টাঙ্গাইল: টাঙ্গাইলের বিভিন্ন উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে মানুষের এখন দিন কাটছে ডাকাত ও চোর আতঙ্কে। বিশেষ করে টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলার কাশিল ইউনিয়নের বাঘিল গ্রামের মানুষের চোখেমুখে প্রকাশ পাচ্ছে সেই আতঙ্কের ছাপ।
গত এক মাসে এই গ্রামে অন্তত ১০/১২টি বাড়িতে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। এসময় ডাকাতরা লুটে নিয়েছে নগদ টাকা, স্বর্ণালংকারসহ বিভিন্ন মূলবান জিনিসপত্র।
এসব ডাকাতির ঘটনার আগে ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের কৌশলে অচেতন করা হয়। এরপর রাতে ঘরে ঢুকে নগদ টাকাসহ মূল্যবান জিনিসপত্র চুরি করে নিয়ে যায় চোর চক্রটি।
সরেজমিন বাঘিল গ্রামে গিয়ে কথা হয় ভুক্তভোগীদের সঙ্গে। তারা জানান, সকাল থেকে দুপুরের মধ্যে তাদের বাড়িতে অপরিচিত কোনো নারী এসে পানি পান করতে চান। পরে পানি পান না করেই চলে যান। এরপর থেকেই একে একে সবাই ঘুমিয়ে পড়েন। গভীর রাতে ঘুম ভেঙে দেখেন ঘরে ঢুকে চোর সব লুট করে নিয়ে গেছে।
বাঘিল গ্রামের ভুক্তভোগী মো. হুমায়ন মিয়া জানান, গত সোমবার সকাল ১০টার দিকে স্থানীয় বাজার থেকে একটি মাছ কিনে বাড়িতে আসেন। এরপর নাস্তা করে আবার বাড়ি থেকে বের হয়ে সিএনজি চালিত একটি অটোরিকশা নিয়ে টাঙ্গাইলের উদ্দেশে রওনা হন। পরে অটোরিকশাতেই ঘুমিয়ে পড়েন তিনি। পরে দুপুরে বাড়িতে এসে দেখেন পরিবারের সবাই ঘুমিয়ে আছেন। তিনিসহ পরিবারের সবাই অসুস্থ ভেবে পাশের বাড়ির পারভীন এবং ফাহিমা নামের দুই স্বজনকে রাতে বাড়িতে থাকতে বলেন। তারা আসার পর সবাই ঘুমিয়ে পড়েন। রাত ৩টার দিকে ঘুম ভাঙলে তিনি দেখতে পান দরজা এবং আলমারি খোলা। আর আলমারিতে থাকা নগদ পাঁচ লাখ টাকা ও কিছু স্বর্ণালংকার নেই। কখন কে বা কারা নিয়েছে কিছুই বলতে পারেননি তিনি।
হালিমা বেগম জানান, সকালে তার স্বামী বাজার থেকে মাছ এনে দিলে সেটি কাটার সময়ই তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। এর কিছুক্ষণ পর তার জা (স্বামীর ভাইয়ের স্ত্রী) তিনিও ঘুমিয়ে পড়েন। গভীর রাতে ঘুম ভাঙলে দেখতে পান ঘরে ডাকাতি বা চুরি হয়েছে।
আরেক ভুক্তভোগী হাফেজ আব্দুল জলিল জানান, সোমবার সকালে একজন তরুণী বাড়িতে এসে পানি পান করতে চান। পরে তার ছেলের স্ত্রী ওই তরুণীকে পানি দেয়। কিন্তু সেই পানি পান না করে ফেলে দিয়ে বাড়ি থেকে চলে যান তরুণী। পানি পান না করার কারণ জিজ্ঞেস করলেও কোনো উত্তর দেয়নি ওই তরুণী। এর পরপরই তিনি, তার স্ত্রী সেলিনা বেগম, ছেলে রাজা মিয়া ও সাগর মিয়া অচেতন হয়ে পড়েন। পরে পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা তাদের টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করান। তবে তাদের বাড়িতে কোনো ডাকাতি ও চুরির ঘটনা ঘটেনি।
