ঢাকা, সোমবার, ৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

‘বৃক্ষপ্রেমিক’ মেয়র আতিকের সিটিতেই শতাধিক গাছ কর্তন!

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৩৪ ঘণ্টা, জুন ৩, ২০২৩
‘বৃক্ষপ্রেমিক’ মেয়র আতিকের সিটিতেই শতাধিক গাছ কর্তন! ছবি: জি এম মুজিবুর

ঢাকা: রাজধানীর সাত মসজিদ রোডে উন্নয়নকাজের জন্য ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) গাছ কাটা নিয়ে আলোচনার রেশ এখনও কাটেনি। এর মধ্যেই আবারও সেই সড়ক উন্নয়নকাজে গাছ কাটার চিত্র দেখাতে শুরু করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)।

রাজধানীর মহাখালীর আমতলী থেকে গুলশান-১ পর্যন্ত সড়কটি বীর উত্তম এ কে খন্দকার সড়ক হিসেবে পরিচিত। মহাখালী ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে আমতলী অংশে প্রবেশ করতেই যে কারো চোখ আটকে যেত সড়কটিতে। কারণ সড়কের বিভাজকে থাকা হরেক রকম গাছ- কৃষ্ণচূড়া, বটসহ সবুজ ডানা বিছিয়ে থাকা ডাল-পাতা। কিন্তু এ সড়কটির বিভাজক উন্নয়নের নামে ছায়াদানকারী শতাধিক গাছ ইতোমধ্যে কেটে ফেলা হয়েছে। পরিবেশবাদী ও স্থানীয়রা বলছেন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন পরিকল্পিতভাবেই দীর্ঘসময় নিয়ে গাছগুলো কেটেছে।

স্থানীয়রা বলছেন, সড়কটির ৬০টির বেশি গাছ কাটা হয়েছে প্রায় দুই মাস আগে, যেন উন্নয়ন প্রকল্প চলাকালে গাছ কম কাটতে হয়, যেন কারো দৃষ্টিগোচর না হয়। কাটা পড়া গাছগুলোর অধিকাংশই বড়। অন্যদিকে বর্তমানে কাজ চলমান থাকায় গাছগুলোর গোড়ার অংশের মাটি সরাতে হচ্ছে। কোনো কোনো গাছের শিকড়সহ মূল কাটা পড়ছে। ফলে গাছগুলো হেলে পড়ার অজুহাত দেখিয়ে কাটা হচ্ছে। উন্নয়নকাজ যত এগিয়ে যাচ্ছে, তত বেশি গাছ কাটা পড়ছে। সব মিলিয়ে ১০০ এর বেশি গাছ কাটা পড়েছে বলে মন্তব্য স্থানীয়দের। আরও বেশ কিছু গাছ কাটা পড়বে।

স্থানীয়রা আরও বলছেন, গাছগুলোর অধিকাংশ কাটা হয়েছে রাতের আঁধারে। অপসারণ করাও হয় দ্রুত সময়ে। আর এগুলো মেয়রের নতুন দুই লাখ গাছ লাগানোর ঠিক বিপরীত চিত্র।

সম্প্রতি ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম গাছ কাটার বিপক্ষে তার অবস্থান জানিয়ে বলেছিলেন, আমরা বুঝতে পারছি যে কী হিটের (গরম/তাপদাহ) মধ্যে আছি। তাই পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুকূলে আনতে পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায় দুই লাখ গাছ লাগাবো। এর জন্য নগরবাসীর সাহায্য ও সহযোগিতা চাই। আর নগরের যে খালগুলো দখল হয়ে গেছে সেগুলো উদ্ধার করে পানি প্রবাহ করার চেষ্টা করছি। গাছ ও পানির প্রবাহ- তবেই ন্যাচার বেজ সলিউশনে আমরা নগরকে ঠাণ্ডা রাখতে পারি।

এ বিষয়ে স্থানীয় আমিনুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি বলেন, মেয়র দুই লাখ গাছ লাগানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পর আমরা ভেবেছিলাম পরিস্থিতি পাল্টে যাবে। কিন্তু এখন আমরা দেখছি এগুলো খালি কথা।

