পাবনা (ঈশ্বরদী): ব্রিটিশ আমলে ইটের মাঝে চুন-সুরকির গাঁথুনি দিয়ে নির্মিত ঈশ্বরদী-ঢাকা রেলপথের পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার দিলপাশার ইউনিয়নে চলনবিলের মধ্যে ছয় স্প্যান বিশিষ্ট পাঁচ পিয়ারের ৩৪৮ ফুট লম্বা রেলওয়ে গার্ডার ব্রিজ নির্মিত করা হয়েছিল। ১০৯ বছর আগের এ ব্রিজটি নির্মাণের পর আর সংস্কার হয়নি।
ব্রিজের গাঁথুনির চুন-সুরকির গুণাগুণ নষ্ট হয়ে গোটা ব্রিজে ফাটল ধরেছিল। ফলে ট্রেন অতিক্রমের সময় কেঁপে উঠতো ব্রিজটি। গার্ডার ব্রিজে অস্থায়ী রেললাইন সরিয়ে স্থায়ী রেললাইন বসানোর মধ্য দিয়ে সংস্কার কাজ শেষ হয়েছে।
শুক্রবার (৭ জুন) ভোরে ভাঙ্গুড়া উপজেলার দিলপাশার ইউনিয়নে কুড়াগাছা গ্রামের (সিরাজগঞ্জ-উল্লাপাড়া) সেকশনের মাঝে ২৬ নম্বর গার্ডার ব্রিজে অস্থায়ী সিসিক্লাভে থাকা রেললাইন সরানো হয়।
এরপর নতুন ঢালাই করা পিয়ারের ওপর বেডব্লকে ৪৪৮ ফুট লম্বা রেলওয়ে ব্রিজে রেললাইন বসানো হয়। পরে রাজশাহী থেকে আসা ঢাকাগামী ৭৫৪ নম্বর আন্তঃনগর সিল্কসিটি এক্সপ্রেস পারাপার করা হয়।
এদিন ভোর সাড়ে ৫টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২ পর্যন্ত টানা সাড়ে সাত ঘণ্টায় দেড় শতাধিক রেল কর্মচারীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে এ কাজ সম্পন্ন হয়।
জানা যায়, চার কোটি ৪৪ লাখ টাকা ব্যয়ে ছয় মাসের প্রকল্পের কাজ দুই মাস ৮ দিনে শেষ হয়েছে। এ গার্ডার ব্রিজ দিয়ে মৈত্রী এক্সপ্রেস সহ ২১ জোড়া আন্তঃনগর যাত্রীবাহী ট্রেন, এক জোড়া মেইল ট্রেন এবং এক জোড়া মালবাহী ট্রেন ৯০ কিলোমিটার গতিতে চলবে।
গুরুত্বপূর্ণ ২৬ নম্বর গার্ডার ব্রিজ বেশ ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ের প্রকৌশল বিভাগ ডেডস্টপ ঘোষণা করে। পরে অস্থায়ী রেললাইন তৈরি করে শূন্য কিলোমিটার গতিতে ট্রেন থামিয়ে ১০ কিলোমিটারে ব্রিজের ওপর দিয়ে ট্রেন চলাচল চালু রাখে।
এর আগে রোববার (৩১ মার্চ) শত বছরের বেশি পুরোনা ওই গার্ডার ব্রিজের আরসিসি বেডব্লক ও পিয়ারগুলো সম্পূর্ণ ভেঙে জ্যাকেটিং ঢালাই করে অস্থায়ী রেললাইন তৈরি করে সংস্কার কাজ চলমান রাখা হয়।
সংস্কার কাজের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান আরটিসির প্রকৌশলী আলমগীর কবির জানান, ব্রিটিশ আমলে ইটের মাঝে চুন-সুড়কি এবং ভাতের মাড় দিয়ে নির্মিত গার্ডার ব্রিজের ওপর দিয়ে অতিরিক্ত ভারী ট্রেন চলাচলের কারণে চুন-সুড়কির গুণাগুণ নষ্ট হয়ে ছাইয়ের মত হয়ে গিয়েছিল। ব্রিজের পায়ারে এবং বেডব্লকে ফাটল ধরেছিল। এই রুটে ট্রেন চলাচল যেন বিঘ্ন না ঘটে সেজন্য সিসিক্লিভ (লোহার অ্যাঙ্গেল) দিয়ে অস্থায়ী রেললাইন তৈরি করে সংস্কার কাজ চলে।
তিনি আরও জানান, ২৬ নম্বর গার্ডার ব্রিজের নিচে ৬০ ফুট গভীরতা ছিল। মাটি দিয়ে ভরাট করে ব্রিজের নিচের গোড়া থেকে ৩৪ ফুট উঁচু দুটি এ্যাবাটমেন্ট ও পাঁচটি পিয়ারের ফুট ভেঙে প্রতিদিন দেড় শতাধিক শ্রমিক জ্যাকেটিং আরসিসি ঢালাই করে নতুন বেডব্লক সংস্কার করতে ৬৮ দিন সময় লাগে।
পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী শিপন আলী বাংলানিউজকে জানান, ১০৯ বছর আগে গার্ডার ব্রিজটির কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে। তাই সম্পূর্ণ নতুনরূপে সংস্কার করা হলো। এই রেলপথ দিয়ে আন্তঃদেশীয় মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনসহ উত্তর-দক্ষিণাঞ্চলের ২২ জোড়া আন্তঃনগর ট্রেন চলাচল করে। সংস্কার কাজের আগে সকল ট্রেন ব্রিজে এসে শূন্য কিলোমিটার গতিতে থেমে যেত। পরে ওপিটিতে (ট্রেন চালকের স্বাক্ষর) করিয়ে ১০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেনগুলো পারাপার হতো। ডেডস্টপ তুলে একমাস পর থেকে এই রুটে ৯০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলাচল করবে।
