ঢাকা, মঙ্গলবার, ২০ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

সাভারে অপরিকল্পিত নগরায়ণে পানির স্তর ১৫৬ ফুট নিচে

সাগর ফরাজী, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮২৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ২১, ২০২৩
সাভারে অপরিকল্পিত নগরায়ণে পানির স্তর ১৫৬ ফুট নিচে

সাভার (ঢাকা): ঢাকার সাভার উপজেলায় নতুন করে সংকট তৈরি হয়েছে ভূগর্ভস্থ পানি স্তর নিয়ে। এতে এ অঞ্চলের ইকো সিস্টেম নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

গবেষকরা বলছেন এখনই এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেওয়া হলে মারাত্মক সংকটে পড়বে এ অঞ্চলের মানুষ।  

বিভিন্ন তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত ৭ বছরের ব্যবধানে এলাকাভেদে এ অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গেছে ১৫৬ ফুট পর্যন্ত, যেখানে এর আগে এ স্তর ছিল গড়ে ৫৬ দশমিক ৬৭ ফুট। এছাড়া এ অঞ্চলের পানির বিশাল চাহিদার একমাত্র উৎস ভূগর্ভস্থ পানিতেও ইঙ্গিত মিলেছে দূষণের, যা আশঙ্কাজনক বলছেন গবেষকরা।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০১৬ সালে সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়নের ৪টি পয়েন্টে ভূগর্ভস্থ পানির স্থিতিয় তলের পরিমাপ ছিল যথাক্রমে, ৬৫ ফুট ৬ ইঞ্চি, ৭৮ ফুট ৬ ইঞ্চি, ৬৯ ফুট ৪ ইঞ্চি ও ৬৫ ফুট ৮ ইঞ্চি। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে করা জরিপে দেখা গেছে, এ এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্থিতিয় তলের পরিমাপ ছিল সর্বনিম্ন ৯৫ ফুট।

 

এদিকে ২০২২ সালে করা জরিপে উঠে এসেছে একই এলাকায় এ তল গিয়ে ঠেকেছে যথাক্রমে ১৫৬ দশমিক শূন্য ৩ ফুট, ৯২ দশমিক শূন্য ২ ফুট, এবং ৮৭ ফুট।

এছাড়া ২০২১ সালে উপজেলার আশুলিয়া ইউনিয়নে ভূগর্ভস্থ পানির সর্বনিম্ন তল ছিল ৮৫ ফুট, বনগ্রাম ইউনিয়নে ৭৫ ফুট, ভাকুর্তায় ৪০ ফুট, ধামসোনা ইউনিয়নে ৫০ ফুট, কাউন্দিয়া ইউনিয়নে ৭৫ ফুট, পাথালিয়া ইউনিয়নে ৭৫ ফুট, পৌর এলাকায় ৭০ ফুট, শিমুলিয়ায় ৫০ ফুট, তেঁতুলঝোড়া ৪০ ফুট, ইয়াপুর ইউনিয়নে ৯৫ ফুট ও সাভার ইউনিয়নে ৭০ ফুট।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী বশির আহম্মেদ বলেন, সাভার এলাকায় গত ৬ মাস আগে নলকূপ স্থাপনের জন্য যেখানে আমরা ১২০ ফুট হাউজিং এর ডিজাইন দিয়ে কার্যাদেশ দিয়েছি, সেসব এলাকায় মাত্র ৬ মাসের ব্যবধানে ঠিকাদাররা জানাচ্ছেন এটি আরও ৪০ ফুট বাড়িয়ে অন্তত ১৬০ ফুট করতে হবে। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, কতটা দ্রুত এ ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে, এবং আমার অবজারভেশন হচ্ছে আগামী ৫ বছর পর এটি অন্তত ৪০০ থেকে ৪৫০ ফুটে গিয়ে দাঁড়াবে।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের গ্রাউন্ড ওয়াটার হাইড্রোলজি বিভাগের পরিচালক ড. আনোয়ার জাহিদ বলেন, পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় আমাদের দেশে বিদ্যমান আইন থাকলেও দূর্ভাগ্যজনকভাবে এর বাস্তবায়ন হয়তো আমরা সেভাবে করতে পারিনি। আইন অনুযায়ী, জাতীয় থেকে জেলা-উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত এ সংক্রান্ত কমিটি করে দেওয়া আছে, যাদের দায়িত্ব ভূগর্ভস্থ পানির অবস্থা অ্যাসেস করে সিদ্ধান্ত নেওয়া যে কেউ যদি পাম্প বসিয়ে পানি নিতে চায়, তাকে ওই কমিটি থেকে অনুমোদন নিতে হবে। কেউ যখন পানির জন্য আবেদন করবে, কমিটি তখন যাচাইবাছাই করে দেখবে তাকে দেওয়ার মতো পানি আছে কিনা, এবং কতটুকু দেওয়া যাবে।

