ঢাকা: বাংলাদেশে কর্মরত জাতিসংঘ ও তাদের উন্নয়ন অংশীদারি সংস্থার একটি যৌথ প্রতিনিধিদল বরিশাল ও খুলনা অঞ্চল সফর করেছে। দলটি জেন্ডার সমতা ও নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিতকল্পে অধিকতর কর্মসূচি নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।
দলটি উল্লেখ করেছে, সাম্প্রতিক সময়ে জেন্ডার সমতা অর্জনে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করলেও জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপক প্রভাবের কারণে খুলনা ও বরিশাল অঞ্চলে বসবাসরত নারীরা অনেক সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন।
বৃহস্পতিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) ঢাকার জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কের অফিস এ তথ্য জানায়। বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারীর অফিসের তত্ত্বাবধানে তিন দিনব্যাপী জেন্ডার সমতা মিশনে জাতিসংঘের পাঁচটি সংস্থা (ইউএন উইমেন, ইউএনএফপিএ, এফএও, ইউনিসেফ, আইএলও) প্রতিনিধিসহ তাদের উন্নয়ন এবং মানবিক সহায়তা দেওয়া অংশীদাররা অংশ নেন।
এই সফর নিয়ে বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইস বলেন, বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নে নানা অগ্রগতি হওয়া সত্ত্বেও, আমরা খুলনা এবং বরিশালের প্রান্তিক নারী ও কিশোরীদের কাছ থেকে তাদের সমস্যার কথা শুনেছি। তারা প্রতিনিয়ত, বিভিন্ন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত বাধার মুখোমুখি হচ্ছে, যা নারীর ক্ষমতায়ন এবং জেন্ডার-ভিত্তিক সহিংসতা দূর করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এক্ষেত্রে, নারী ও মেয়েদের উন্নয়নে আরও কাজ করা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে উন্নয়নে নারীদের সমান অংশীদার করতে হবে।
প্রতিনিধিদলটি জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে জেন্ডার বৈষম্য বা অসমতা মোকাবিলায় পরিচালিত জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রকল্প পরিদর্শন করে এবং এই অঞ্চলের নারী, মেয়ে ও শিশুরা যে সমস্যাগুলোর সম্মুখীন হচ্ছে, তা নিয়ে স্থানীয় লোকজন এবং তাদের সঙ্গে আলোচনা করে।
ইউএন উইমেন বাংলাদেশের কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ গীতাঞ্জলী সিং বলেন, মিশনের প্রতিটি দিন আমরা নারী ও মেয়েদের কাছে থেকে তাদের সংকল্প ও সাহসিকতার কথা শুনেছি। যখন নারীর ক্ষমতায়নের অগ্রগতি ঊর্ধ্বমুখী, তখন আমরা এখানে দেখছি জেন্ডার নিয়ে নানা পুরোনো নিয়মাচার-কানুন মেয়েদের মধ্যে থাকা সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে বাধাগ্রস্ত করছে। জেন্ডার সমতার জন্য একটি সুন্দর পরিবেশ তৈরিতে পরিবর্তনের অংশীদার হিসেবে, যুবক, তরুণ ও কিশোরদেরও একইসঙ্গে কাজ করা অত্যন্ত জরুরি।
বরিশাল ও খুলনা অঞ্চলে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা ও তাদের অংশীদাররা জেন্ডার সমতার পরিস্থিতি উন্নয়নে, নারীদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন দিক এবং আর্থ-সামাজিক সমস্যাগুলো মোকাবিলায় নানামুখী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে আসছে। উদাহরণস্বরূপ, ইউএন উইমেন জাতীয় পর্যায়ে নারীদের অধিকার প্রচারে, এবং নারী ও মেয়েদের বিরুদ্ধে জেন্ডার-ভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধে নীতি ও আইনের বাস্তবায়নে জোরালো ভূমিকা পালন করছে। ইউএন উইমেন জেন্ডার-সহায়ক, মানবাধিকার-ভিত্তিক ,জলবায়ু কার্যক্রমের জন্য বিদ্যমান পরিকল্পনা এবং নীতিগুলো বাস্তবায়নের জন্য, পদ্ধতি এবং জেন্ডার রেসপনসিভ তথ্য ব্যবহার করছে। ।
আইএলও বাংলাদেশ অফিস, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতায়, শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী পরিবেশগতভাবে সচেতনতা, অন্তর্ভুক্তি, এবং আন্তঃসংযুক্ত শিক্ষা ও দক্ষতার উন্নয়ন ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মাধ্যমে তরুণদের উন্নত কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াতে কাজ করছে।
