ঢাকা, মঙ্গলবার, ৯ আশ্বিন ১৪৩১, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২০ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

খুলনার ২৩ গ্রামে ব্যাপক জলাবদ্ধতা, মানবিক বিপর্যয়ের শঙ্কা!

মাহবুবুর রহমান মুন্না, ব্যুরো এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২৪
খুলনার ২৩ গ্রামে ব্যাপক জলাবদ্ধতা, মানবিক বিপর্যয়ের শঙ্কা!

খুলনা: ম্যালা কষ্টে আছি। চারদিকেই পানি।

এই পানির কারণে কাজকামে যাতি পারি না। বাচ্চাকাচ্চারা স্কুল কলেজে যাতি পারে না। আমরা বাইরে যাতি পারি না। শোলমারি নদীতে বালি জমিছে। এর জন্য পানি যাতি পারে না। পানি আটকে রইছে। বালি ছাড়ায় দিলে পানি চলে যাতি পারে।

জলাবদ্ধতায় আটকা খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার বাদুড়গাছা গ্রামের গৃহবধূ রিজিয়া বেগম এভাবেই নিজেদের কষ্টের কথা জানান বাংলানিউজকে।

একই গ্রামের মোহাম্মদ সালাউদ্দিন জানিয়েছেন, তারা গত দুই মাস ধরে জলাবদ্ধতায় পতিত। বর্ষার পর পানি উঠে ঘরদোর ভেসে গেছে। রান্নার জায়গা নেই। প্রায় ৩০০ পরিবার শিশুসহ কষ্টের জীবন পার করছেন। অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এলাকার বহু স্থান বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে।

আক্ষেপ করে সালাউদ্দিন বলেন, সবাই জানে ফেনী তলায় গেছে। কেউ জানে না আমরা এখানে ডুবে আছি। কেউ খবর নেয় না। সবাই ওইদিকে খবর নেয়, আমাদের এখানে কেউ খবর নেয় না। এখন আমাদের একমাত্র সমাধান এই পানি সরিয়ে নেওয়া। পানির সমস্যার সমাধান না করলে আমাদের বেঁচে থাকাটাই কষ্ট হয়ে যাবে।

পূর্ব বাদুরগাছা জামে মসজিদের পেশ ইমাম ও খতিব হাফেজ মাওলানা মাহবুবুর রহমান বলেন, মসজিদটি দুই মাস ধরে পানিতে তলিয়ে আছে। গত বছরও একই ঘটনা ঘটেছিল। এলাকা পানিতে তলিয়ে থাকায় তাদের চলাচলে অসুবিধা হচ্ছে।

তিনি বলেন, জলাবদ্ধতার থাকার কারণ হলো আমাদের পার্শ্ববর্তী খালের পানি নদীতে যেতে পারে না। যদি যেতে পারত তাহলে এই জলাবদ্ধতা থাকত না। অবৈধভাবে খাল দখলদারিত্বের কারণে বিভিন্ন জায়গায় বাঁধ দিয়ে ঘের করার কারণে পানি সরছে না। আমাদের এলাকাবাসীর দাবি অতি দ্রুত যেন বন্যার পানি চলে যায় সেটির ব্যবস্থা করা।

তেলিগাতী গ্রামের মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বিল ডাকাতিয়ার জলাবদ্ধতার কারণে আমরা এখানে যারা মাছ চাষের ওপর নির্ভরশীল, সবাই পানিতে আটকা। হাজার হাজার হেক্টর ঘেরের মাছ পানিতে ভেসে গেছে। ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছে।

রংপুর গ্রামের দীপক সরকার বলেন, রংপুর-ডাকাতিয়ার বিলের মানুষ বড় কষ্টে আছে। আমরা মানবেতর জীবন যাপন করতিছি। আমাগের দেখার কেউ নেই।

ডুমুরিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. ইনসাদ ইবনে আমিন বাংলানিউজকে বলেন, সম্প্রতি টানা বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে বিল ডাকাতিয়ায়। শৈলমারি গেট থেকে পানি বের করার জন্য ইতিমধ্যে আমরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠক করেছি। ঘেরের আইলে থাকে সবজি আর ঘেরে থাকে মাছ। অধিক বৃষ্টিতে সবজি ও মাছ উভয়েরই ক্ষতি হয়েছে। জলাবদ্ধতায় এলাকার মানুষ আছে সীমাহীন কষ্টে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সম্প্রতি সময়ের প্রচণ্ড বৃষ্টি ও বুড়িভদ্রা নদীর জোয়ারের পানিতে বন্যা ও জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে ডুমুরিয়ার আটলিয়া, মাগুরাঘোনা, শরাফপুর, রংপুর ইউনিয়নের অন্তত ২৩ গ্রাম। বসত ভিটা, মৎস্য ঘের, আমনধান, শাকসবজি ক্ষেত, রাস্তা ঘাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সবই পানির নিচে। বাদুড়গাছা গ্রামের মতো রোস্তমপুর, আটলিয়া, চাকুন্দিয়, মালতিয়া, বয়ারসিংস, তেলিগাতীসহ ২৩ গ্রাম পানির নিচে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, টানা বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে ডুমুরিয়ার ৪ ইউনিয়ন। পানি ঢুকে পড়েছে ঘর-বাড়িতেও। পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন লক্ষাধিক মানুষ। সম্প্রতি সময়ের ভারী বর্ষণে বিল ডাকাতিয়ায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় যাতায়াতে দেখা দিয়েছে দুর্ভোগ। যাতায়াতের একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে ডিঙ্গি নৌকা। উঠানে কোমরসমান পানি। রান্নাঘর, শোবার ঘর, গোয়াল ঘরেও পানি। পানির কারণে অনেকে অন্যত্র গিয়ে থাকছেন। এমন পরিস্থিতিতে চোখে-মুখে আতঙ্ক নিয়ে সময় পার করছেন এসব দুর্গত এলাকার মানুষ। শুকনা খাবার, চিড়া-মুড়ি, খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে এসব এলাকায় বসবাসকারী মানুষগুলোর। খেটে খাওয়া মানুষগুলো রুটি রুজিও বন্ধ হয়ে গেছে। এলাকায় দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট।

খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার শোলমারী ১০ ভেন্ট স্লুইস গেটের সামনে পলি জমে পানি বের হতে না পারায় বিল ডাকাতিয়া ও সংলগ্ন ২৩টিরও অধিক গ্রামের মানুষ জলাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। ভুক্তভোগী জনগণ গত ২ মাস ধরে চেষ্টা চালালেও পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি ঘটেনি। পানি নিষ্কাশনের পথ না থাকায় জলাবদ্ধতা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। বাড়ি-ঘরে পানি ওঠায় অনেকেই ছাড়ছেন এলাকা। ডুবে থাকায় অকেজো হয়ে পড়েছে টিউবওয়েলগুলো। নেই রান্নার জায়গাও। ছড়িয়ে পড়েছে পানিবাহিত রোগ। এতে মানবিক বিপর্যয়ের শঙ্কা দেখা দিয়েছে গোটা এলাকায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পানি নিষ্কাশনের লক্ষ্যে কেজেডিআরপি প্রকল্পের আওতায় ১৯৯৯ সালে কোটি টাকা ব্যয়ে ডুমুরিয়া উপজেলার শোলমারী নদীর মুখে বাঁধ দিয়ে সেখানে ১০ ভেন্টের স্লুইচ গেট নির্মাণ করা হয়। ফলে বিল ডাকাতিয়া সংলগ্ন মানুষ ২২-২৩ বছর ধরে জলাবদ্ধতা মুক্ত হওয়ায় ব্যাপক হারে মিষ্টি পানির চিংড়ি ঘের ও ঘেরের আইলে সবজি চাষ করে আর্থিকভাবে ঘুরে দাঁড়ান। কিন্তু ওই স্লুইচ গেটের সামনে পলি পড়তে পড়তে পানি সরবরাহ এক প্রকার বন্ধ হয়ে গেছে। চলতি বছরের বর্ষা মৌসুমে ডাকাতিয়া বিলে আবার জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। তাছাড়া চলতি মৌসুমে টানা ভারী বৃষ্টি হওয়ায় জলাবদ্ধ পরিস্থিতি মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে।

মঙ্গলবার (২৪ সেপ্টেম্বর) দুপুরে পানি উন্নয়ন বোর্ড -১ খুলনার নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুর রহমান তাযকিয়া বাংলানিউজকে বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। সব রকম ড্রেজার ভাসমান স্কেবেটর নরমাল স্কেবেটর প্রয়োজনে আরও আনবো। কিন্তু বৈরি পরিবেশের জন্য ঠিক মতো কাজ করা যাচ্ছে না। এক ভাটায় যে কাজ করি, পরবর্তী জোয়ার পলি পড়ে তা ভরে যায়। প্রয়োজন আরও ভেকু এনে চেষ্টা করব, যাতে এক ভাটায় কাজটা শেষ করা যায় কিনা।

বাংলাদেশ সময়: ১৬২৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২৪
এমআরএম/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

জাতীয় এর সর্বশেষ