তিনি বলেন, গত ৫০ বছরের রেকর্ডে আমরা দেখেছি ঢাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমেছে ৭০ মিটার পর্যন্ত, ঢাকার আশপাশে যা অন্তত ২৫ থেকে ৩০ মিটার। ঢাকার ১০০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে যেসব এলাকা আছে, শিল্পায়নের ফলে, এমনকি ধামরাই পর্যন্ত, এসব এলাকায় ক্রমাগত পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। বর্ষা মৌসুমে কিছুটা রিচার্জ হয়, কিন্তু তা আগের অবস্থায় ফিরে যায় না, সুতরাং এটি স্পষ্ট যে এসব এলাকায় যে পরিমাণ পানি উত্তোলন করা হচ্ছে, সেই পরিমাণ রিচার্জ হচ্ছে না। ফলে একটা সময় যেটা হতে পারে পানির ফ্রেস ওয়াটার সংকট দেখা দিতে পারে, আর এটা হওয়া মানে হচ্ছে আর্থ সামাজিক অবস্থায় প্রভাব পড়বে, যেটা মিরসরাইতে ইন্ডাস্ট্রিয়াল লোকদের সঙ্গে স্থানীয়দের পানি নিয়ে ঝামেলা শুরু হয়েছে, নর্থ বেঙ্গলে বহু আগেই সেচকারীদের সঙ্গে গ্রামবাসীদের সমস্যা হচ্ছে। আর পরিবেশগত যেই বিষয়টি হতে পারে যে আমাদের রিসোর্সের মজুদ কমে যাচ্ছে, পানির মান প্রভাবিত হতে পারে।

ড. আনোয়ার জাহিদ বলেন, আইনে প্রায়োরিটির কথা বলা আছে প্রথম খাবার পানি, দ্বিতীয় গৃহস্থালি, তৃতীয় হচ্ছে কৃষি, তারপর একোয়া কালচার। অর্থাৎ আমরা খাদ্য নিরাপত্তা ঠিক থাকার পর আমাকে দেখতে হবে আমার পরিবেশ ঠিক আছে কিনা, ইকো সিস্টেম ঠিক আছে কিনা। যদি খাবার পানি এবং ফুড সেফটির পর পানি বর্ষাকালে সঠিক লেভেলে ফিরে আসে, তবেই আপনি শিল্প কলকারখানার জন্য অনুমোদন দিতে পারবেন। কিন্তু ঢাকার আশপাশে তো ২০০৪ সালের পর থেকেই ক্রমাগত পানির স্তর হ্রাস হচ্ছে, সুতরাং এ সময়ের পর তো এ এলাকায় কলকারখানাকে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের অনুমোদনই দেওয়ার কথা না, কিন্তু আমরা নিজেরাই আইন করছি, আমরাই আবার অনুমোদন দিচ্ছি।

সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্সের এক শিক্ষার্থীর করা গবেষণায় দেখা গেছে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার ১২টি পয়েন্টের ভূগর্ভস্থ পানি পরীক্ষা করে উচ্চমাত্রায় কেমিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড পাওয়া গেছে। এছাড়াও এতে বিভিন্ন হেভি মেটাল যেমন সিসা , ম্যঙ্গানিজ, ক্রোমিয়াম, নিকেল, আয়রন যে মাত্রায় পাওয়া গেছে সেটিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও দেশের পরিবেশ অধিদপ্তরের স্ট্যান্ডার্ড ভ্যালুর চেয়ে অনেক বেশি, যা ছিল যথাক্রমে ৫.৩২৫৮, ১১৩.৫৬৭, ৪.৮৭৪১৬৭, ২.২১৩, ৯৯০.৮১ পিপিএম।

বিশ্লেষকরা বলছেন, পানিতে এমন উচ্চ মাত্রা হেভি মেটালের অস্তিত্ব পাওয়ার অর্থ এটি মারাত্মকভাবে জনস্বাস্থের জন্য হুমকি তৈরি করতে পারে। এছাড়া উচ্চ মাত্রায় কেমিক্যাল অক্সিডেন্ট ডিমান্ড থাকার অর্থ হচ্ছে কোনো না কোনোভাবে ভূগর্ভস্থ পানির সঙ্গে ক্ষতিকারক রাসায়নিক মিশ্রিত হচ্ছে, এটি বিভিন্নভাবেই হতে পারে, তবে এটি স্পষ্ট যে এটি জনস্বাস্থ্য ও জলজ পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

