ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

সেপটিক ট্যাংকে প্রাণহানি বন্ধে প্রয়োজন আধুনিক প্রযুক্তি

সাগর ফরাজী, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৫৮ ঘণ্টা, জুন ৪, ২০২৩
সেপটিক ট্যাংকে প্রাণহানি বন্ধে প্রয়োজন আধুনিক প্রযুক্তি

সাভার (ঢাকা): প্রযুক্তির উৎকর্ষতার এই যুগে অন্যান্য ক্ষেত্রে এগিয়ে গেলেও আধুনিক কোনো পদ্ধতি না থাকায় গতানুগতিক পদ্ধতিতে সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কার করায় প্রায় ঘটছে মৃত্যুর ঘটনা।  

এই মৃত্যু ঠেকাতে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মতো আইন প্রণয়ন করে মানুষের পরিবর্তে মেশিনের সাহায্যে আধুনিক পদ্ধতিতে সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কার করার পরামর্শ দিয়েছে নগর পরিকল্পনাবিদরা।

দেশে সেপটিক ট্যাংক দুর্ঘটনায় প্রায় ঘটছে মৃত্যুর ঘটনা। কিন্তু দুর্ঘটনা বন্ধে নেই কোনো কার্যকর পদক্ষেপ।  

স্থানীয় সরকার, পল্লি উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার জনস্বার্থ প্রকৌশল অধিদপ্তর ২০১৭ সালে এক পরিপত্র জারি করে। সেই পরিপত্রে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে সেপটিক ট্যাংকের পয়ঃপরিষ্কার ও ব্যবস্থাপনার জন্য উপযুক্ত শ্রমিক বাছাইয়ের জন্য তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা রয়েছে। সেই বাছাইকৃত শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের বিষয়ে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর হতে সহায়তা নেওয়ার কথা বলা হলেও স্থানীয় পর্যায়ে ঘাটতি রয়েছে।

গত ১৫ মার্চ ঢাকার সাভার উপজেলার আশুলিয়ার জামগড়ায় আল রাহমান নামক একটি কারখানায় ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে মানুষের মাধ্যমে সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কার করতে গিয়ে ৩ শ্রমিকের মৃত্যু হয়। নিহতের মধ্যে পয়ঃনিষ্কাশনকর্মী মিঠু (২২), আল রহমান নিট ফ্যাশন বিডি লিমিটেড কারখানার শ্রমিক মোহাম্মদ আলী (৩০) ও রাকিব (২৮)।  

এছাড়া সাভারসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সেপটিক ট্যাংক নেমে মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কারের সময় দুর্ঘটনায় একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে পরিবারগুলো এখন দিশেহারা।

দুর্ঘটনায় নিহত পয়ঃনিষ্কাশনকর্মী মিঠুর বাবা বাংলানিউজকে বলেন, আমার সন্তানের কয়েকদিন পরে বিয়ে করা কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই আল্লাহ তাকে দুনিয়া থেকে নিয়ে গেছে। তাকে হারিয়ে আমার পরিবার এখন চোখে মুখে অন্ধকার দেখছি। সে আমার পরিবারের হাল ধরে রেখেছিল। আজ আমার ছেলেটা নেই। অনেক কষ্ট করে সংসার চালাতে হচ্ছে। আমার মতো কোনো বাবা যেন আর এভাবে ছেলে না হারায়।

গতানুগতিক পদ্ধতিতে কারখানার সেপটিক ট্যাংক দুর্ঘটনায় মৃত্যু এড়ানোর জন্য আধুনিক প্রযুক্তির উদ্ভাবনের দাবি জানান দুর্ঘটনাকবলিত কারখানা কর্তৃপক্ষ। কারখানাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হালিম উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, যদিও নিহতের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিয়েছি। তার পরেও টাকার বিনিময়ে জীবনের মূল্য হয় না। যদি আজকে সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কারে এই ম্যানুয়েল পদ্ধতির পরিবর্তে আধুনিক কোনো পদ্ধতি থাকতো, তাহলে আমরা এই দুর্ঘটনার শিকার হতাম না। আমাদের দুই শ্রমিকসহ মিঠু মারা যেত না।  

