ঢাকা, মঙ্গলবার, ৯ আশ্বিন ১৪৩১, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২০ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

আ. লীগ নেতার শাগরেদের ধর্ষণ-হত্যাচেষ্টার শিকার নারী, তদন্তভার ডিবির হাতে

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৩১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২৪
আ. লীগ নেতার শাগরেদের ধর্ষণ-হত্যাচেষ্টার শিকার নারী, তদন্তভার ডিবির হাতে আওয়ামী লীগ নেতাদের শাগরেদ শ্যামল হাসান রুবেল

ঢাকা: ভাঙ্গারি ব্যবসায়ী মো. রানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পুলিশের কাছে মামলা করেছিলেন তার স্ত্রী ছায়া (ছদ্মনাম)। এরপর থেকে নানারকম চাপের মুখে ছিলেন।

প্রতিনিয়ত হুমকির মুখে পড়তে হচ্ছিল তাকে। একদিন ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার শিকার হন। আইনি সুরক্ষা পেতে ফের মামলা করেন। ভেবেছিলেন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নতুন বাংলাদেশে বিচার পাবেন। কিন্তু তা হচ্ছে না। আওয়ামী লীগের কয়েকজন দোসর তাকে এখনও হুমকি দিয়ে চলেছেন। এ অবস্থায় নিজের ও পরিবারের সদস্যদের প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন ভুক্তভোগী। পুলিশ জানিয়েছে, ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার ঘটনায় ভুক্তভোগীর মামলার তদন্তভার দেওয়া হয়েছে গোয়েন্দা শাখায় (ডিবি)। আসামি যে-ই হোক তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।

ঘটনাগুলোর শুরু কোথায় সে সম্পর্কে জানতে ছায়ার কাছে তার স্বামী রানা হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে প্রশ্ন করে বাংলানিউজ। তিনি জানান, তার স্বামী ভাঙ্গারি ব্যবসায়ী মো. রানাকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে যাত্রাবাড়ী থানা হেফাজতে রেখে নির্যাতন করা হয়। এরপর হত্যার শিকার হন। কেন, কী কারণে এ হত্যাকাণ্ড সে সম্পর্কে কোনো তথ্য দেননি ছায়া। শুধু জানান সবুজ ও শাহ আলম তার স্বামীকে হত্যা করেছেন। তাদের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে মামলা করা হয়েছে। কোন থানায় এ মামলা হয়েছে, সেটি জানাননি ছায়া। তবে নিজের ওপর আসা হুমকি, ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টা নিয়ে বেশ কিছু তথ্য দিয়েছেন।

ছায়ার সঙ্গে কথা বলে ও দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় তার দায়ের করা মামলা সম্পর্কে জানা গেছে, গত ৪ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তিনি কেরানীগঞ্জ পাসপোর্ট অফিসে যান। পাসপোর্ট করার জন্য তিনি প্রয়োজনীয় কাজ করছিলেন। এ সময় সেখানে আসেন রানা হত্যার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার আসামি সবুজ ও শাহ আলম। তাদের সঙ্গে আসেন শ্যামল হাসান রুবেল, সাজ্জাদ, মল্লিক পারভেজ, পূর্ব পরিচিত পলাশ, মো. হীরা, চাঁন মিয়াসহ বেশ কয়েকজন।

তারা ছায়াকে একা পেয়ে কথা আছে বলে পথ আটকান। রানা হত্যায় সবুজ ও শাহ আলমসহ অন্যান্য আসামির বিরুদ্ধে করা পিটিশন মামলা (নং-৬২৪) তুলে নিতে বলেন। কিন্তু ছায়া ‘না’ করায় তাকে সিএনজিতে তুলে নিয়ে কেরানীগঞ্জের ঝিলমিল প্রজেক্টে একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে নিয়ে যান। সেখানে সবাই মিলে ছায়াকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে রুবেল তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গলা চেপে ধরে ছুরি চালান। কিন্তু ছায়া সরে যান। কিন্তু তার বাঁ হাত ৮ হতে ১০ ইঞ্চি পরিমাণ কেটে যায়।

এরপর তাকে নিয়ে ধস্তাধস্তি করা হয়। তাকে মারধর করে জামা-কাপড় টেনে ছিঁড়ে বিবস্ত্র করার চেষ্টা করা হয়। এ সময় ভুক্তভোগী চিৎকার শুরু করলে আশপাশ থেকে লোকজন এগিয়ে এলে সবুজ, শাহ আলম, রুবেলসহ সবাই পালিয়ে যান। যাওয়ার সময় তাকে বলে যান- আজকে তুই কোনোমতে বেঁচে গেলি। কিন্তু মামলা তুলে না নিলে পরবর্তীতে হত্যার পর লাশ গুম করে ফেলব।

এ ঘটনার পর এক নারীর সহযোগিতায় মিটফোর্ড হাসপাতালে চিকিৎসা নেন ছায়া। এরপর গত ৮ সেপ্টেম্বর ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগে সবুজ, শাহ আলম, রুবেলসহ সবার বিরুদ্ধে মামলা (নং- ১৯/৫৮৩) করেন। মামলায় রুবেলকে ১ নম্বর আসামি করা হয়। অন্যান্য আসামিরা হলেন- সাজ্জাদ, মল্লিক পারভেজ, পূর্ব পরিচিত পলাশ, মো. হীরা, চাঁন মিয়া, সবুজ ও শাহ আলম।

