ঢাকা, মঙ্গলবার, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

লাইটহাউজ প্রকল্পের ৭ কর্মকর্তাকে দুদকে জিজ্ঞাসাবাদ 

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৩৪ ঘণ্টা, জুন ৬, ২০২৩
লাইটহাউজ প্রকল্পের ৭ কর্মকর্তাকে দুদকে জিজ্ঞাসাবাদ 

ঢাকা: নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের ‘এস্টাব্লিশমেন্ট অব গ্লোবাল মেরিটাইম ডিস্ট্রেস অ্যান্ড সেফটি সিস্টেম অ্যান্ড ইন্টিগ্রেটেড মেরিটাইম নেভিগেশন সিস্টেম (ইজিআইএমএনএস)’ প্রকল্পের কাজে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।  

এ কারণে সংস্থার উপ-পরিচালক রতন কুমার দাশকে অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়।

অনুসন্ধানে নেমেই তিনি প্রথম দফায় প্রকল্পের সাত কর্মকর্তাকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন।  

দুদক আইন-২০০৪ এর ২২ ধারা ও দুদক বিধিমালা-২০০৭ এর বিধি ৮/১১ অনুসারে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদের তলব করা হয়। দুদকের নোটিশপ্রাপ্ত প্রকল্পের একাধিক কর্মকর্তা এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।  

এ ছাড়া জিজ্ঞাসাবাদের জন্য প্রকল্প পরিচালক (পিডি) ক্যাপ্টেন আবু সাঈদ মো. দেলোয়ার রহমানকে শিগগির নোটিশ পাঠিয়ে দুদকে তলব করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে জানা গেছে।

আরেকটি সূত্র মতে, আবু সাঈদ মো. দেলোয়ার রহমানকে সহসাই পিডির দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করা হচ্ছে। তার পরিবর্তে উপ-সচিব বা সমমর্যাদাসম্পন্ন প্রশাসনিক ক্যাডার সার্ভিসের কাউকে নতুন পিডি নিয়োগ দিতে পারে সরকার।  

প্রসঙ্গত, ইজিআইএমএনএস প্রকল্পের পরিচালক দেলোয়ার রহমান নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের একজন স্থায়ী নটিক্যাল সার্ভেয়ার।  

দুদক যাদের ইতোমধ্যে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে, তারা হলেন- প্রকল্পের ডেপুটি নটিক্যাল সার্ভেয়ার (ডিএনএস) ক্যাপ্টেন ফরহাদ জলিল বিপ্লব, দুজন সহকারি পরিচালক (এপিডি) রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ ও নাজমুল হোসাইন, জুনিয়র ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ার মোবাশ্বের রহমান ফাহিম, উপ-প্রকল্প পরিচালক (ডিপিডি) ক্যাপ্টেন আবু হায়াৎ আশরাফুল আলম, এপিডি পতিত পবন দাস ও সহকারী ইলেক্ট্রিশিয়ান সাইফুল ইসলাম।  

তাদের মধ্যে সবার আগে ফরহাদ জলিল বিপ্লবকে নোটিশ পাঠিয়ে ২২ মে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা। ১৮ মে নোটিশ পাঠিয়ে ২৩ মে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ, নাজমুল হোসাইন ও মোবাশ্বের রহমান ফাহিমকে।  

সবশেষ ২৮ মে আবু হায়াৎ আশরাফুল আলম, পতিত পবন দাস ও সাইফুল ইসলামকে নোটিশ পাঠানো হয়। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় ৩১ মে। দুদক কর্মকর্তার জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হওয়া প্রকল্পের সাত কর্মকর্তার মধ্যে ডেপুটি নটিক্যাল সার্ভেয়ার ফরহাদ জলিল বিপ্লব, এপিডি পতিত পবন দাস ও সহকারী ইলেক্ট্রিশিয়ান সাইফুল ইসলাম- এ তিনজন পিডি আবু সাঈদ দেলোয়ার রহমানের ঘনিষ্ঠজন বলে গুঞ্জন রয়েছে।  

দক্ষিণ কোরিয়ার ঋণসহায়তা ও বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব তহবিলে চলমান ইজিআইএমএনএস প্রকল্পটি ‘লাইটহাউজ’ প্রকল্প নামেই বেশি পরিচিত। দুই দেশের যৌথ অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে নৌ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সংস্থা নৌ পরিবহন অধিদপ্তর।  

