গোপালগঞ্জ থেকে: গন্তব্য সাতক্ষীরা। বেশ সকালে যখন যাত্রা শুরু হলো তখনও নগরের রাতজাগা মানুষের ঘুম ভাঙেনি।
বঙ্গবন্ধু এক্সপ্রেসওয়ে আর স্বপ্নের পদ্মা সেতু পেরিয়ে সকাল ৯টা নাগাদ আমরা গোপালগঞ্জে। ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে হিরণ্যকান্দিতে অবস্থিত সাম্পান হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে দেওয়া হলো যাত্রা বিরতি। সকালের নাশতা এখানেই। গাড়ি থেকে নামতেই চোখে পড়লো বৃহদাকার সবুজ সাইনবোর্ড। তাতে দিক নির্দেশক চিহ্নসহ সাদা কালিতে লেখা- ‘শতবর্ষী আমগাছ’!
আগ্রহ নিয়েই দেখলাম সেদিকে। মতিগতি বুঝে ট্যুরের টিম লিডার আলভি হোসাইন ভাই জানিয়ে দিলেন- আমাদের দ্বিতীয় গাড়িটা ১৫ মিনিট লেট আছে। তাই আমার হাতে সময় সর্বোচ্চ ওই ১৫ মিনিট।
স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে, রাস্তা পার হয়ে এগোলাম সেদিকে। হাঁটা পথে ৫ মিনিট এগোতেই দেখা মিললো অতিকায় প্রাচীন গাছটির। সত্যিই, বিশালকার গাছটির বিশালতা দেখার মতো।
গাছের নয়টি কাণ্ড বটগাছের কাণ্ডের মতো যেন দাঁড়িয়ে আছে মাটি ছুঁয়ে। গাছের নিচে অন্য কোনো গাছ বা আগাছা নেই। একটু দূর থেকে দেখলে মনে হয় সবুজ রঙের একটি টিলা দাঁড়িয়ে আছে। আর আমের মুকুলের এ সময়ে ছোট ছোট আমে ভরপুর হয়ে রয়েছে পুরো গাছটি। সব মিলিয়ে সকালের মিষ্টি আলোয় এক নয়নাভিরাম দৃশ্য।
আমগাছটির বয়স নিয়ে এলাকার মানুষের মধ্যে নানা মত। কেউ বলেন, এর বয়স ১০০ এর বেশি। কেউ বলে দেড়শ’। আবার অনেকেই আছেন, বয়স বাড়িয়ে দুইশ’র ঘরে নিতে দ্বিতীয়বার ভাবেন না। তবে যত মতভিন্নতাই থাকুক না কেন, শতবর্ষের নিচে বয়স নামাতে চান না কেউই। আর কেনই বা নামাবেন? বিশালকায় চেহারা নিয়ে প্রায় দুই বিঘা জমিতে ছড়িয়ে আছে যে গাছ, তাকে অন্তত শতবর্ষী না বলে উপায় থাকে না। সেদিক থেকে গাছটির পরিচয় তাই শতবর্ষী গাছ।
ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে হিরণ্যকান্দি বাসস্ট্যান্ডে নেমে পূর্ব দিকে ইট বিছানো সড়ক দিয়ে আনুমানিক ৩০০ গজ এগোলেই দেখা মিলবে এ গাছের।
৫৪ শতাংশ জমির ওপর রয়েছে অতিকায় এ প্রাচীন গাছটি। হিরণ্যকান্দি গ্রামের বাচ্চু শেখ ও তার দুই ভাইয়ের ৫৭ শতাংশ জমির ওপর শতবর্ষী এ আম গাছটি দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে। শেখ পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, দেশি প্রজাতির এ আমগাছটি তাদের পূর্বপুরুষের কেউ রোপণ করেছেন। কে করেছেন তা জানা নেই। তবে তাদের বাবা-দাদাও এ আকারেই দেখেছেন গাছটি।
স্থানীয় বাসিন্দা রুহুল আমিন বলেন, গাছটি দেখতে প্রতিদিনই অসংখ্য লোক এখানে ভিড় করেন। প্রতিদিন অসংখ্য দর্শনার্থীরা এ আম গাছ দেখতে আসে। বছরে একবার করে মেলাও হয় এখানে। এটা আমাদের জন্য অনেক আনন্দের যে, আমাদের গ্রামে এমন একটি গাছ আছে, যেটি দেখতে দূরদূরান্ত থেকে লোকজন ছুটে আসে। আর ঈদ, পূজা, পহেলা বৈশাখসহ বিশেষ দিনগুলোতে হাজারও মানুষের সমাগম ঘটে।
হিরণ্যকান্দির এ গাছে আমও ধরে প্রচুর। কাঁচা আম টক কিন্তু পাকলে সুমিষ্ট। ফলনভেদে কোনো বছর ৫০০ মণ আবার কোনো বছর ৭০০ মণ আম ধরে। সে আম যেমন বিক্রি হয়, তেমনি দর্শনার্থীরা এসেও দু-একটি খান।
গাছের নিচ থেকে উপরে তাকাতেই অসংখ্য শাখা-প্রশাখার সঙ্গে চোখে পড়ে বিভিন্ন পাখির বাসা। সেসব বাসা আর ডালে বসে মিষ্টি হাওয়ার গান গায় পাখিরা। সেই পাখিদের সুরের সঙ্গে সুর মিলিয়ে হঠাৎ বেজে ওঠে পকেটের মোবাইলও। অপর প্রান্ত থেকে আলভি ভাই স্মরণ করিয়ে দেন বরাদ্দের সময় প্রায় শেষ।
এবার ফিরতে হয় পুরোনো গন্তব্যে। আমের মুকুল, সবুজ পাতা, পাখিদের কলতানের মুগ্ধতা রেশ কেটে দেয় হৃদয়ে। হৃদয়ে গেঁথে থাকে গাছটিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা পাশের দোকানগুলোর আতিথেয়তা। সেসব ফেলে রেখে পা বাড়াতে হয় সামনে। পেছনে রৌদ্রজ্জ্বল সকালের স্মৃতিতে শুধু পড়ে থাকে শতবর্ষের পুরোনো এক পিছুটান।
বাংলাদেশ সময়: ১১২৪ ঘণ্টা, মার্চ ২১, ২০২৩
এইচএমএস/আরবি