ঢাকা: জাতিসংঘের বিভিন্ন মানবাধিকার বিষয়ক কনফারেন্সে যোগদানের নামে যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সসহ উন্নত দেশগুলোতে মানবপাচার করে আসছিল দেশে মানবাধিকার সংগঠন হিসেবে পরিচয় দেওয়া প্রটেকশন ফর লিগ্যাল অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতারণার মাধ্যমে জাতিসংঘের বিভিন্ন কনফারেন্সে যোগদানের অনুমতিপত্র সংগ্রহ করে শুরু হয় কথিত মানবাধিকার সংগঠনটির প্রতারণা।
এরপর কনফারেন্সের আমন্ত্রণপত্রের বিপরীতে অ্যাম্বাসিতে সেই সব ব্যক্তিদের পাসপোর্টসহ কাগজপত্র জমা দিয়ে বিভিন্ন মেয়াদের ভিসা নিয়ে আমেরিকায় পাঠানো হতো। কিন্তু ভিসার মেয়াদ শেষ হলেও তারা অবৈধ নানা পন্থায় বিদেশে থেকে যায়। এভাবে চক্রটি জাতিসংঘ ও মার্কিন দূতাবাসকে দীর্ঘদিন ধরে ধোঁকা দিয়ে মানবপাচার করে আসছিল।
জালিয়াতির বিষয়টি নজরে আসার পর গত ২১ মে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের সহকারী রিজিওনাল সিকিউরিটি অফিসার মিকাইল লি বাদী হয়ে গুলশান থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।
এ প্রেক্ষিতে ডিবি সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ ঢাকা ও এর আশেপাশের এলাকায় অভিযান চালিয়ে কথিত মানবাধিকার সংগঠনের আড়ালে আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে।
গ্রেপ্তাররা হলেন—মহিউদ্দিন জুয়েল, মো. উজ্জ্বল হোসাইন ওরফে মুরাদ, মো. এনামুল হাসান, শাহাদাদ ও হাদিদুল মুবিন। তাদের কাছ থেকে তিনটি পাসপোর্ট, দুটি ভিজিটিং কার্ড, তিনটি এনওসি ও পাঁচটি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়।
গ্রেপ্তারদের মধ্যে মহিউদ্দিন জুয়েল এলএলবি ও বিএসএস পর্যন্ত পড়াশোনা করে প্রোটেকশন ফর লিগ্যাল অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের ভুয়া চেয়ারম্যান ও উজ্জ্বল মাস্টার্স শেষ করে নির্বাহী পরিচালক পরিচয়ে প্রতারণা এবং মানবপাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত হন। এনামুল এইচএসসি, শাহাদাদ বিবিএস ও হাদিদুল মাস্টার্স শেষ করে বেকার।
ডিবি সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ সূত্র জানায়, মানবাধিকার সংগঠন হিসেবে প্রচার করায় তাদের কাছে নানা বিরোধ নিষ্পত্তির অভিযোগ আসে। সেসবের ভিত্তিতে কাগজপত্র তৈরি করে ইউএন ইকোনমিক ও সোশ্যাল কাউন্সিলের বিভিন্ন প্রোগ্রামের অ্যাটাচমেন্টসহ রেজিস্ট্রেশন করতেন তারা। এনজিও কর্মকর্তার পরিচয়ে কনফারেন্সে যোগ দেওয়ার অনুমতি চেয়ে মেইল করতেন।
জাতিসংঘের সদর দপ্তর অনুমতি দিলেই শুরু হতো আর্থিক প্রতারণা। অনুমতিপত্র দেখিয়ে ইউরোপ-আমেরিকায় যেতে আগ্রহী ব্যক্তিদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া হতো মোটা অংকের টাকা। ২০১৯ সাল থেকে চক্রটি জাতিসংঘ ও মার্কিন দূতাবাসকে ধোঁকা দিয়ে মানবপাচার করে আসছিল।
প্রতারণার কৌশলের বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতিষ্ঠানটিতে বিরোধ ও সমস্যা নিষ্পত্তির অভিযোগের সূত্রেই তারা প্রতারণার ফাঁদ পাতে। অভিযোগকারীর সঙ্গে কৌশলে সুসম্পর্ক গড়ে তুলে তাদের ইউরোপ-আমেরিকায় পাঠানোর প্রলোভন দেখায়। এতে কেউ রাজি হলে তার সঙ্গে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকার একটি চুক্তি হতো।
গত ১৭ এপ্রিল থেকে ২৮ এপ্রিল জাতিসংঘ সদর দপ্তরে আদিবাসী ইস্যুর প্রোগ্রামে অংশগ্রহণের জন্য প্রটেকশন ফর লিগ্যাল অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের ডেপুটি ডিরেক্টর পরিচয় দেওয়া এনামুল হাসান ও হাদিদুল মবিন এবং কমিউনিকেশন অফিসার হিসেবে শাহাদাদ আমন্ত্রণপত্র নেন। তবে তারা আমন্ত্রণপত্রের সঙ্গে ভুয়া কিছু কাগজপত্র সংযুক্ত করে ফেঁসে যান। ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসে আবেদনের পর যাচাই-বাছাইয়ে কাগজপত্র জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়ে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের (উত্তর) উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ তারেক বিন রশিদ বাংলনিউজকে বলেন, এভাবে মানবাধিকার সংগঠনের নামে জাতিসংঘের বিভিন্ন কনফারেন্সে যাবার জন্য জালিয়াতির বিষয়টি দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে। তাদের কারণে প্রকৃত সংগঠন কিংবা আগ্রহী ব্যক্তির আবেদনও প্রশ্ন বা সন্দেহের সম্মুখীন হচ্ছে।
চক্রটি বেশ কয়েক বছর ধরে প্রতারণা করে আসছিল। এমন ঘটনায় এর আগেও কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। গ্রেপ্তার মহিউদ্দিন ও উজ্জ্বল প্রতারণার মাধ্যমে কী পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে এবং অর্থ কোথায় রয়েছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলেও জানান ডিসি মোহাম্মদ তারেক বিন রশিদ।
বাংলাদেশ সময়: ১৫০৮ ঘণ্টা, মে ২৪, ২০২৩
পিএম/এমজেএফ