শ্যামল হাসান রুবেল আবার ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর সলিমুল্লা সলুর প্রধান সহযোগী। আওয়ামী লীগের দাপটে তিনি এলাকায় নানা অপরাধ করতেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বসিলা এলাকায় সুজন নামে এক ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় কাউন্সিলর সলিমুল্লা সলুর বিরুদ্ধে মামলা হয়। মোহাম্মদপুর থানায় দায়ের হওয়া মামলায় র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) হাতে ধরা পড়েন সলু। তিনি জেলে গেলেও রুবেলের দাপট কমেনি। এলাকায় নিজের প্রভাব বিস্তার করতে নানা অপরাধ করছেন বলে ভুক্তভোগী জানিয়েছেন।

ছায়া বলেন, স্বামীর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলা কইরা আমি চাপে ছিলাম। আমারে বার বার মামলা তোলার জন্য হুমকি দিসিলো। এখনও দিতাসে। আমি বিদেশ যাওনের চেষ্টা করতাছিলাম। বাঁচতে তো হইবো। পোলাপান নিয়া পালায়া থাকি। গত ৪ সেপ্টেম্বর কেরানীগঞ্জে পাসপোর্ট অফিসে গেসিলাম। ওইখান থেকে আমাকে তুইলা নিয়া গিয়া ধর্ষণ করতে চাইসে। মাইরা ফালাইতে চাইসে। আমি তো ভিকটিম। আমারে বার বার হুমকি দিতাসে।

তিনি জানান, স্বামী হারিয়ে দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে বেশ বিপাকে আছেন। কোথাও স্থির থাকতে পারছেন না। চাকরিও করতে পারছেন না। স্বামীর মামলা তো আছেই, ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার ঘটনায় যে মামলা করেছেন, সেটি তুলে নেওয়া না হলে মেরে ফেলা হবে বলে হুমকি দিচ্ছেন আসামিরা। বিশেষ করে মামলার এক নম্বর আসামি রুবেল তাকে হুমকি দিচ্ছেন।

তিনি অভিযোগ করেন, ডিএনসিসির ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা সলিমুল্লা সলুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ও ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সৈয়দ হাসান নূর ইসলাম রাষ্টনের সখ্য হওয়ার জোরে এলাকায় দাপট দেখিয়ে বেড়ান আসামি রুবেল। আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও এখনো চাঁদাবাজি করেন রুবেল। তার রয়েছে কিশোর গ্যাং গ্রুপ। যাদেরই হুমকি মনে করতেন গ্যাং সদস্যদের লেলিয়ে দিতেন। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বরাদ্দকৃত জমি দখল, ফুটপাতের দোকান, বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও আবাসিক হোটেল থেকে মাসে প্রায় ৫০-৬০ লাখ টাকা চাঁদাবাজি করতেন তিনি। রুবেলকে দিয়ে এসব কাজ করাতেন আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক কাউন্সিলর রাষ্টন।

স্বামীর হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে ছায়া কিছু না জানালেও তার সন্তান অতুল (ছদ্মনাম) জানিয়েছে, ‘কোনো একটি ব্যবসায়’ সংক্রান্ত কারণে বন্ধু সবুজ ও শাহ আলমের সঙ্গে বচসা হয় রানার। অতুলের বাবা রানা তাদের গালাগাল করেন। এ কারণে সবুজ ও শাহ আলম তার বাবাকে পুলিশের হাতে তুলে দেন। যাত্রাবাড়ি থানায় রানাতে অত্যাচার করা হয়। চলতি বছর ৯ রমজানে খুন হন রানা। সবুজ ও শাহ আলম তাকে হত্যা করে। এ ঘটনায় অতুলের মা ছায়া যাত্রাবাড়ি থানায় মামলা করেছিলেন।

রানা হত্যায় যাত্রাবাড়ি থানায় করা ৬২৪ নম্বর মামলাটি ছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর যাত্রাবাড়ি থানার পুলিশে রদবদল হয়েছে। মামলার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে এ থানার বর্তমান ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ফারুক আহমেদের মোবাইলে বেশ কয়েকবার কল করা হয়। কিন্তু তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

যাদের বিরুদ্ধে ছায়ার অভিযোগ, তাদের কারও সঙ্গেও যোগাযোগ সম্ভব হয়নি। ফলে কারও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা এলাকার অনেকেই রুবেলের অপরাধ সম্পর্কে প্রায় একই তথ্য দিয়েছেন।

এসব ব্যাপারে জানতে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মাজহারুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি ছায়াকে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার ঘটনায় করা মামলার ব্যাপারে নিশ্চিত করেন। ওসি বলেন, ভুক্তভোগীকে ধর্ষণ-হত্যাচেষ্টার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলাটি গতকাল রোববার ঢাকা জেলা দক্ষিণ ডিবি পুলিশকে তদন্তের জন্য দেওয়া হয়েছে। তারাই মামলার অগ্রগতি ও আসামি গ্রেপ্তার সম্পর্কে বলতে পারবে। আর তার স্বামী হত্যার ঘটনাটি অন্য থানার। এটি সম্পর্কে আমাদের জানা নেই।

যোগাযোগ করা হলে ঢাকা জেলা দক্ষিণ ডিবি পুলিশের ইন্সপেক্টর সাইদুল ইসলাম মামলার তদন্তভার পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, মামলা হলেই তো আর আসামি ধরা যায় না। তদন্ত করার সময় দিতে হবে। আমরা মামলার ডকেট পাওয়া মাত্র তদন্ত কর্মকর্তা নিযুক্ত করেছি। ধর্ষণ-হত্যাচেষ্টার ঘটনার সত্যতার ভিত্তিতে তদন্তকারী কর্মকর্তা আইনানুগ পদক্ষেপ নেবেন।

জানতে চাইলে ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) আহম্মদ মুঈদ বলেন, ভুক্তভোগীর মামলার তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে আমরা জেনে নিচ্ছি। মামলায় আসামি যারাই হোক না কেন, যে দলেরই হোক না কেন আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৩০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২৪
এমএমআই/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।