ঢাকা: রাজধানীর একটি কলেজ থেকে ডিপ্লোমা ইন কমার্স সম্পন্ন করেছেন আরিফ আবেদীন ওরফে জিসান (৪৪)। পাশাপাশি অনলাইনে বিভিন্ন টিউটোরিয়াল দেখে তিনি এডোবি ফটোশপের কাজ শিখেছেন।
চাকরির দিকে তার ঝোঁক না থাকলেও অবৈধ বিটকয়েন, এরএমডি (চায়না মুদ্রা), হুন্ডির ব্যবসা শুরু করেন জিসান। বিটকয়েন ও হুন্ডির ব্যবসার সুবাদে তার সঙ্গে পরিচয় হয় রায়হান ওরফে রতন নামে এক যুবকের। বর্তমানে রায়হান ভিয়েতনামে অবস্থান করছেন। দুজনে গড়ে তোলেন দেশি-বিদেশি সাইবার প্রতারণামূলক একটি সিন্ডিকেট।
ধীরে ধীরে আরিফ আবেদীন ওরফে জিসানের সিন্ডিকেটে একে একে যুক্ত হন অনিক হোসেন (২৮), শাওন আহম্মেদ (২৭) ও মো. নাসিম খান (২৮), মো. আওয়ান খান (৫০) ও শাহ কামাল (৫২)। এতেই শুরু হয় তাদের নানাবিধ প্রতারণামূলক কর্ম, হাতিয়ে নেন বিপুল পরিমাণ অর্থ।
সাইবার প্রতারণার মাধ্যমে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ব্যবসায়ীর টিটিএলসি খুলে দেওয়াসহ বিভিন্ন ব্যক্তি বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধের কথা বলে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করে নেন আরিফ আবেদীন ওরফে জিসান (৪৪)। তাদের বিরুদ্ধে তিনজন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ৩০ লাখ টাকার বেশি হাতিয়ে নেওয়ার তথ্য প্রমাণ পেয়েছে র্যাব-১০।
সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে মঙ্গলবার (৩০ মে) রাতে রাজধানীর বনানী থানাধীন মহাখালী এলাকার জিপি-চ ১৯১, ৫ তলা ভবনের ২য় তলার ডান পাশের ফ্লাটে অভিযান পরিচালনা করে সংঘবদ্ধ সাইবার প্রতারক চক্রের মূলহোতা জিসানসহ চার প্রতারককে গ্রেপ্তার করেছেন র্যাব-১০ এর সদস্যরা।
প্রতারক চক্রের গ্রেপ্তার বাকি সদস্যরা হলেন- অনিক হোসেন (২৮), শাওন আহম্মেদ (২৭) ও মো. নাসিম খান (২৮)। অভিযানে তাদের কাছ থেকে প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত ২টি ল্যাপটপ (যার একটি HP core i5 Vpro, Serial CNU4309Z9P এবং অপরটি DELL intel core i5 Vpro, service Tag, serial 716KSC2) এবং ৫টি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়।
র্যাব-১০ জানায়, চক্রটি ডলার সংকটের কথা বলে, বিদেশ থেকে ব্যবসায়ীদের পণ্য ক্রয়ের জন্য বিদেশি কোম্পানিগুলোর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এলসিটিটির টাকা প্রেরণের নামে ভুয়া ব্যাংক স্লিপ প্রদর্শন করে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছিলেন। এছাড়াও, এই চক্রটি বেশ কিছুদিন ধরেই বিভিন্ন বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের বিদ্যুৎ বিল পরিশোধের নামে প্রতারণার মাধ্যমে ভুয়া বিল তৈরি করে প্রতারণা করে আসছেন।
র্যাব আরও জানান, যদি কোনো প্রতিষ্ঠানের বিদ্যুৎ বিল ৫০ লাখ টাকা হয়, তবে চক্রের সদস্যরা বলতো তাদের মাধ্যমে বিল পে করলে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন পাওয়া যাবে। এক্ষেত্রে বিলের সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধের প্রয়োজন নেই। এছাড়াও আরও প্রলোভন দেখিয়ে ভুক্তভোগীকে আকৃষ্ট করে বিলের টাকা হাতিয়ে নিয়ে হোয়ার্টসঅ্যাপে (whatsapp) এ পেমেন্ট স্লিপ পাঠাতেন জিসান। আর ভিয়েতনামে অবস্থানরত রায়হান ওরফে রতন মাস্টারকার্ড ব্যবহার করে বিল পেমেন্ট দেখিয়ে নোটিফিকেশন পাঠাতেন। যদিও সপ্তাহ পার হলে ওই নোটিফিকেশন গ্রাহকের কাছ থেকে মুছে যেত। এভাবে বিদ্যুৎবিল সংক্রান্ত প্রতারণা করতেন প্রতারক চক্রের মূলহোতা জিসান৷
এছাড়াও চক্রটি বিদেশগামীদের সঙ্গেও প্রতারণা করে অর্থ আত্মসাৎ করতেন। অভিযোগ পাওয়া গেছে কানাডার সিটিজেনশিপ বা ভিসা পাওয়ার বিদেশগামীদের সেখানে বাড়ি ভাড়া করতে দেওয়ার নামেও ভুয়া পেমেন্ট স্লিপ দিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করতেন তারা। এতে ওই দেশে যাওয়ার পর ভুক্তভোগীরা প্রতারণার শিকার হয়েছেন।
অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া র্যাব-১০ এর কোম্পানি কমান্ডার (সিপিএসসি) স্কোয়াড্রন লিডার তারিকুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, প্রতারক এই চক্রের মূলহোতা জিসানের এডোবি ফটোশপের কাজে পারদর্শী। তিনি একজন মাস্টার চিট। চক্রের তার কাজ ছিল বিভিন্ন ভুয়া পেটেন্ট স্লিপ তৈরি করে ভুক্তভোগীদের দেওয়া। আর এই কাজটি তিনি খুব দ্রুত করতে পারতেন। অপরদিকে চক্রের অন্যতম সদস্য রায়হান ওরফে রতন ভিয়েতনামে অবস্থান করছেন। সেখানে বসে সে অর্থের লেনদেন সংক্রান্ত কাজটি করতেন।
চক্রের বাকি সদস্যরা (অনিক, শাওন, নাসিম, আওয়ান, শাহ কামাল) গ্রাহক সংগ্রহের কাজটি করতেন।
স্কোয়াড্রন লিডার তারিকুল ইসলাম বলেন, এই চক্রের গ্রেপ্তার সদস্যরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে প্রতারণার বিষয়গুলো স্বীকার করেছেন। এ পর্যন্ত তিনজন ব্যবসায়ীর অভিযোগ পেয়েছি। চক্রটি তাদের কাছ থেকে ৩০ লাখের বেশি টাকা প্রতারণার মাধ্যমে আত্মসাৎ করেছে বলেও স্বীকার করেছেন।
র্যাব-১০ এর অধিনায়ক (সিও) অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, গ্রেপ্তার আসামীরা সাইবার প্রতারণার মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রতারণার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
গ্রেপ্তারদের বিরুদ্ধে রাজধানীর বনানী থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ১০৩৮ ঘণ্টা, জুন ০১, ২০২৩
এসজেএ/এসআইএস