একইদিন একই ঘটনা ঘটেছে পাশের বাড়ির আবু হানিফের বাড়িতেও। তবে তার ঘর থেকে তেমন কিছুই নেয়নি বলে জানান হানিফ। তিনি বলেন, দুপুরে খাবার খাওয়ার পর হঠাৎ করেই তিনি ও তার স্ত্রী ঘরের দরজা খোলা রেখেই ঘুমিয়ে পড়েন। সকালে উঠে দেখেন আলমারি খোলা। তখন তিনি বুঝতে পারেন ঘরে চোর ঢুকেছিল। তবে আলমারিতে তেমন কিছুই ছিল না। তার স্ত্রী আয়শা জানান, কেউ হয়তো কৌশলে পানিতে বা খাবারে চেতনানাশক কিছু মিশিয়ে দিয়েছিল। এ কারণেই তারা দুইজনেই হঠাৎ করেই ঘুমিয়ে পড়েন।
এর আগে রমজানের শুরুতে একই গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য নুরুল ইসলামের ঘর থেকে ৬ ভরি, আব্দুর রহমান ধলার ঘর থেকে ১১ ভরি এবং আক্তার হোসেনের ঘর থেকে ৫ ভরি স্বর্ণালংকার লুট করা হয়। আর লুটের আগে পরিবারের সবাইকে অচেতন করা হয় বলেও জানান এসব ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা।
ভুক্তভোগী নুরুল ইসলাম জানান, ১৩ রমজানের দিন ইফতারের পরপরই তিনিসহ পরিবারের সবাই একে একে ঘুমিয়ে পড়েন। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখেন ঘরের দরজা এবং আলমারি ভাঙা। পরে দেখতে পান আলমারিতে রাখ নগদ কিছু টাকা এবং প্রায় ছয় ভরি স্বর্ণালংকার কারা যেন চুরি করে নিয়ে গেছে। ঘুমের কারণে সেহরি না খেতে পারায় পরদিন পরিবারের কেউ রোজা রাখতে পারেননি। একইরাতে একইভাবে পাশের বাড়ির আব্দুর রহমান ও আক্তার হোসেনের পরিবারও ইফতারের পরপরই ঘুমি পড়েন। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখতে পান কারা যেন আলমারি ভেঙে নগদ টাকা ও স্বর্ণালংকার নিয়ে গেছে। তবে তারা বলছেন কেউ হয়তো কৌশলে তাদের বাড়ির টিউবওয়েলে বা খাবারে চেতনাশাক কিছু মিশিয়ে দিয়েছিল।
এদিকে প্রতিনিয়তই অচেতন করে ডাকাতির ঘটনায় পুরো গ্রামবাসী আতঙ্কে রয়েছেন। তবে পুলিশ বলছে ভুক্তিভোগী পরিবারের নিজেদের লোক বা স্থানীয় এলাকাবাসী ছাড়া এ ধরনের কাজ করা সম্ভব নয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় কয়েকজন জানান, এলাকায় ৬/৭জন বখাটে এবং মাদকাসক্ত যুবক রয়েছে। তারা কিছুই করে না। অথচ তাদের চলাফেরা দেখলে মনে হবে কোটিপতি। এ কারণে এ ধরনের ঘটনার পেছনে সন্দেহের তীর তাদের দিকেই রয়েছে। তবে ভয়ে তাদের নামও প্রকাশ করতে সাহস পাচ্ছেন না এলাকাবাসী।
কাশিল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. রমজান মিয়া জানান, এ ধরনের ঘটনা খুবই দুঃখজনক। স্থানীয় লোকজন ছাড়া এ ঘটনা ঘটানো সম্ভব নয়। এলাকার কেউ হয়তো কৌশলে টিউবওয়েলের ভেতর বা ট্যাংকির মধ্যে নেশা জাতীয় দ্রব্য মিশিয়ে রাখে। রাতের বেলায় সুযোগ বুঝে ঘরে ঢুকে সব লুট করে নিয়ে যায়। তিনি এলাকাবাসীকে সজাগ থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন।
অপরদিকে গত বছর ফেব্রুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে সাতটি বাড়িতে একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। তবে এসব বাড়ির লোকজন সবাই টিউবওয়েলের পানি পান করেই অসুস্থ হয়ে পড়েন বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগী পরিবার।
