ঢাকা: বিকেল হলেই যে ক্ষুদ্র, মৌসুমি ব্যবসায়ীর মতো কম আয়ে মানুষগুলো বাজার বা সড়কের ধারে চিৎকার করে বাহারী ইফতার সামগ্রী বিক্রি করেন। আজান হলে বেচে যাওয়া ইফতার তৈরি করেন তারা।
পবিত্র রমজানের প্রতিটি মাগরিবের আজানের সঙ্গে সঙ্গে ইফতারে এভাবেই মিলিত হন শ্রমজীবীরা।
দিনভর রোজগারে ব্যস্ত থাকা রিকশাওয়ালা, ভ্যানচালক, গাড়ির হেলপার-ড্রাইভার, হকার ভিক্ষুক গোল হয়ে বসেন ইফতারি নিয়ে। একেক গ্রুপে ভাগ হয়ে। যাদের ইফতার মেনু মুড়ি, ছোলা, পেয়াজু, বেগুনি বড়জোর জিলাপি আর চিনি-ট্যাংকের একগ্লাস বা বোতলভরা ভাগের শরবত।
রাজধানীর শ্রমজীবীদের কর্মস্থলের রোজার সন্ধ্যায় পরিচিত চিত্র এটি।
প্রতিদিনের মত শুক্রবার (৭ এপ্রিল) রাজধানীর তেজগাঁও, কারওয়ান বাজারে এমন চিত্র দেখা যায়। মিরপুর-১০ নম্বর বাজার, বাজার গলি, মার্কেটের দোকান, সিঁড়িতেও মিলেছে এমন চিত্র।
যেন দিন যাপনে আয় রোজগারের জন্য ঘর্মাক্ত, ক্লান্ত, বিপর্যস্ত মানুষেরা সব ভুলে এক হয়ে বসেছে পরলৌকিক শান্তির অন্বেষায়। ইফতার শুরুর আগে কিছুক্ষণ আজানের অপেক্ষা। এ সময় তারা ভেদাভেদ, শত্রুতা সব ভুলে যায়।
ইফতারির আগে রিকশাস্ট্যান্ডের পরিচিতি রাজধানীর তেজগাঁয়ের গলিগুলোতে দেখা যায় একে একে আসছে ইফতারি নিয়ে। জিলাপি, মুড়ি, পেঁয়াজু, ছোলার ভিন্ন প্যাকেজ নিয়ে। কারো কারো প্যাকেজে বাড়তি একটি জিলাপি বা ফলও আছে। অবশ্য একেক গ্রুপে একেক রকমের প্যাকেজ। কোনটি ৩০ টাকা কোনটি ৫০ টাকা। কোন কোন গ্রুপে সমান করে টাকা তুলে এক সঙ্গে ইফতারি কিনে প্রস্তুত করতে বসে গেছেন; অন্যরা আসা শুরু করেছে।
একসঙ্গে এতজনের ইফতারি এনেছেন! মানুষ তো কম?
বাংলানিউজের প্রতিবেদক এমন প্রশ্ন করেন একজনকে। যিনি শিল্প এলাকার মোড়ে ইফতারি করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। জবাবে তিনি বলেন, সব পাইলটরা ভাড়ায় গেছে। সময় হইলেই আয়া পড়বো।
এক সঙ্গে কতজন ইফতারি করবেন? তিনি বলেন, ১৫/১৬ জন হইব। জ্যামে কেউ ধরা খাইয়া গ্যালে রোডেই করবো, বলেন ইফতার প্রস্তুতরত আফাজ মিয়া।
একই চিত্র কারওয়ান বাজারেও। সেখানে ইফতার বিক্রির পিক আওয়ার শেষের দিকে। কয়েক মিনিট পরেই ইফতার। ভ্যান, ঠ্যালা গাড়ির উপর, রিকশাতে ইফতার বানানো শুরু হয়ে গেছে। অনেকেই গোল হয়ে বসে গেছে। মাঝে মাঝে ফাঁকা; আরও মানুষ ইফতার করতে আসবে।
ফার্মগেটের কলমিলতা বাজারে ইফতারের ভিন্ন চিত্র। ইফতার শুরু হয়ে গেছে। বাজারের ধারে গলিতে দাঁড়িয়ে ইফতার করছে কয়েকজন। এদর কেউ সবজি বিক্রেতা, কেউ তরমুজ বিক্রেতা কেউ পাশে রিকশাওয়ালা। সামনে দিয়ে মানুষ গেলেই ভাই, আংকেল আসেন আমাদের সাথে ইফতার করেন। যেভাবে হোক ইফতার করাবেই।
কিছুক্ষণ আগে বিক্রির জন্য হাঁক-ডাক করেছে, চিৎকার করেছে। এখন আর সেই কর্কস শব্দ নেই। কি মুসলমান, কি হিন্দু, কিইবা রোজাদার বা রোজা না থাকা মানুষ। একবার সঙ্গে রোজা করতে পারলে যে ইফতার করবেন তিনি পূণ্য অর্জন করাবেন। আবার যিনি ইফতার করাবেন তিনিও খুশি হবেন- ক্ষুদ্র আয়ের শ্রমজীবি মানুষগুলোর মধ্যে এক পবিত্র চিত্র।