এর আগে ২০১৯ সালের অক্টোবরে একটি আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের এক গবেষণায় দেখা গেছে, এ অঞ্চলের ২১ শতাংশ এলাকার ভূগর্ভস্থ পানি দূষণের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে, এছাড়া ৪৫ শতাংশ এলাকা মাঝারি ঝুকিপূর্ণ। শিল্পাঞ্চল এ উপজেলার দূষণের জন্য ঝুকিপূর্ণ জলাধারগুলোকে চিহ্নিত করতে করা এ গবেষণায় বলা হয়েছিল, এখানকার ভূগর্ভস্থ পানির গুণগত মান সেসময় নির্ধাারীত সীমার মধ্যে থাকলেও ঝুঁকির মুখে থাকা ভূগর্ভস্থ জলাধারগুলোর পানি আরও দূষিত হবে না সেই ঝুঁকি উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যলয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার ভূগর্ভস্থ পানিতে উচ্চ মাত্রায় ক্যামিকেল অক্সিজেন ডিমান্ড ও হেভি মেটাল পাওয়ার অর্থ হচ্ছে এখানে কোনো না কোনোভাবে পানিতে ক্ষতিকারক রাসায়নিক মিশ্রিত হচ্ছে। এটি বিভিন্ন উপায়ে হতে পারে, তার মধ্যে যেহেতু বুড়িগঙ্গার পর এখন পার্শ্ববর্তী নদ-নদীগুলো প্রবাহও কমে যাচ্ছে, সুতরাং কোথায় যদি ক্ষতিকারক রাসায়নিক বা শিল্পবর্জ্য স্থবির হয়ে থাকতে পারে এবং সেখানে যদি অগভীর কোনো রাস্তা থাকে সেই পানি ভূগর্ভে প্রবেশ করার, তাহলে ভূগর্ভস্থ পানি দূষণের কবলে পড়তে পারে। এছাড়াও আমরা অনেক সময় শুনে থাকি বিভিন্ন শিল্প কলকারখানা তাদের তরল বর্জ্য ফোর্স ইনজেকশনের মাধ্যমে ভূগর্ভে রিলিজ করছে, সুতরাং এটি যদি সত্য হয়, তা হলে তো বলার অপেক্ষা রাখে না সেটি কতটা ভয়াবহ হতে পারে।  

অন্যদিকে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমশই নিচের দিকে নেমে যাওয়া প্রসঙ্গে এ গবেষক বলেন, দেখুন, সাভারে এটি এখনও সম্পূর্ণ অনিয়ন্ত্রিত। এখানকার কর্তৃপক্ষ হয়তো জানেই না যে, তাদের এলাকায় ঠিক কি পরিমাণ এ প্রাকৃতিক সম্পদ আছে ! সুতরাং আমি যদি না জানি যে মাটির নিচে ঠিক কি পরিমাণ পানি আছে, কি অবস্থায় আছে, অথচ দেদার যে যার মতো করে ইচ্ছেমতো পানি তুলে ব্যবহার করছে, আমি নতুন করে আরও কারখানা স্থাপনের অনুমতি দিচ্ছি, তাহলে এ পরিস্থিতি তৈরি হবে এটাই তো স্বাভাবিক।

তিনি বলেন, আমি মনে করি, এখনই অনতিবিলম্বে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যারা আছেন, তাদের উচিত এ অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানির অ্যাসেসমেন্ট ও তার মান যাচাই করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া। যদি সেটি অ্যাসেস করে মনে হয়, আমরা চাহিদা অনুযায়ী আরও কারখানা এখানে স্থাপনের অনুমতি দিতে পারি, তাহলে সেই মোতাবেক তারা কাজ করবে। মোট কথা হচ্ছে আমাকে জানতে হবে আমার কি পরিমাণ সম্পদ আছে, এবং আমি কিভাবে সেটি ব্যবহার করবো। তা না হলে এখন আমরা বিভিন্ন দেশে যেমন সিংক হোল, ভূমি ধসের কথা শুনি, এখানেও সেই পরিস্থিতি তৈরি হবে। কেননা, পানির যেই টেবিল, এখানে যেই পরিমাণ পানি উত্তোলন করা হচ্ছে সেই পরিমাণ যদি রিচার্জ না হয়, তাহলে পানির স্তর নিচে নামবে, এবং একটা সময়ে সেই যে গ্যাপটা তৈরি হচ্ছে, সেখানে একটা ধসের আশঙ্কা তৈরি হবে।

এদিকে রাজধানীর পার্শ্ববর্তী শিল্পাঞ্চল খ্যাত গুরুত্বপূর্ণ এ উপজেলায় দিনে দিনে ভূগর্ভস্থ পানি নিয়ে সংকট তৈরি হলেও সহস্রাধিক শিল্প কলকারখানা ও লাখ লাখ মানুষের বসবাস এ উপজেলায় ব্যক্তি ও কলকারখানা পর্যায়ে প্রতিদিন কি পরিমাণ পানি ভূগর্ভ থেকে উত্তোলন করা হচ্ছে সে তথ্য নেই কারো কাছে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৮২৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ২১, ২০২৩ 
এসএফ/জেএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।