গম্বুজের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তোলা হয় মিনার, ছোট ছেটা ছত্রী। সুদূর দক্ষিণ আমেরিকা থেকে রেইন ট্রি এনে বসানো হয় মসজিদ ঘিরে। উপনিবেশিক অতীতের শতবর্ষী সেই রেইন ট্রিগুলোকে সাক্ষী রেখে ছড়াতে থাকে শহর। কুয়ালালামপুর হয়ে ওঠে মেগাসিটি।

এখনো এ শহরের গুরুত্বপূর্ণ অধিকাংশ স্থাপনা এই মোহনা আর মসজিদকে কেন্দ্র করে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লেই পাওযা যাবে। মাত্র শ’ তিনেক মিটার ব্যসার্ধ ধরলে এর পশ্চিমে দাতারান মারদেকা বা স্বাধীনতা স্কয়ার, ১৮৮৪ সালে গড়ে ওঠা রয়াল সেলাঙ্গর ক্লাব, ১৮৮৯ সালে গড়ে ওঠা সিটি লাইব্রেরি, ১৮৯৪ সালে প্রতিষ্ঠিত সেন্ট ম্যারি’স ক্যাথিড্রাল, ১৮৯৪ থেকে ১৮৯৭ সালের মধ্যে গড়ে ওঠা সুলতান আব্দুস সামাজ বিল্ডিং, ১৮৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত পানগুং বান্দারায়া বা সিটি থিয়েটার, ১৮৯৮ সালে গড়ে ওঠা সিটি গ্যালারি,  ১৯০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত ন্যাশনাল টেক্সটাইল মিউজিয়াম ও ১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত ন্যাশনাল মিউজিক মিউজিয়াম।

পূর্ব দিকে, ১৮৭০ সালে প্রতিষ্ঠত কুয়ালালামপুরে প্রথম মার্কেট ওল্ড স্কয়ার, ১৯৩৭ সালে প্রতিষ্ঠিত ক্লক টাওয়ার, ১৮৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত ডাব বিল্ডিংসহ আরো অনেক পুরনো স্থাপনা।

এছাড়া উত্তরে এলআরটি স্টেশন, রাস্তা পার হলেই লিটল ইন্ডিয়া, জিন মসজিদ। উত্তর-পশ্চিমে ব্যাংক নিগারা বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক, দেওয়ান ভান্ডারায় বা সিটি করপোরেশন। লাদেশি অধ্যুষিত কোতারায়ার অবস্থান এই মসজিদ মোহনার পূর্ব দিকে। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা ৯৬.৪ মিটার।

২৫ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকের উঁচু ভূমি কুয়ালা সালেহ থেকে উৎপন্ন হয়ে ১২০ কিলোমিটার পথ পাড় দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমে মালাক্কা প্রণালীতে পড়েছে ক্ল্যাং। এর অববাহিকার আয়তন ১২৮৮ বর্গ কিলোমিটার। যা ক্ল্যাং উপত্যকা হিসেবেও পরিচিত। কুয়ালালমপুর মূলত এই ক্ল্যাং উপত্যকারই শহর।

গমবাক এসে মেশার পর দক্ষিণে পেটালিঙ জায়া পেরিয়ে সেলাঙ্গরের রাজধানী শাহ আলমের ভেতর দিয়ে এটি পতিত হয়েছে মালাক্কা প্রণালী। এ নদীরটি নিচের দিকে ক্ল্যাং শহর। দেশের বৃহত্তম সমুদ্র বন্দরও এ নদীরই মোহনায়। উজানের অংশে বাতু বাঁধ ও ক্ল্যাং গেট বন্যা উপশমে কাজে লাগে।

সরেজমিনে দেখা গেলো, ক্ল্যাং এর সরু ধারায় দূষণের স্পষ্ট থাবা। উজানের দিকে এর ওপর নির্মিত হয়েছে এলআরটি স্টেশন। তার নিচ দয়ে মন্থর গতিতে ঘোলা স্রোত বইছে। আরো উজানে ক্ল্যাং এর ময়লাপানি ঘিরেই খেলছে এক ঝাঁক কবুতর। নদীর কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা একটি গাছ তো পুরোটাই কবুতরে ছেয়ে আছে। পাড়ের বিভিন্ন স্থানে ফুলের উপস্থিতি নজর কাড়ে।      

কুয়ালালামপুর আর সেলাঙ্গর চিরে প্রবাহিত ক্ল্যাং কিন্তু মালয়েশিয়ার সবচেয়ে বেশি মানব ব্যবহ্রত নদী। দেশটিতে সবচেয়ে বেশি উ্ন্নয়নে ছোঁড়ও পড়েছে এ নদী পাড়েই। উন্নয়নের দাপটে ক্ল্যাং পরিণত হয়েছে সরু নালায়। পানি হয়ে পড়েছে সরু, দুষিত।

অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে তাই এ নদী আকস্মিক বন্যার কারণ হয়। বন্যা নিয়ন্ত্রণে এ নদী সংলগ্ন তীর ভূমিতে তাই জরুরি নিষ্কাষণ নালা তৈরি করা হয়েছে।

২০১০ সালে সেলাঙ্গরের তোলা এক উদ্দীপক বিলে এ নদীর অবস্থা চিহ্নিত করা হয় ‘মধ্য ও খারাপ’ এর মধ্যবর্তী অবস্থা হিসেবে।

আর বর্তমানে লাইফ প্রজেক্টের আওতায় এ নদীর সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ চলছে। গৃহীত পরিকল্পনায় রয়েছে নদী পরিচ্ছন্নকরণ, সুপেয় পানির উৎস সৃষ্টি, পরিবেশ সংরক্ষণ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, বাণিজ্যিক পর্যটন ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড। ১৫ বিলিয়ন ডলারে (১ ডলার ৮০ টাকা) করা হয়েছে ১৫ বছর মেযাদী পরিকল্পনা।     

ক্যাং তীরে গড়ে ওঠা কুয়ালালামপুরের আয়তন ২৪২ বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যা প্রায় ৮০ লাখ। এটি মালয়েশিয়ার তিনটি ফেডারেল টেরিটরির অন্যতম। কার্যত এটি সেলানগর রাজ্যের একটি ছিটমহল। ফেডারেল সরকারের নির্বাহী ও বিচার বিভাগের শাখাগুলো এক সময় এ শহরেই ছিলো। ১৯৯৯ সালে সেগুলো পুত্রাজায়ায় স্থান্তান্তর করা হয়। তবে এখনো কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও সরকারি অফিস কুয়ালালামপুরে রয়েছে গেছে। বিশ্ব শহর সূচকে এর অবস্থান ৪৮। এখনো এ শহর অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও সংস্কৃতির প্রধান কেন্দ্র।

১৮৮৬ সালে রেল লাইন স্থাপনের পর এ শহরের জনসংখ্যার দ্রুত বিস্তার হতে থাকে। ১৮৮৪ সালের সাড়ে চার হাজার জনসংখ্যা ১৮৯০ সালে ২০ হাজারে পৌছে যায়। ওই বছরেরই মে মাসে গঠিত হয় স্যানিটারি বোর্ড। যেটাকে কুয়ালালামপুরের প্রথম মিউনিসিপ্যাল কাউন্সিল হিসেব বিবেচনা করা হয়।

১৮৯৫ সালে কুয়ালালামপুর ছিলো মাত্র .৬৫ বর্গকিলোমিটারের শহর। ১৯০৩ সালে আর আয়তন বেড়ে দাঁড়ায় ২০ বর্গকিলোমিটারে। ১৯৪৮ সালে আয়তন হয় ৯৩ বর্গকিলোমিটার। ১৯৭৪ সালে ফেডারেল টেরিটোরি হিসেবে আয়তন বেড়ে হয় ২৪৩ বর্গকিলোমিটার।
১৮৯৮ সালে কুয়ালালামপুরকে নবগঠিত ফেডারেটেড রাজ্যের রাজধানী করা হয়। শহরের বিভিন্ন স্থানে বসতি স্থাপন করে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ১৯৪২ সালের ১১ জানুয়ারি কুয়ালালামপুর দখলে নেয় জাপানিরা। ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত তারা শহর দখলে রাখে। সে সময় কুয়ালালামপুরের টিন ও রাবার শিল্প ধ্বংস হয়ে যায়। দেখা দেয় জরুরি অবস্থা। চিনা ও মালয়ের মধ্যে দেখা দেয় কমিউনিটি বিদ্রোহ। ১৯৫৭ সালে মালয় ফেডারেশন স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৬৩ সালে ১৬ সেপ্টেম্বর মালয়েশিয়া গঠন হলে কুয়ালালামপুরে রাজধানী থেকে যায়। ১৯৭৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি কুয়ালালামপুর হয় ফেডারেল টেরিটোরি।

দেশে ফিরলেই বেকার, বিদেশের অভিজ্ঞতা বিফলে

***মালয়েশিয়ায় জেঁকে বসতে পারে বাংলাদেশ
***টিনঘেরা চৌহদ্দিতে ক্রীতদাস জীবন!
***লজ্জা নয় ওরা অহংকার
***মেডিকেল ট্যুরিজমের পালে হাওয়া মালয়েশিয়ায়
*** বাংলাদেশি পরিচয়েই যতো লজ্জা!
***এক ঋতুর দেশে
**বাংলাদেশি আবহে জাঁকিয়ে বসেছে হোটেল মার্ক
**অন টাইমে রিজেন্টে উড়ে মালয় দ্বীপে
**মালয়েশিয়া থেকে খবর দিচ্ছেন বাংলানিউজের জাকারিয়া মণ্ডল

বাংলাদেশ সময়: ০৯৫৮ ঘণ্টা, মে ২১, ২০১৬
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

মালয়েশিয়া এর সর্বশেষ