এর আওতায় রয়েছে দেশের বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকায় সাতটি লাইটহাউজ ও সাতটি রেডিও স্টেশনসহ সেখানে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো স্থাপন এবং রাজধানী ঢাকার আগারগাঁওয়ে নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের ১১তলা বিশিষ্ট নিজস্ব কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল (সিঅ্যান্ডসি) ভবন নির্মাণ।  

তবে নৌ পরিবহন খাতের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে শুরু থেকে বিভিন্ন স্তরে সীমাহীন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এমনকি নৌ অধিদপ্তরের সদ্যবিদায়ী মহাপরিচালক কমোডর মো. নিজামুল হক নিজেও পিডি ও কোরিয়ার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এলজি আল সামি কনস্ট্রাকশনের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ তুলেছেন।  

গুঞ্জন রয়েছে, একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধান হয়েও সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য সরাসরি প্রকাশ করায় তাকে মহাপরিচালকের পদ থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।  

এদিকে নৌ মন্ত্রণালয় গঠিত উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে পিডি আবু সাঈদ মো. দেলোয়ার রহমান ও ডেপুটি নটিক্যাল সার্ভেয়ার ফরহাদ জলিল বিপ্লবসহ প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কয়েকজনের পাশাপাশি মূল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সামি কনস্ট্রাকশনের বিরুদ্ধে অনিয়মের সত্যতা পাওয়া গেছে। অধিদপ্তরের সদ্যসাবেক মহাপরিচালকের বিরুদ্ধেও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগের সত্যতা মিলেছে বলেও উল্লেখ করা হয় ওই প্রতিবেদনে। তবে দীর্ঘদিনেও মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়নি।  

এ ছাড়া অধিদপ্তরের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা প্রতিবেদনেও পিডি ও ডেপুটি নটিক্যাল সার্ভেয়ারসহ প্রকল্পের কয়েকজন কর্মকর্তা এবং সামি কনস্ট্রাকশনসহ একাধিক সহঠিকাদারের (সাব-কন্ট্রাক্টর) বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।  

নৌ মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদন ও নৌ অধিদপ্তরের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গণমাধ্যমে ইতোমধ্যে পৃথক পৃথক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া নির্মাণাধীন ১১তলা সিঅ্যান্ডসি ভবনের জন্য ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র জালিয়াতিসহ ভবন নির্মাণে অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়েও প্রথম শ্রেণির বেশ কয়েকটি গণমাধ্যম সরেজমিন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।  

২০১৪ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন পাওয়া ৩৮২ কোটি টাকার এ প্রকল্প ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে সমাপ্ত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শুরু থেকেই অনিয়ম আর কালক্ষেপণের জালে আটকা পড়ে প্রকল্পটি। তিন দফা সংশোধনের মাধ্যমে সময় ও ব্যয় বাড়ানো হয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সর্বশেষ সময় ধরা হয়েছে ২০২৪ সালের ৩০ জুন। আর ব্যয় বাড়িয়ে করা হয়েছে ৭৭৯ কোটি টাকা। ইতোমধ্যে তিনবার পিডি বদল করা হয়েছে।  

জানতে চাইলে এপিডি নাজমুল হোসাইন বলেন, দুদক এ পর্যন্ত মোট সাতজনকে তলব করেছে। আমি ছাড়াও অন্যদের মধ্যে ডিপিডি আশরাফুল আলম ও ডিএনএস ফরহাদ জলিল বিপ্লব আছেন। আপনাকে কেন ডেকেছে- এমন প্রশ্নের জবাবে নাজমুল হোসাইন বলেন, আমার যা বলার, তা অনুসন্ধান কর্মকর্তাকে বলে এসেছি। তবে আমি কোনো অন্যায় করিনি, বরং অন্যায়ের বিরোধিতা করেছি। অথচ বিনা অপরাধে গত ছয় মাস আমার বেতন বন্ধ করে রাখা হয়েছে।
 
দুদকের তলবে অনুসন্ধান কর্মকর্তার দপ্তরে হাজির হওয়ার কথা স্বীকার করেছেন ডিপিডি আবু হায়াৎ আশরাফুল আলম। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, প্রকল্পের যেসব বিল পরিশোধ করা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, সেসব বিলে আমার সই নেই। এ ছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজে যেখানে অসঙ্গতি মনে হয়েছে, সেখানেই আমি আপত্তি দিয়েছি। এজন্য আমার বেতন ছয় মাস বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। তবে বকেয়া বেদন-ভাতা সম্প্রতি পেয়েছি।  

বাংলাদেশ সময়: ১৪২৪ ঘণ্টা, জুন ৬, ২০২৩
টিএ/আরএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।