জানা যায়, ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি কালিহাতী উপজেলার নারান্দিয়া গ্রামের নির্জন কুমার ভৌমিক ও তার ছোট ভাই বিজয় কৃষ্ণ ভৌমিক বিকেলে টিউবয়েলের পানি পান করেন। এরপরই তারা অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে পরিবারের অন্য সদস্যরা তাদের টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করেন। এছাড়া ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে একই এলাকার রবীন্দ্রনাথ সেনের বাড়ির লোকজন টিউবওয়েলের পানি পান করে ঘুমিয়ে পড়েন। পরে সংঘবদ্ধ চোরচক্র ঘরের দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে নগদ টাকা ও স্বর্ণালংকার চুরি করে নিয়ে যায়।
ভুক্তভোগী নির্জন কুমার ভৌমিক জানান, দুষ্কৃতিকারীরা কৌশলে তাদের বাড়ির টিউবওয়েলের মধ্যে চেতনানাশক ওষুধ মিশিয়ে দেয়। রাতে খাবারের সঙ্গে বাড়ির সদস্যরা ওই টিউবয়েলের পানি পান করেন। এতে সবাই ঘুমে অচেতন হয়ে পড়েন। পরে চোরচক্র টাকাসহ স্বর্ণালংকার চুরি করে নিয়ে যায়। পরদিন সকালে স্বজনরা তাদের হাসপাতালে ভর্তি করেন।
একই বছর ২৭ রমজানের দিন কালিহাতী উপজেলার ভবানিপুর গ্রামের আনোয়ারের বাড়ির সবাই টিউবয়েলের পানি পান করে ঘুমিয়ে পড়েন। সকালে উঠে দেখেন আলমারিতে রাখা নগদ ৫ লাখ টাকা ও ৪ ভরি স্বর্ণালংকার চুরি হয়ে গেছে। এরপর থেকে বাড়ির ভেতরে সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে।
২০২০ সালের ৬ এপ্রিল কালিহাতী পৌর এলাকার ঘূর্ণিপূর্ব পাড়া এলাকায় এক পুলিশ সদস্য রানা বাবুর বাড়ির সবাইকে অচেতন করে নগদ টাকা ও স্বর্ণালংকার চুরি করে নিয়ে যায় চোরচক্র।
ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা জানান, ওইদিন বিকেলে কে বা কারা খাবারের সঙ্গে চেতনানাশক ওষুধ মিশিয়ে রাখেন। পরে রাতে ওই খাবার খেয়ে সবাই অচেতন হয়ে পড়েন। আর এ সুযোগে দুর্বৃত্তরা ঘরের টিন কেটে ভেতরে প্রবেশ করে আলমারি ভেঙে নগদ দেড় লাখ টাকা ও ২৬ ভরি স্বর্ণালংকার চুরি করে নিয়ে যায়। পরদিন সকালে প্রতিবেশীরা ঘরের দরজা খোলা দেখে তাদের ঘুম থেকে ডেকে তোলেন।
বাসাইল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তাফিজুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে তদন্ত করছে। ভুক্তভোগী পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছে। এ ধরনের ঘটনাটি এলাকাবাসীর জন্য আতঙ্কের। তবে এই ডাকাতি বা চুরির ঘটনার পেছনে এলাকার পরিচিত কোনো লোকজন জড়িত থাকতে পারে। এছাড়া টিউবওয়েলের পানিতে চেতনানাশক মিশিয়ে গত ৭/৮ মাস আগে একটি বাড়িতে এ ঘটনা ঘটেছিল। ওইসময় এ বিষয়ে একটি লিখিত অভিযোগ পেয়ে ঘটনার তদন্ত করা হয়। কিন্তু জড়িত কোনো ব্যক্তিকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।
টাঙ্গাইলের অতিক্তি পুলিশ সুপার (অপরাধ) মো. শরফুদ্দীন বাংলানিউজকে জানান, এ ধরনের চুরির ঘটনাগুলো মানুষের মাঝে আতঙ্কের সৃষ্টি করছে। এই চক্রটিকে ধরতে স্থানীয়দের সহযোগিতা চান তিনি। এছাড়া গ্রামবাসীকে আরও সচেতন হতে হবে বলেও মনে করেন। সম্প্রতি এই চক্রটির কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং কয়েকজনকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৫২ ঘণ্টা, মে ২৪, ২০২৩
আরএ