গুগল স্ট্রিট ভিউ ও স্থানীয়দের দেওয়া তথ্যে জানা যায়, মহাখালী-গুলশান রোডের মধ্যবর্তী ডিভাইডারে প্রায় ৩০০টি গাছ ছিল। মহাখালী-গুলশান সড়কে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ও হাসপাতালের সামনের সড়কের ডিভাইডারে চলমান সংস্কারকাজের কারণে অনেক গাছ নষ্ট হয়ে গেছে। অনেক গাছ নষ্ট হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। ডিভাইডারের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে আছে ৩০টি গাছের গুঁড়ি।

সড়কটি ঘুরে দেখা যায়, সড়কটির বিভাজক বা আইল্যান্ডের উন্নয়নকাজ চলছে। মহাখালী আমতলী অংশ থেকে শুরু করে গুলশান লিংক রোড পর্যন্ত স্থানভেদে কাটা পড়েছে গাছ। কোথাও কোথাও আবার গাছ রেখেই কাজ চলছে। ব্র্যাক সেন্টারের অদূরে পারটেক্স গ্রুপের অফিসের সামনের সড়ক বিভাজকে থাকা কৃষ্ণচূড়া গাছটি কাটা হয়েছে গত সপ্তাহে। স্থানটিতে থাকা গাছের গোড়ালির তাজা অংশই তা বলে দিচ্ছে। কিছু গাছ কাটা হয়েছে বেশ কিছু দিন আগে। কাটা পড়া গাছের গোড়ালি থেকে বের হয়েছে সবুজ শাখা-প্রশাখা। কিছু কিছু গাছের শিকড় কাটা পড়ায় পাতা শুকিয়ে গেছে। এছাড়া সড়ক বিভাজক বা আইল্যান্ডের খোঁড়াখুঁড়িতে হেলে পড়তেও দেখা গেছে বেশ কিছু গাছ। সেগুলো সরাতেও দেখা গেছে শ্রমিকদের।

বীর উত্তম এ কে খন্দকার সড়কের পারটেক্স গ্রুপের নিরাপত্তা প্রহরী আব্দুর রহমান বলেন, গত ২৬ তারিখ কৃষ্ণচূড়া গাছটি কাটা হয়েছে। ভেকু মেশিন দিয়ে চারপাশের মাটি সরিয়ে ফেলায় গাছটি হেলে যায়। এক পর্যায়ে গাছটি কাটা হয়। বাকি সবগুলো গাছ দুই মাস আগে কাটা হয়েছে।

প্রায় তিন মাস আগে প্রকল্পে যোগদানকারী নির্মাণশ্রমিক জলিল উদ্দিন বলেন, গাছের কারণে তাদের কাজ ঠিকমতো করা কঠিন হয়ে পড়েছে।

তিনি বলেন, গাছ রাস্তার ওপর হেলে পড়ায় আমরা পুরোনো মাঝারি স্ট্রিপ স্ট্রাকচারগুলো সরিয়ে ফেলছি, প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। দুর্ঘটনা রোধ করতে আমাদের এটি করতে হবে।

এদিকে বিধ্বংসী পরিবেশগত প্রভাবের বাইরে ডিএনসিসির গাছ কাটা বিদ্যমান আইনও লঙ্ঘন করে। বন বিভাগ থেকে প্রয়োজনীয় অনুমতি না নিয়েই নগর কর্তৃপক্ষ গাছ কাটছে বলে অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে।

বনজদ্রব্য পরিবহন (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০১১ এর ৫ ধারায় বলা আছে সড়ক ও জনপথ, বাঁধ, রেলপথ, সংযোগ সড়ক ইত্যাদি ভূমি থেকে বনজ সম্পদ আহরণ, অপসারণ বা পরিবহন করতে হলে বন বিভাগের অনুমতি প্রয়োজন হয়। তবে সেই আইনের তোয়াক্কা করেনি ডিএনসিসি। অনুমতি না নিয়ে বন বিভাগের অফিসের সামনের গাছ কাটলেও ডিএনসিসির এ কাজে বাধা দেয়নি বন বিভাগ।

নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে এক বন কর্মকর্তা বলেন, তারা ডিএনসিসি থেকে এ ধরনের কোনো আবেদন পাননি এবং এ বিষয়ে কোনো অনুমতিও দেননি।

এ ধরনের উন্নয়ন প্রকল্পের সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশিষ্টজনরা ও স্থানীয় ব্যক্তিরা।

গাছ কাটার জন্য দায়ী প্রকল্পের ডিজাইনারদের সঙ্গে আলোচনা করে স্থানীয় পরিবেশ উন্নয়নকর্মী জামিল বলেন, এ ধরনের উন্নয়ন প্রকল্পের সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা প্রয়োজন। ‘গাছ না কেটে একটি মিডিয়ান স্ট্রিপ তৈরি করা সম্ভব। ’

এদিকে এ উন্নয়ন প্রকল্পটির ঠিকাদার জনি এন্টারপ্রাইজ নামে একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান। গাছ কাটার বিষয়ে জনি এন্টারপ্রাইজের ম্যানেজিং ডিরেক্টর দিলীপ জানিয়েছেন, মিডিয়ান স্ট্রিপ নির্মাণের সময় যে গাছগুলো ‘মরে গিয়েছিল’ সেগুলো ডিএনসিসি তুলে নিয়েছিল যেন সেগুলো রাস্তায় না পড়ে। আর তারা কোনো গাছ কাটেনি বলেও এ সময় দাবি করেন।

সার্বিক বিষয়ে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সেলিম রেজা বলেন, আইল্যান্ডের কাজ করতে গিয়ে হয়তো কিছু গাছ হেলে পড়েছিল, ঝুলে পড়েছিল। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন সব সময় গাছ কাটার বিপক্ষে। সিটি করপোরেশন এরিয়ায় দুই লাখ গাছ লাগানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে কিছু সড়ক ঠিক করা হয়েছে। যেখানে বীর উত্তম এ কে খন্দকার সড়কও রয়েছে। সড়কটিকে সবুজায়নের উদ্যোগ নিয়েছি আমরা। শিগগিরই কাজটি শুরু হবে বলে আশা করছি। তখন এ সড়কটিও সবুজায়ন হবে ইনশাআল্লাহ।

ডিএনসিসি সূত্রে জানা গেছে, ‘ট্রাফিক অবকাঠামো উন্নয়ন ও সড়ক নিরাপত্তা’ প্রকল্পের আওতায় উন্নয়নকাজে এরই মধ্যে প্রায় ২২ কোটি টাকা ব্যয় করেছে ডিএনসিসি। চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, গাছ কাটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। অপ্রয়োজনীয় মিডিয়ান স্ট্রিপ তৈরি করা উচিত নয়। এটি অর্থের সুস্পষ্ট অপচয়ও বটে।

সম্প্রতি বুয়েটের নগর ও আঞ্চলিক পরিকল্পনা বিভাগ জানিয়েছে, ঢাকায় ২০ শতাংশ বন প্রয়োজন, যেখানে এ ধরনের স্থান আছে সাড়ে ৮ শতাংশের কম। সচেতন মহল বলছে, উন্নয়ন প্রকল্পের সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা প্রয়োজন। তাদের বোঝা উচিত গাছ না কেটেও একটি রোড ডিভাইডার তৈরি করা সম্ভব।

বাংলাদেশ প্রকৃতি সংরক্ষণ জোট (বিএনসিএ) সদস্য সচিব মুহাম্মদ আনোয়ারুল হক বলেন, উন্নয়নের নামে এ শহরের যেকোনো গাছ কাটা ও লাগানোর আগে উদ্ভিদবিদদের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। শহরের মানুষগুলোর বাঁচার স্বার্থে গাছ না কেটে আরও বেশি দেশীয় গাছ রোপণ করা প্রয়োজন।

বাংলাদেশ সময়: ১২৩০ ঘণ্টা, জুন ০৩, ২০২৩
এইচএমএস/আরবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

জাতীয় এর সর্বশেষ