খুলনা: কোটাবিরোধী আন্দোলনে ছাত্ররাজনীতিমুক্ত খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবি) শিক্ষার্থীরাও ছিলো সোচ্চার। ১ জুলাই থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন কোটা সংস্কারের কর্মসূচি পালন করা হয় খুলনায় এর নেতৃত্ব দেয় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
১৬ জুলাই ছিলো এই আন্দোলনের টার্নিং পয়েন্ট। রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হন। সেদিনই আন্দোলন তীব্র রূপ নেয়। সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অগ্নিগর্ভ হয়ে পড়ে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জিরোপয়েন্টসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থান করে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। পুলিশের সাথে কয়েক দফা বাদানুবাদ, লঠিচার্জ উপেক্ষা করে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন কর্মসূচি চালিয়ে যায়। এক পর্যায়ে সরকার বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগের নির্দেশ দেয়। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হল ত্যাগ করলেও রাজপথ ছাড়েনি। তবে হল ত্যাগের নির্দেশের ফলে আটকে পড়ে দূরবর্তী জেলার শিক্ষার্থীরা। রাস্তায় গাড়ি চলাচল বন্ধ, কারফিউ।
এ অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদেরকে বাড়ি পৌঁছে দিতে সাহসী পদক্ষেপ নেয়। খুলনা থেকে ঠাকুরগাঁও পর্যন্ত রুটে সব জেলার শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস, মাইক্রোবাস ও অ্যাম্বুলেন্সে করে পৌঁছে দেওয়া হয়। অনুরূপ বরিশাল রুটের জন্য ব্যবস্থা করা হয়। ক্যাম্পাসে থাকতে না পারলেও এসময় বাইরের জেলার অনেক শিক্ষার্থীদের পাশে মৎস্য খামারের গেস্ট হাউজে থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। বিদেশি শিক্ষার্থীদের নিয়ে ছিলো বেশি উদ্বেগ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল অফিসের পরিচালক প্রফেসর সেহরীশ খান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের সাথে আলাপ করে সাহসের সাথে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেন। বিদেশি বিশেষ করে নেপালি শিক্ষার্থীদের বাংলাবান্ধা সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করেন।
গত ২ আগস্ট সারাদেশের মধ্যে খবর হয় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজের শিক্ষার্থী ও জনতার বিশাল মিছিল পুলিশের বাধা উপক্ষো করে শিববাড়ি থেকে জিরোপয়েন্ট চলে আসে। এই মিছিল শহরমুখী হতে চাইলে শত শত সশস্ত্র পুলিশ বাধা দেয়। পুলিশ সর্বশক্তি নিয়োগ করে। টিয়ারগ্যাস, লাঠিচার্জ, জলকামান, রাবার বুলেট, গুলি ছুঁড়লে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। মুহুর্মুহু শব্দে প্রকম্পিত হতে থাকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এলাকা। এমন সময় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থান করে উদ্বিগ্ন সময় কাটিয়েছেন উপাচার্য। যেভাবে মাত্র দুইশ গজ দূরের বাংলো থেকে সংঘর্ষ দেখেছেন তাতে গভীরভাবে চিন্তিত হয়ে পড়েন জীবনের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কায়।
উপাচার্য কোটা আন্দোলনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কঠিন অবস্থার মুখেও সাহসের সাথে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে দেননি কোনো পুলিশ, হতে দেননি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। ক্যাম্পাসে যাতে পুলিশ না ঢোকে সেজন্য সেই কঠিন চাপের মুখেও তিনি ছিলেন অনড়। এসময় একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস ভাইরাল হয়। তাতে দেখা যায় উপাচার্য প্রফেসর মাহমুদ হোসেন অফিসে বসার একটি ছবির সাথে নীচে লেখা ‘খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কোনো পুলিশ ঢোকবে না, এখানে আমিই প্রশাসন’। এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মনোবল