তেজগাঁওয়ের রফিকুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, এ্যাখুন আমারে অন্য কোনো কথা জিগাইয়েন না। সারাদিন কাজ করিচি এখুন সবাই একসাতে ইফতার কইরবো। আপনেইও আসেন, একসাতে ইফতার করি।
ইফতারি কিনতে চাই বললে তিনি বলেন, আজকের মতন শেষ। যা ছিল একসাতে মিশি নিচি। সবাই একসাথে ইফতার কইরবো, আইসেন।
রফিকুলের টিনের পাত্রগুলোতে আর কোন ইফতারি সামগ্রী নেই। পাশে আরও একজন বললেন, আসেন এক সাথে ইফতার করি। আমরা বেশি কইরা মাখাই নিছি। এখন যাবেন কই, কোথাও আর ইফতারি পাবেন না।
পাশে মার্কেটের দোকানদার জানালেন, ওরা বিক্রি শেষে যা বাঁচে মাখিয়ে নেয়। এটা নিয়ে নিজেরা ইফতার করে, অন্যদেরও ডেকে সঙ্গে নিয়ে ইফতার করে।
বড় দোকানে নিজেরাই কয়েজন মিলে ইফতার করছেন। ছোট দোকানগুলোর কয়েকটি মিলে এক সঙ্গে ইফতার করছেন।
একটি দোকানে কয়েকজন মিলে বসেছেন, ইফতার করবেন। তার আগে সংক্ষিপ্ত মোনাজাত করে নিলেন সবাই মিলে। মোনাজাতে নেতৃত্বে দিলেন একজন। বড়দোকানগুলোতে ইফতারের প্যাকেজটি ভাল, তারা ইফতারে একটু বেশি টাকা খরচ করতে পেরেছে।
এসব ইফতারি বিক্রেতার কেউ বেকার ছিলেন। কেউ অন্য ব্যবসা বন্ধ হওয়ায় এই ব্যবসায় এসেছেন। ইফতারি বিক্রেতার একটি অংশ এসেছেন ছোট্ট ছোট্টো হোটেল থেকে। এদের কেউ কাজ হারিয়েছেন, কেউ বা হোটেল মালিকের তত্ত্বাবধানেই এই ব্যবসা করছেন। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে এমনটা জানা যায়।
মিরপুর শাহ আলী মার্কেটে ইফতারি সেরে অনেকে নামাজে দাঁড়িয়েছে। কেউ কেউ পাশে একটু হাঁটতে বেরিয়েছেন। কিন্তু কিছু মানুষ দোকান বা সিঁড়িতে মার্কেটে ঢুকতে গেটে এখনো অপেক্ষায় আছেন; যারা ভিক্ষুক। অসুস্থ, পঙ্গু বৃদ্ধ, যুবা। মলিন চেহারা। অপেক্ষা করছেন কেউ যদি বাড়তি ইফতারি দেন বা দেন কিছু টাকা। তারাও ওই মার্কেটের দোকানে সামনের অংশ বা সিড়িতে ইফতারি সেরেছেন।
কথা হয় মিরপুরের ফলপট্টি এক ইফতারি বিক্রেতার সঙ্গে। তিনি নাম বলতে রাজি হননি। ইফতারি শেষ করে দোকান গোছাচ্ছেন।
ইফতারি বিক্রি শেষ, এখন রওনা দিচ্ছেন? কথা শুনে চোখ তুলে একবার দেখে নিলেন। কি দরকার, জিজ্ঞেস করেন এই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী।
প্রতিবেদক বললেন, আমি পত্রিকায় কাজ করি। আপনাদের সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।
এ কথা শুনেই তিনি বললেন, ওহ, আজকের মতো ইফতারি শেষ, বাসায় যাব। তার আগে কালকের জন্য কিছু কেনাকাটা করব। তারপর বাসায় যাব।
ইফতারি ভালই বিক্রি হচ্ছে! বললেন, হয় আর কই?আমি মার্কেটের ধারে ফুটপাতে ছোট্ট দোকানে বিভিন্ন রকমের খাবার বিক্রি করি, ফাস্টফুড। রোজায় এটা বন্ধ থাকে। তাই ইফতারি বিক্রি করছি। বিক্রি হয় মোটামুটি। দোকান খুলতে পারলে আর সারাদিন বেচা হলে ইফতারির চাইতে দোকানই ভালো।
বাংলাদেশ সময়: ২১০০ ঘণ্টা, এপ্রিল ৭, ২০২৩
জেডএ/এসএএইচ