ঢাকা: ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী মাহবুবা রহমান আঁখি (২৫)। ফেসবুকে সেন্ট্রাল হাসপাতালের গাইনি চিকিৎসক ডা. সংযুক্তা সাহার নরমাল ডেলিভারি সংক্রান্ত ভিডিও ও পরামর্শ দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে তার কাছে নরমাল ডেলিভারি করাতে চেয়েছিলেন।
বুধবার (১৪ জুন) রাতে আলাপকালে আঁখির স্বজনরা জানান, গত শুক্রবার (৯ জুন) প্রসব ব্যথা ওঠায় রাত সাড়ে ১২টার দিকে সেন্ট্রাল হসপিটালে ডা. সংযুক্তা সাহার অধীনে ভর্তি করা হয় মাহবুবা রহমান আঁখিকে। তখন ডা. সংযুক্তা সাহা হাসপাতালে উপস্থিত ছিলেন না, তারপরও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, তিনি আছেন এবং ওটিতে (অপারেশন থিয়েটার) কাজ করছেন।
ভুক্তভোগীর স্বামী ইয়াকুব আলী বলেন, আমার স্ত্রীকে যখন ওটিতে ঢোকানো হয় এবং নরমাল ডেলিভারির জন্য চেষ্টা শুরু করা হয়, তখনও আমি সংযুক্তা সাহা হাসপাতালে আছেন কি না জানতে চাই। কর্তৃপক্ষ জানায়, তিনি আছেন এবং তিনি তার চেষ্টা চালাচ্ছেন। রোগীর কোনো রকম চেকআপ ছাড়াই ডেলিভারির কাজ শুরু করে দেন তারা।
পরে জানতে পেরেছি ডা. সংযুক্তা সাহা ছিলেন না, তিনি তখন দুবাইতে ছিলেন। চিকিৎসক না থাকার পরও তার অধীনে রোগী ভর্তি করা হয়। এরপর ডেলিভারির চেষ্টা ও পরবর্তীতে সফল না হওয়ায় সিজার করে বাচ্চা বের করে আনা হয়। সিজারের পরদিন মারা যায় বাচ্চাটি। আর মায়ের এখনো জ্ঞান ফেরেনি। তাকে ল্যাবএইড হাসপাতালের সিসিইউতে ভর্তি করা হয়েছে। চিকিৎসকরা বলছেন, এ ধরনের রোগীর বাঁচার সম্ভাবনা ৯৯ শতাংশেরও কম।
তিনি আরও বলেন, শুক্রবার রাতে আঁখি সেন্সলেস হয়েছে, এখন পর্যন্ত (বুধবার) তার জ্ঞান ফেরেনি। আজ পর্যন্ত কোনো ইমপ্রুভমেন্ট নেই, ডাক্তার বলেছেন তার ইমপ্রুভমেন্ট হওয়ার সম্ভাবনাও কম। বর্তমানে তার কিডনি, লিভার, হার্ট এবং অন্য কোনো অংশ কাজ করছে না। এর মধ্যে সে ব্রেইন স্ট্রোকও করেছে, তার সঙ্গে রক্তক্ষরণও বন্ধ হচ্ছে না। রক্তক্ষরণ বন্ধ না হওয়ার কারণে শরীরের অন্য অংশগুলো কাজ করতে পারছে না। গত চারদিন ধরে প্রচুর পরিমাণে রক্ত দিতে হচ্ছে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত তার নিঃশ্বাস চলবে ততক্ষণ পর্যন্ত রক্ত দিতে হবে।
তিনি বলেন, রক্তক্ষরণ বন্ধ হওয়ার কোনো উপায় নেই, তাই ডাক্তার বলেছেন এভাবে কতক্ষণ তাকে তারা বাঁচিয়ে রাখতে পারবেন সেটা নিয়ে সন্দেহ আছে। গতকাল এবং আজকেও ল্যাব-এইডের ডাক্তাররা মেডিকেল টিম বসিয়েছেন তাকে কোনো ভাবে বাঁচানো যায় কি না, কিন্তু তারা ব্যর্থ, কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না।
আঁখির স্বামী আরও বলেন, আমি আমার সন্তানকে এরই মধ্যে হারিয়েছি। স্ত্রীর অবস্থা নাজুক। আঁখির যদি কিছু হয়ে যায়, তাহলে আমি বাড়িতে কী নিয়ে ফিরব? সন্তান হারিয়েছি আফসোস নেই, কিন্তু যেকোনো মূল্যে আমি আমার স্ত্রীকে ফেরত চাই।
আঁখির চাচাতো ভাই শাখাওয়াত হোসেন শামীম বাংলানিউজকে বলেন, ফেসবুকে ভিডিও দেখে ডা. সংযুক্তা সাহার কাছে নরমাল ডেলিভারি করাতে চেয়েছিল আমার বোন। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়েছিলেন তার স্বামী। কিন্তু আমার বোনটি এখন লাইফ সাপোর্টে। তার সব অরগান ফেইল করেছে। ডাক্তাররা হয়ত মৃত ঘোষণা করবেন। আর বাচ্চা তো আগেই মারা গেছে।
তিনি বলেন, শুক্রবার (৯ জুন) রাতে আঁখির লেবার পেইন ওঠে। এরপর রাত সাড়ে ১২টার দিকে ডা. সংযুক্তা সাহার অ্যাসিস্ট্যান্টের সঙ্গে ফোনে কথা বলে ঢাকায় আনা হয় আঁখিকে। হাসপাতালে ভর্তির পর নরমাল ডেলিভারির জন্য আঁখিকে ৪০ মিনিট ব্যায়াম করানো হয়।
শামীম বলেন, আমার বোন সুস্থ-স্বাভাবিক ছিলেন। আমরা বাইরে অপেক্ষা করছিলাম। রাত ২টার পর দেখলাম হাসপাতালের লোকজন দৌড়াদৌড়ি করে আঁখিকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর অ্যানেস্থেসিয়ার ডাক্তার আসেন। এরপর আসেন প্রফেসর মিলি। তিনি সিজার করে চলে যান।
যাওয়ার সময় প্রফেসর মিলি জানান, ডা. সংযুক্তা সাহা হাসপাতালে নেই। তখন আমরা জানতে চাইলাম ডাক্তার নেই, তাহলে প্রথম দিকে নরমাল ডেলিভারির জন্য চেষ্টা করালো কে?