আরও চাঙ্গা করে। এদিনের পর পুলিশ কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। এ খবর শোনার পরপরই উপাচার্য ছাত্রবিষয়ক পরিচালকের দপ্তরকে থানায় পাঠান। নিজে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ ( কেএমপি) কমিশনারসহ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে তার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ছেড়ে দেওয়ার কথা বলেন। ছাত্র বিষয়ক পরিচালকের দপ্তরের পরিচালক ও সহকারী পরিচালকদেরকে নির্দেশনা দেন যতক্ষণ শিক্ষার্থীদের থানা থেকে ছেড়ে না দেওয়া হয় ততোক্ষণ সেখানে থাকার।
গত ২-৮ আগস্ট পর্যন্ত ঢাকা, জাহাঙ্গীর নগর, রাজশাহী, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্ষোভের আগুনে পুড়ে। কেবল গণভবনই নয় তা দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে এই দীর্ঘ আন্দোলন কর্মসূচি পালনকালে বা সরকার পতনের পর ছাত্রজনতার বিক্ষুব্ধ অবস্থার মধ্যেও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পড়েনি একটি ঢিলও, হয়নি বিন্দুমাত্র ক্ষতি। ৬ আগস্টের পর ১০ আগস্ট পর্যন্ত সারাদেশ ছিল অরক্ষিত। কিন্তু, রক্ষিত ছিল খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে। যে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেনি কোনো বহিরাগত। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এবং এখানকার প্রশাসন বিশেষ করে উপাচার্যের বলিষ্ঠ ভূমিকা, ক্যাম্পাসের প্রতি শিক্ষার্থীদের পরম ভালোবাসা, খুলনার রাজনৈতিক, সামাজিক ব্যক্তিত্ব নির্বিশেষ সাধারণ মানুষের আস্থার কারণেই তা সম্ভব হয়েছে বলে মনে করেন পর্যবেক্ষক মহল।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেবল শিক্ষা গবেষণা ও অবকাঠামোগতভাবেই এগিয়ে নেওয়া নয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অবস্থান করে নেওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি পরিবারের মতো পরিবেশ সৃষ্টির কারণে সকলের সহযোগিতা প্রাপ্তিতে উপাচার্য প্রফেসর ড. মাহমুদ হোসেনের একনিষ্ঠ প্রচেষ্টারই ফসল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি মানুষের সীমাহীন আস্থার সৃষ্টি।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি পদত্যাগের দাবি উঠলেও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির পদত্যাগের দাবি তোলেননি কেউ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা তাদের বিপদের সময় পাশে থাকা ভিসিকেই স্বপদে রাখতে চান।
যেখানে বাংলাদেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির পদত্যাগ দাবি করছেন শিক্ষার্থীরা, সেখানে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি স্যারকে নিয়ে গর্ববোধ করছে খুবির শিক্ষার্থীরা। অন্য ভিসিদের সাথে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির পার্থক্যটার মূল্যায়ন করছেন অনেকে।
উপাচার্য প্রফেসর ড. মাহমুদ হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, আন্দোলনের সময় ও তার পরে শিক্ষার্থীদের জন্য আমার কর্তব্যটুকুই আমি পালন করার চেষ্টা করেছি। প্রশংসা পাওয়ার আশায় কিছুই করিনি। হল বন্ধ করে দেওয়ার পর শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাস থেকে ঠাকুরগাঁও পর্যন্ত এমনকি বরিশাল পর্যন্তও সব জেলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস, মাইক্রোবাস ও অ্যাম্বুলেন্সে করে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করি। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আমার সাথে দেখা করে একাধিকবার ক্যাম্পাসে প্রবেশের অনুমতি চেয়েছিলেন। আমি নাকচ করে দিয়েছি। এমনকি তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ও শিক্ষা মন্ত্রীকে আমার বিষয়ে জানানো হবে বলে আমাকে জানান। তারপরও আমার সিদ্ধান্তে আমি অনড় ছিলাম।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৫ ঘণ্টা,আগস্ট ১৮,২০২৪
এমআরএম/এমএম