ঢাকা, বুধবার, ১৪ কার্তিক ১৪৩১, ৩০ অক্টোবর ২০২৪, ২৬ রবিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

খুলনায় চিকিৎসকদের কর্মবিরতির নেপথ্য কাহিনী

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৪৬ ঘণ্টা, মার্চ ১, ২০২৩
খুলনায় চিকিৎসকদের কর্মবিরতির নেপথ্য কাহিনী

খুলনা: খুলনার সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতাল-ক্লিনিকে চিকিৎসকদের পূর্ণদিবস কর্মবিরতি চলছে। এতে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা পড়েছেন চরম ভোগান্তিতে।

বুধবার (১ মার্চ) সকাল ৬টা থেকে শুরু হওয়া এই কর্মবিরতি চলবে বৃহস্পতিবার (২ মার্চ) সকাল ৬টা পর্যন্ত। তবে খোলা থাকবে জরুরি বিভাগ।

শহীদ শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালের প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. শেখ নিশাত আব্দুল্লাহর ওপর হামলার প্রতিবাদে চিকিৎসকরা এই কর্মসূচির পালন করছেন।

এর আগে মঙ্গলবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) খুলনা শাখা সংবাদ সম্মেলনের এই কর্মবিরতি ঘোষণা করে।

খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নড়াইলের কালিয়া থেকে চিকিৎসা নিতে আসা আজিজুল বলেন, এত দূর থেকে এসেও চিকিৎসা পাচ্ছি না। শরীরটা ভীষণ ভারাপ। সারা শরীরে জ্বালা পোড়া। আসা যাওয়ায় প্রায় ৫ শ টাকা খরচ হলেও চিকিৎসা নিতে পারলাম না।

রূপসা থেকে আসা শাহানারা বলেন, হাত ভেঙে গেছে। এক্স-রে করার জন্য এসেছি। কিন্তু এসে দেখি ডাক্তাররা কর্মবিরতি পালন করছেন।  

যদিও যাদের বিরুদ্ধে চিকিৎসক নিশাতের ওপর হামলার অভিযোগ উঠেছে তাদের কাছে জানা যায় ভিন্ন ঘটনা। ওই চিকিৎসক তার কাছে চিকিৎসা নিতে আসা এক শিশুর মাকে কু প্রস্তাব দেওয়ায় তিনি রাজি না হওয়ায় শিশুর অপচিকিৎসা করেন। এতে ওই শিশু বাম হাতের একটি আঙুল হারায়।

বিএমএর সংবাদ সম্মেলনের পর ঘটনার তথ্যানুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা যায়, অথৈ নামের ছয় বছরের আগুনে পোড়া মেয়েটি প্রথমে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (খুমেক) বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে ভর্তি ছিল। সেখান থেকে সুস্থ হয়ে বাম হাতের কয়েকটি আঙুল জোড়া লেগে যাওয়ায় তার চিকিৎসার জন্য শহীদ শেখ আবু নাসের হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানেই দেখানো হয় ডা. নিশাত আব্দুল্লাহকে। কিন্তু সরকারি হাসপাতালে অপারেশন করে আঙুল ছাড়াতে অনেক সময় লাগবে এমনটি বলা হলে ওই ডাক্তারের পরামর্শেই তাকে ভর্তি করানো হয় হক নার্সিং হোমে। সেখানে জানুয়ারির মাঝামাঝি তার অপারেশন করে ছেড়ে দেওয়া হলেও মেয়েটির মায়ের সঙ্গে প্রায়ই হোয়াটসঅ্যাপে এসএমএস দেওয়া-নেওয়া হচ্ছিল। হক নার্সিং হোমে অপারেশন হলেও কয়েকবার তার ড্রেসিং করা হয় শহীদ শেখ আবু নাসের হাসপাতালে। এরপর কয়েক দফায় মেয়ের মাকে একা চেম্বারে ডাকা হলেও তিনি না গিয়ে এক পর্যায়ে তার স্বামীকে বিষয়টি জানান। তার স্বামী যেহেতু সাতক্ষীরায় কর্মরত সেহেতু তিনি যথা সময়ে আসতে না পেরে মেয়েকে নিয়ে স্ত্রীকে আবারো ডাক্তারের কাছে যেতে বলেন। এক পর্যায়ে ঘটনার দিন গত ২৫ ফেব্রুয়ারি রোগীর হাতের একটি আঙুল ব্যান্ডেজের মধ্য দিয়ে পড়ে যাওয়ায় ওই অবস্থায় রোগী নিয়ে তার মা হক নার্সিং হোমে যান। সেখানে ডা. নিশাত আব্দুল্লাহ অপারেশন করায় ঘণ্টা খানেক অপেক্ষার পর বের হলে তাকে বিষয়টি জানানো হয়। এরপর তাকে ওটিতে নেওয়ার পর বিভিন্ন মন্তব্য করায় রোগীর মা ৯৯৯ এ কল করে পুলিশ আনেন।