আঁখির চাচাতো ভাই আরও বলেন, আমার বোনের ছেলে বাচ্চা হয়েছিল। তাকে রাখা হয়েছিল এনআইসিইউতে। রাত সাড়ে ৩টার দিকে বুঝতে পারি আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। তখন আমরা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলি। হাসপাতালের পক্ষ থেকে সন্তোষজনক কোনো পদক্ষেপ দেখতে না পেয়ে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ এ কল দিলে ধানমন্ডি থানা থেকে পুলিশ আসে। পুলিশ এসে কথা বললে তারা রোগীকে বিএসএমএমইউ’র সিসিইউতে নিতে বলে। কিন্তু সেখানে সিট খালি না থাকায় পরদিন বিকেলে ল্যাবএইডের সিসিইউতে নেওয়া হয়।
মাহবুবা রহমান আঁখি মুমূর্ষু অবস্থায় বর্তমানে ভর্তি আছেন ধানমন্ডির ল্যাবএইড হাসপাতালে। আঁখির শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে ধানমন্ডি ল্যাবএইড হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আরিফ রহমানের বলেন, সর্বশেষ চিকিৎসকরা আমাদের জানিয়েছেন, রোগীর অবস্থা খুবই ক্রিটিক্যাল। আমাদের হাসপাতালে ঠিক যেরকম আনা হয়েছিল, এখনও সেরকমই আছে। শারীরিক অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি।
তিনি বলেন, শনিবার থেকে রোগী সেন্সলেস অবস্থায় আমাদের হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে আছেন। তিনি অধ্যাপক ডা. সোহরাবুজ্জামানের অধীনে চিকিৎসাধীন। আজ মেডিকেল বোর্ডের মিটিং শেষে তার সার্বিক অবস্থা আরও বিস্তারিত জানা যাবে।
এদিকে সেন্ট্রাল হসপিটালের অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর ডা. আফসানা বিনতে গাউস বলেন, এ ঘটনায় আমরা তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। সেই সঙ্গে সেদিন ওটিতে যেসব চিকিৎসক-নার্স উপস্থিত ছিলেন, এমন ১১ জনের সবাইকে বরখাস্ত করা হয়েছে। আজ থেকেই তদন্ত কার্যক্রম শুরু হচ্ছে। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া গেলে ওই দিন আসলে কী ঘটনা ঘটেছিল সেটা আমরা জানতে পারব।
ঘটনার বিষয়ে অধ্যাপক ডা. সংযুক্তা সাহা বলেন, আমি যেহেতু ছিলাম না, তাই আমার নাম করে এই ধরনের কাজ করে থাকলে এটা অবশ্যই অপরাধ। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিনি বলেন, আমাকে বিশ্বাস করে আমার সেবা নিতে বেশ কিছু রোগী আসে। এখন এই রোগীর পরিবার যেহেতু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেক্ষেত্রে তারা অনেক কিছুই বলবে। এ বিষয়ে কথা বলার আগে আমাকে যাচাই-বাছাই করে বলতে হবে। আমি আমার নিজস্ব ফেসবুক পেজ থেকে আগেই জানিয়ে দিয়েছিলাম যে শনি ও রোববার আমি থাকবো না। কারণ অনেক রোগী বিভিন্ন জায়গা থেকে আমার কাছে আসে। অনেক সময় না জানিয়েও তারা চলে আসে। তাই তাদের সুবিধার্থেই আমি এটি আগে জানিয়ে দিয়েছিলাম।
তিনি আরও বলেন, যখন আমি হাসপাতালের বাইরে থাকি, তখন আমার ইমার্জেন্সি রোগীদের দেখতে দুজন অধ্যাপক থাকেন। শুক্রবার সাড়ে ১০টার দিকে আমি হাসপাতালে শেষ সিজার করে বের হই। বের হওয়ার সময় আমি কোনো নতুন রোগী ভর্তি দেখিনি। এরপর হাসপাতালের কারো সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়নি। আমি দুবাইতে পৌঁছানোর পরও দেখতে পাইনি রোগী বা হাসপাতাল থেকে কেউ আমাকে কল দিয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ০৯১২ ঘণ্টা, জুন ১৫, ২০২৩
এমএমআই/আরএ