এসময় তিনি সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কার করার ক্ষেত্রে ম্যানুয়েল পদ্ধতি পরিহার করে আধুনিক পদ্ধতি প্রয়োগের আহ্বান জানান।

ফায়ার সার্ভিস ঢাকা জোন-৪ এর উপ-সহকারী পরিচালক মো. আলাউদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কার করার পূর্বে সেখানে যদি একটি হারিকেন অথবা মোম জ্বালিয়ে নেওয়া হয়, তাহলে ট্যাংকের ভেতরের অক্সিজেনের কী অবস্থা তা জানা যায়। মোম বা হারিকেন ট্যাংকের ভেতরে জ্বলন্ত অবস্থায় প্রবেশ করানোর পর যদি তা নিভে যায়, তাহলে বুঝতে হবে সেখানে অক্সিজেন নেই। তখন ট্যাংকের ভেতরে নামা যাবে না। তখন বিকল্প পদ্ধতিতে ট্যাংকে নামতে হবে। সেই ক্ষেত্রে পরিচ্ছন্নকর্মীদের যদি প্রশিক্ষণ দেওয়া যায় এবং পরিষ্কার করার বিষয়ে তাদের সচেতন করা যায়, তাহলে আমি মনে করি, ট্যাংক পরিষ্কার করতে গিয়ে প্রাণহানির ঘটনা আর ঘটবে না।  

তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশে এখনো ম্যানুয়ালিই সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কার করা হয়। তবে আধুনিক পদ্ধতিতে ট্যাংক পরিষ্কার করার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।  

ম্যানুয়াল পদ্ধতির পরিবর্তে যান্ত্রিক পদ্ধতি ভ্যাকুয়াম ট্রাকের মাধ্যমে পয়ঃবর্জ্য সংগ্রহ করে পরিষ্কারের ব্যবস্থা থাকলেও এই পদ্ধতি ব্যয়বহুল বলে জানিয়েছেন সাভার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সাভার শাখার সহকারী প্রকৌশলী ফারুক আহমেদ বলেন, জনসচেতনতা না থাকায় ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে অনেক মানুষ মারা যায়। এর জন্য আধুনিক প্রযুক্তি ভ্যাকুয়াম ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে পরিষ্কার করা উচিত। যেহেতু আধুনিক প্রযুক্তি অনেক ব্যয়বহুল, তাই পৌরসভার অন্তর্গত এলাকায় আধুনিক প্রযুক্তি কিনে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কার সার্ভিস দেওয়া যেতে পারে।

এদিকে পার্শ্ববর্তী দেশের মতো বাংলাদেশেও আইন প্রণয়ন করে মানুষের পরিবর্তে মেশিনের সাহায্যে সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কার করা সময়ের দাবি বলে জানিয়েছে নগর পরিকল্পনাবিদরা।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মাদ খান বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কিছু কিছু শহরে মানুষকে প্রতিস্থাপন করে কীভাবে যন্ত্রাংশের মাধ্যমে সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কার রাখা যায়, সেই বিষয়টি প্রয়োগ করা হচ্ছে। সারা ভারতে আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, যেন সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কার করতে কোনো মানুষকে নামানো না হয়। কারণ, ট্যাংকে নেমে অনেক মানুষের মৃত্যু হয়। বাংলাদেশে এখন ট্যাংক পরিষ্কার করতে নেমে মৃত্যুর খবর অহরহ পাওয়া যাচ্ছে।  

তিনি বলেন, সেফটি সামগ্রী ছাড়াই মানুষ ট্যাংকে নেমে যাচ্ছে। সে কারণে ভেতরে থাকা বিষাক্ত গ্যাস মানুষের নিঃশ্বাসের সঙ্গে ফুসফুসে গিয়ে মৃত্যু ঘটাচ্ছে। তাই আমাদের দেশে সময় এসেছে ভারতের মতো আইন করে সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কারে মানুষের ব্যবহার নিষিদ্ধ করার। এছাড়া আমরা চাইলে আধুনিক যন্ত্রের মাধ্যমে সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কার করতে পারি।

বাংলাদেশ সময়: ১১১২ ঘণ্টা, জুন ৪, ২০২৩
এসএফ/এনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।