রোগী অথৈ-এর মা নুসরাত আরা বলেন, ২০২২ সালের ২১ সেপ্টেম্বর আমরা প্রথম আবু নাসের হাসপাতালের ডা. নিশাত আব্দুল্লাহের কাছে আমার মেয়ের চিকিৎসার জন্য যাই। উনি আমাদের দেখে দ্বিতীয় ফলোআপ দেন ২৭ সেপ্টেম্বর। তিনি বলেন, বাবুর হাতে সার্জারি লাগবে। কিন্তু তিনি অনেক দিন ঘোরান। তারপর আমাদের বলেন, আপনারা যদি হক নার্সিং হোমে অপারেশনটা করান তাহলে খুব ভালো হবে। আমি তাকে বলি, আমাদের আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো না। পরে অনেক কষ্ট করে টাকা ম্যানেজ করে ওই হাসপাতালে যাই। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের ১৭ তারিখ ওখানে যাই। ১৮ তারিখে অপারেশন করি। আমাদের বলে, অপারেশন করতে চার ঘণ্টা লাগবে কিন্তু সাড়ে ৫ ঘণ্টা লাগায়। ওটি রুমের মধ্যে ৫-৬ বার ওষুধ আনতে বলেন। ওই দিন থেকে বাচ্চার আঙুল কালো হয়ে যায়। আমরা ১৯ তারিখ তা ডাক্তারকে জানাই। ডাক্তার জানান, প্রতি ২ ঘণ্টার পর পর আঙুলের ছবি তুলে তার (ডাক্তার) হোয়াটসআপে পাঠাতে। ডাক্তার পরে বাচ্চার বিষয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে বলেন। আমি দেখা করি না। এরপর ওনি অনেক মেসেজ পাঠান। যেগুলো আমার কাছে ভালো লাগেনি। তিনি আমার সঙ্গে আলাদাভাবে সময় কাটাতে চান। তাই বাচ্চারে রিলিজ নিয়ে চলে আসি। এরপর একদিন ড্রেসিং করাতে গেলে মেয়েকে ওটির মধ্যে রেখে আমাকে চেম্বারে দেখা করতে বলেন। সেখানে গেলে আমার শরীরে স্পর্শ করেন। বাজে কিছু কথা বলেন। যখন সেটা বুঝতে পারি তখন দ্রুত চলে আসি। এরপর আমার বাচ্চার ড্রেসিং করতে গিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে তাকে ব্যথা দেয়। বাচ্চা চিৎকার করলে বলে কতো পারিস চিৎকার কর তোর মা তোর কান্না পছন্দ করে। আমি তখন বাচ্চাকে ছাড়িয়ে নিয়ে এসে আমার স্বামীকে সব খুলে বলি। এরপর তিনি আমাকে আবার এসএমএস করেন যে তার ভুল হয়ে গেছে। ৬ তারিখ থেকে ২৩ তারিখ পর্যন্ত বাচ্চার ড্রেসিং করাই ডাক্তারের কাছে। আমার মনে হয় আমি উনার কথায় রাজি না হওয়ায় আমার বাচ্চার ভুল চিকিৎসায় তার আঙুল হারিয়ে ফেললাম। আমার স্বামীকে বলার পর তিনি এসে ডা. নিশাত আবদুল্লাহকে বাচ্চার বাম হাতের আঙুল পড়ে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে তার ওপর হামলা করেন। ৯৯৯ এ ফোন করার পাশাপাশি আমি সোনাডাঙ্গা থানার ওসিকেও বিষয়টি জানানোর পর সেখান থেকেও পুলিশ আসে। এরপর তিনি তার স্বামীকে জানানোর পর তিনি ডিউটিরত থাকায় ছুটি নিয়ে পোশাক পরিহিত অবস্থায় ঘটনাস্থলে এলে শুধু কথা কাটাকাটি হয়। পরে পুলিশের উপস্থিতিতেই ঘটনাটি সেখানেই মীমাংসা হয়। যেখানে আমার মেয়ের অঙ্গহানির জন্য আমরা মামলা করবো সেখানে উল্টো আমাদেরই আজ ভিকটিম হতে হচ্ছে। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। আমাদের ওপর হামলা করে ডা. নিশাত এখন নিজেকে বাঁচাতে নতুন নাটক শুরু করেছেন।

ডা. শেখ নিশাত আব্দুল্লাহর মোবাইলে একাধিকবার কল করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়।

বিএমএ সভাপতি ডা. শেখ বাহারুল আলম জানান, গত ২৫ ফেব্রুয়ারি নগরীর শেখপাড়া এলাকার হক নার্সিং হোমের অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে পুলিশের এএসআই নাঈম ও তার সঙ্গীরা ডা. শেখ নিশাত আবদুল্লাহকে মারধর করেন। এছাড়া অপারেশন থিয়েটারে ভাংচুর চালায় তারা। এক মাস আগে অপারেশন করা রোগীর জটিলতার কথা বলে তারা এই হামলা চালায়। ডা. নিশাত বর্তমানে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এ ঘটনায় তিনি বাদী হয়ে গত মঙ্গলবার সোনাডাঙ্গা থানায় মামলা দায়ের করেন। তবে এ মামলায় এখনও কেউ গ্রেফতার হয়নি।

তিনি বলেন, মামলা হয়েছে, আসামি গ্রেফতার হলে আমরা কর্মসূচি প্রত্যাহার করবো।  

অথৈয়ের মাকে ডা. নিশাত কর্তৃক শ্লীলতাহানির যে অভিযোগ উঠেছে সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা আমি সংবাদিকদের মাধ্যমে শুনেছি। নৈতিক স্খলনের জন্য বিএমএ দায়ি নয়। আমরা শুধু চিকিৎসকের ওপর হামলা হয়েছে সে বিষয়ে আন্দোলন করছি।

বাংলাদেশ সময়: ১২৪৫ ঘণ্টা, মার্চ ০১ , ২০২৩
এমআরএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।