আইএলও বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর টুওমো পোটিআইনেন বলেন, আমরা কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে দক্ষতা উন্নয়নে সহায়তা প্রদান এবং কর্মক্ষেত্রে সহিংসতা ও হয়রানি যাতে না হয়, তা নিশ্চিত করার জন্য নিয়োগকর্তা এবং শ্রমিকদের সংগঠনের সঙ্গে কাজ করছি, যাতে নারীরা তাদের সম্ভাবনাকে সর্বোচ্চ এবং কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের নারীরা শ্রমবাজারের চাহিদা মোতাবেক প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনে পিছিয়ে আছে, যা আংশিকভাবে শ্রমবাজারে তাদের কম অংশগ্রহণের জন্য দায়ী। বিষয়টিকে বিবেচনায় নিয়ে আইএলও খুলনা মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের মতো কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ (টিভিইটি) ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে নারীদের দক্ষতা উন্নয়নে সহায়তা করে আসছে, যাতে পুরুষদের পাশাপাশি একই পদে কাজের জন্য নারীরা প্রতিযোগিতা করতে সক্ষম।
জাতিসংঘের খাদ্যও কৃষি সংস্থা মৎস্য, কৃষি ও জলজ কৃষি নীতির সঙ্গে সম্পর্কিত জলবায়ু পরিবর্তন এবং জেন্ডারভিত্তিক সমস্যাগুলো নিয়ে কাজ করে। এই সংস্থার সহকারী প্রতিনিধি নুর আহমেদ খোন্দকার বলেন, আগে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে নারীদের কথা শোনা হতো না। কিন্তু এখন নারীরা কমিউনিটি-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে নেতৃত্ব দিচ্ছে, জলজ চাষ প্রকল্পের মালিকানা নিচ্ছে, পাইকারি বাজার ব্যবস্থাপনাসহ সক্রিয়ভাবে মাছ চাষে অংশ নিচ্ছে। নারীর ক্ষমতায়ন তাদের পারিবারিক অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনছে, সঙ্গে জলবায়ুর পরিবর্তন মোকাবেলায় সাহায্য করছে।
জাতিসংঘের এ মিশনের কেন্দ্রবিন্দুই হলো জেন্ডার-ভিত্তিক সহিংসতা (জিবিভি) রোধে পদক্ষেপ নেওয়া এবং শিশু ও নারীদের স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করা। জাতিসংঘের শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) খুলনা এবং বরিশাল বিভাগে জিবিভি, বিশেষ করে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে চাইল্ড প্রোটেকশন কমিউনিটি হাব প্রতিষ্ঠা করেছে, যেখানে সচেতনতামূলক সেশন, সমাজকর্মীদের রেফারেল সহায়তা, জাতীয় হেল্পলাইন এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সেবা দেওয়া হয়।
ইউনিসেফ বাংলাদেশের প্রতিনিধি শেলডন ইয়েট বলেন, দেশে বাল্যবিবাহের মতো ক্ষতিকর প্রথা প্রতিরোধে শিশু সুরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সহিংসতার মৌলিক কারণগুলো এবং সামাজিক রীতিনীতিগুলো বোঝা এবং সহিংসতা মোকাবিলায় অগ্রাধিকার দিতে হবে। এক্ষেত্রে কিশোর-কিশোরীদের এবং তাদের কমিউনিটিকে শক্তিশালী করতে হবে। যাতে তারা সামাজিক পরিবর্তনের এজেন্ট হিসেবে কাজ করতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে।
ইউএনএফপিএ জেন্ডার-ভিত্তিক সহিংসতার ঘটনায় মাল্টি-সেক্টরাল সেবা দেওয়া মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিবাহিত ও অবিবাহিত কিশোরীদের সম্পৃক্ত করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে।
ইউএনএফপিএ কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ ক্রিন্টিন ব্লোখুস বলেন, জেন্ডার সমতা ও নারীর ক্ষমতায়নের অভাবনীয় অগ্রগতি সত্ত্বেও বরিশাল ও খুলনার মতো অঞ্চলেও অসংখ্য নারী ও তরুণীরা প্রতিনিয়তই বাল্যবিবাহসহ শারীরিক, মানসিক ও যৌন সহিংসতার মতো ঘটনার শিকার হচ্ছে। আমাদের অবশ্যই জেন্ডার-ভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধে ও প্রতিকারে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করতে হবে। এজন্য নারী ও কিশোরীদের শিক্ষা, দক্ষতার উন্নয়ন ও কাউন্সিলিং সেবার প্রাপ্তি নিশ্চিত করা হবে।
সফরটি মূলত বাংলাদেশে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন সহযোগিতা কাঠামো (ইউএনএসডিসিএফ) ২০২২-২০২৬ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে পরিচালিত হয়। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল জেন্ডার সমতা এবং জেন্ডার-ভিত্তিক সহিংসতা নির্মূলসহ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অগ্রগতি ত্বরান্বিত করা।
বাংলাদেশ সময়: ১৮০১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৮, ২০২৩
টিআর/আরএইচ