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে প্রকৌশলী-২ বীরবল মণ্ডল বাংলানিউজকে জানান, ব্রিটিশ আমলের আগে পাকশীতে পদ্মা নদীর ওপর দিয়ে ‘হার্ডিঞ্জ ব্রিজ’ নির্মাণের পর ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ রেলপথ নির্মিত হয়েছিল। এসময় ওই রেলপথ নির্মাণকালে ৪৯টি রেলওয়ে গার্ডার ব্রিজ তৈরি করা হয়। তার মধ্যে ৪৫টি গার্ডার ব্রিজ রয়েছে। ব্রিজগুলো ব্রিটিশ আমলে নির্মিত হলেও এখনও ২৫ টন এক্সেল লোড নেওয়ার ক্ষমতা ছিল। কিন্তু শতবছর অতিবাহিত হওয়ার কারণে ব্রিজ দিয়ে অতিরিক্ত ভারী ট্রেন চলাচলের কারণে গার্ডার ব্রিজের পিয়ার, বেডব্লক ফাঁটল ধরে ব্রিজ অতিক্রম করার সময় ট্রেন কেঁপে উঠতো।
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান প্রকৌশলী আসাদুল হক আসাদ বাংলানিউজকে জানান, মানুষ এখন ট্রেনে চড়তে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। ভ্রমণপ্রিয় ট্রেনের যাত্রীরা নিরাপদে নিজ গন্তব্যস্থলে যেন পৌঁছাতে পারে সেই লক্ষ্যে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের প্রকৌশল বিভাগ কাজ করছে।
তিনি আরও বলেন, রেলবান্ধব প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার রেলপথ মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন, রেলপথে কোনো ঝুঁকিপূর্ণ ব্রিজ থাকবে না। ব্রিজগুলো সংস্কার করার জন্য আদেশ দিয়েছিলেন তিনি। সেই মোতাবেক রেলপথ মন্ত্রণালয় সেতুগুলো পুনর্নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাঁচটি ব্রিজের সংস্কার কাজ শেষ। কিছু চলমান রয়েছে।
এসময় উপস্থিত ছিলেন- পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী লিয়াকত শরীফ খান, পাকশী বিভাগীয় ব্যবস্থাপক (ডিআরএম) শাহ সুফী নুর মোহাম্মদ সেতু প্রকৌশলী আব্দুর রহিম, পাকশী বিভাগীয় প্রকৌশলী-২ বীরবল মণ্ডল, পাকশি বিভাগীয় রেলওয়ের সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী, শিপন আলী, সহকারী সেতু প্রকৌশলী জুয়েল মিয়া, ঊর্ধ্বতন উপ-সহকারী প্রকৌশলী (পথ) আহসানূর রহমান, ঊর্ধ্বতন উপ-সহকারী (ব্রিজ) হাসান আলী, ঊর্ধ্বতন উপ-সহকারী প্রকৌশলী (কার্য) আতিকুর রহমান, ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান আরটিসির প্রকৌশলী আলমগীর কবীরসহ রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী।
জানা যায়, ১৯১৬ সালে ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ রুটে ট্রেন চলাচল শুরু হয়। ১৯৯৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর উত্তর-দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা পরিবর্তনের কথা চিন্তা করে যমুনা নদীর ওপর ‘বঙ্গবন্ধু সেতু’ নির্মাণের পরপর সেতুর ওপর দিয়ে রেললাইন চালু করেন। ২০০৮ সালে পুনরায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ‘বঙ্গবন্ধু সেতু’র ওপর দিয়ে ব্রডগেজ-মিটারগেজ রেললাইন তৈরি করে। উত্তর-দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে চলাচলকারী ৪৪টি ট্রেন সপ্তাহের একদিন ব্যতীত প্রতিদিন যাতায়াত করে।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৫ ঘণ্টা, ৭ জুন ২০২৪
এসএম