ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়েই আইসিইউতে ফারিহা

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০১৪ ঘণ্টা, মার্চ ১৪, ২০২৩
মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়েই আইসিইউতে ফারিহা

রাজশাহী: হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা সেই মেয়েটিই এবার সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন।  আর জীবনের এই সুবর্ণ সুযোগ পেয়েই ছুটে গেছেন আইসিইউতে।

তবে এবার চিকিৎসার জন্য নয়। জীবনসংকটে সেবা দেওয়া সেই চিকিৎসককে শ্রদ্ধা জানাতে। তিনি হলেন ফারিহা আফরিন। তার বাড়ি রাজশাহীর বুলনপুর এলাকায়।

নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় মেঝেতে পড়ে গিয়ে প্যারালাইজড হয়ে গিয়েছিলেন এই ফারিহা। পরে শ্রুতলেখকের মাধ্যমে দেন পরীক্ষা। তারপর শুরু হয় শ্বাসকষ্ট। এরপর টানা এক মাস রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিউতে ভর্তির পর ছিলেন ভেন্টিলেশনে। তাই সংকটাপন্ন মেয়ের বাঁচার আশাই ছেড়ে দিয়েছন বাবা-মা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মৃত্যুদুয়ার থেকে ফেরেন ফারিহা আফরিন। এরপর টানা দুই মাস ফিজিওথেরাপি নিতে হয় তাকে। আর একটু সুস্থ হতেই ফেরেন পড়ার টেবিলেও।

সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়ে সোমবার দুপুরে মাকে সঙ্গে নিয়ে চলে যান রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউর ইনচার্জ ডা. আবু হেনা মোস্তফা কামালের কাছে। সাথে নিয়ে যান মিষ্টিও। আর তাকে দেখেই হতবাক যান আইসিইউ ইনচার্জ।

প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরে জানতে পারেন, গত চার বছর আগে এই মেয়েটিই আইসিইউ ভেন্টিলেশনে ছিলেন এক মাস। যেখানে প্রতিদিন মনে হতো আজই হয়তো তার শেষ দিন।

তাই হঠাৎ করে তাকে দেখতে পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন আইসিইউ ইনচার্জ ডা. আবু হেনা মোস্তফা কামাল।

কথাবার্তা শেষে তিনি বলেন, ‘সব রোগীকেই তারা এমন সেবা দেন। এভাবেই যত্ন নেন। এরপরও কেউ কেউ মারা যান। আবার কেউ সুস্থ হয়ে ফেরেন নিজের বাড়িতে। কিন্তু কেউই চিকিৎসকদের মনে রাখেন না। তার এই দেখা করার বিষয়টি এজন্য মনটাকে ছুঁয়ে গেছে।

এদিকে ফারিহা জানান, অতীতে তিনি ছিলেন আরও অসুস্থ। আর তার ভয়াবহতাও ছিল বেশি। কারণ নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় তার হয়েছিল ভাইরাসজনিত রোগ জিবিএস। তিনি তখন বার্ষিক পরীক্ষা দিচ্ছিলেন। প্রথম দিকে তার একটি হাত প্যারালাইজড হয়ে যায়। লিখতে পারছিলেন না। তবে এরপরও স্কুলে পরীক্ষা দিতে যান। ওই দিন তিনি আবার বাথরুমে পড়ে যান। সেবার তার পা প্যারালাইজড হয়ে গেল। তবু তিনি পরীক্ষা দিতে চান। শেষ পর্যন্ত তার অদম্য ইচ্ছে শক্তি দেখে স্কুল শিক্ষকরা সপ্তম শ্রেণির একটি মেয়েকে শ্রুতলেখক হিসেবে নিয়ে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেন।

প্রশ্ন দেখে ফারিহা মুখে বলেন আর ওই মেয়েটি তা হুবহু খাতায় লিখে দেয়। কিন্তু যুদ্ধ এখানেই শেষ নয়। পরীক্ষার মধ্যেই শুরু ফারিহার শ্বাসকষ্ট।

তখন মুখের কথাও হারিয়ে যায় তার। যে কারণে পদার্থবিজ্ঞান পরীক্ষাটাও আর দেওয়া হয়নি তার। এবার তীব্র শ্বাসকষ্ট নিয়ে ফারিহাকে ভর্তি করানো হলো রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সারাদিন তিনি ক্যাজুয়ালিটি বিভাগে পড়ে থাকেন। কোনো চিকিৎসক না থাকায় তাকে পরে রাজশাহীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানকার নিউরোলজি বিভাগের চিকিৎসকের পরামর্শে তাকে আইসিউতে ভর্তি করা হলো। তিনি তখন হয়ে গিয়েছিলেন মৃত মানুষের মতোই। চোখের পাতাটিও নাড়াতে পারতেন না। পরে শয্যা ফাঁকা হওয়ায় তাকে ফের রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। সেখানেই টানা এক মাস ভেন্টিলেশনে ছিলেন ফারিহা।

এর পরের গল্পটা তার ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়ার, ফিজিওথেরাপি নেওয়ার। আর নতুন জীবন পেয়ে একটু সুস্থ হয়েই তিনি ফেরেন চিরচেনা চির আপন সেই পড়ার টেবিলে। বহু চড়াই উৎরাইর পর অদম্য ইচ্ছাশক্তি, মেধা ও শ্রম দিয়ে কয়েক ধাপ পেরিয়ে এবার তিনি পেলেন মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ।

এমন সাফল্যে তাই প্রশংসায় ভাসছেন ফারিহা। আর মেয়ের সাফল্যে গর্বে মাথা উঁচু হয়ে গেছে বাবা-মায়ের। অসুস্থ ফারিহা এখন আশাজাগানিয়া হয়ে উঠেছে এই পুরো পরিবারের কাছে।

২০২০ সালে রাজশাহীর সরকারি পিএন সরকারি বালিকা বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও ২০২২ সালে মহাগরীর কাশিয়াডাঙ্গা কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দেয়েছেন ফারিহা। এবার সুযোগ পেয়েছেন সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে ভর্তির।  

আর তাই শ্রদ্ধা ও আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাতেই গিয়েছিলেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউ ইনচার্জ ডা. আবু হেনা মোস্তফা কামালের কাছে। তার অবদানের কথা কোনো দিনই ভুলতে পারবেন না বলে উল্লেখ করে মেধাবী শিক্ষার্থী ফারিহা আফরিন।

ফারিহারা দুই ভাই-বোন। বড় ভাই রাজশাহী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যায়ে পড়েন। মা লায়লা আঞ্জুমান একটি কলেজের প্রদর্শক। আর তার বাবা মো. আনোয়ার হোসেন কৃষিভিত্তিক একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক।

বাংলাদেশ সময়: ২০১৫ ঘণ্টা, মার্চ ১৪, ২০২৩
এসএস/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।