নদীতে কী পরিমাণ প্লাস্টিক যাচ্ছে তার অন্যতম পরিমাপক হলো প্রতি কেজি পানিতে কী পরিমাণ মাইক্রোপ্লাস্টিকের (এমপি) কণা রয়েছে। চীনের ইয়ং চিঙ নদীর প্রতি ঘনমিটার পানিতে ৮০২টি মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা পাওয়া গেছে।
রাজধানীর নদী ও জলাশয়গুলোয় কী পরিমাণ প্লাস্টিক কণা রয়েছে তার একটি ধারণা পাওয়া যায় বিশ্বখ্যাত গবেষণা জার্নাল এলসেভিয়ারের এক প্রবন্ধে। ‘বাংলাদেশের ঢাকা শহরের হ্রদ এবং আশপাশের নদীতে মাইক্রোপ্লাস্টিকদূষণের ঝুঁকি মূল্যায়ন’ শীর্ষক ওই গবেষণা প্রবন্ধে উঠে এসেছে ভয়ংকর সব তথ্য। ওই গবেষণায় ১৯টি স্থান থেকে পানি ও পলির তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে তুরাগ নদ, বুড়িগঙ্গা নদী, শীতলক্ষ্যা নদী, বালু নদ, ডেমরা খাল, টঙ্গী খাল ছাড়াও হাতিরঝিল, ধানমণ্ডি ও গুলশান লেক।
গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে সবচেয়ে বেশি প্লাস্টিক কণা রয়েছে টঙ্গী খালের পানিতে। এরপর বালু নদ, বুড়িগঙ্গা নদী ও ধানমণ্ডি লেকের পানিতে। শহরের জলাশয়গুলোয় প্রতি ঘনমিটার পানিতে গড়ে ৩৬ হাজার মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা পাওয়া গেছে, যা বিশ্বের অনেক নদীর চেয়ে বহুগুণ বেশি। বিশ্বে যেসব দেশের নদীতে প্লাস্টিকদূষণ সবচেয়ে বেশি তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ভারত, সার্বিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও বাংলাদেশ।
তবে বাংলাদেশের শহর এলাকার নদীগুলোর তুলনায় গ্রামীণ এলাকার নদীর পানিতে কিছুটা কম প্লাস্টিকের দূষণ রয়েছে। দিনাজপুরের গ্রামাঞ্চল ঘেঁষে যাওয়া আত্রাই ও করতোয়া নদীতে মাইক্রোপ্লাস্টিক কণার পরিমাণ যেখানে ১০০ থেকে ১৫০টি, সেখানে এই দুই নদী যখন কোনো শহর ঘেঁষে বয়ে গেছে তখন মাইক্রোপ্লাস্টিক কণার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩০০ থেকে ৪০০। আর রাজধানীর নদী ও লেকে গড়ে পাওয়া গেছে ৩৬ হাজার মাইক্রোপ্লাস্টিকের কণা। এই হিসাবে গ্রামীণ এলাকার নদীর তুলনায় শহর এলাকার নদীতে শতগুণ বেশি প্লাস্টিক ও পলিথিনের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ কারণে এনভায়রনমেন্টাল পারফরম্যান্স ইনডেক্স (ইপিআই) সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৭তম।
বৈশ্বিক প্লাস্টিকদূষণের প্রায় আড়াই শতাংশ হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে। বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ১০ মিলিয়ন টন পলিথিন প্লাস্টিকের ব্যবহার হচ্ছে। যদিও এসব প্লাস্টিকের মাত্র ৩৭ শতাংশ রিসাইক্লিং করা সম্ভব হচ্ছে।
নদীর পানিতে যেসব মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা পাওয়া গেছে সেগুলোতে নানা ধরনের এবং নানা মানের পলিথিন ও প্লাস্টিক কণা রয়েছে। এর মধ্যে পলিপ্রপিলিন (পিপি), পলিস্টাইরিন (পিএস), নাইলন (এনওয়াই), নিম্ন ঘনত্বের পলিথিন (এলডিপিই), ইথিলিন-ভিনাইল অ্যাসিটেট (ইভিএ), অ্যাক্রিলোনিট্রাইল বিউটাডাইন স্টাইরিন (এবিএস) এবং পলিথিলিন টেরেফথালেটের কণার উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস), আইইউসিএন ও বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০০৫ সালে দেশের শহরাঞ্চলে বার্ষিক মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার ছিল মাত্র তিন কেজি, যেটি ২০২০ সালে বৃদ্ধি পেয়ে ৯ কেজিতে উন্নীত হয়েছে। বতর্মানে শুধু রাজধানীতেই একজন মানুষ বছরে ২৪ কেজি প্লাস্টিক ব্যবহার করছে। রাজধানীতে গড়ে প্রতিদিন পলিথিনের ব্যবহার হচ্ছে দেড় কোটি পিস।
এদিকে পলিথিন উৎপাদনে সারা দেশে দেড় হাজারের বেশি অবৈধ কারখানা রয়েছে। প্লাস্টিক ও পলিথিনের এই মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারে ধ্বংস হচ্ছে পরিবেশ, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নদী ও সাগর। আর বর্ষাকালে ভেঙে পড়ছে দেশের ড্রেনেজব্যবস্থা। মানবস্বাস্থ্যের নানা রোগের উপসর্গ তৈরি করছে এসব পলিথিন ও প্লাস্টিক।
এসব বিষয়ে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) সম্পাদক সৈয়দ মাহবুবুল আলম তাহিন সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘বাংলাদেশে পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে মোবাইল কোর্টনির্ভরতা কমাতে হবে। এ ছাড়া পরিবেশ আইন সংশোধনের মাধ্যমে অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের প্রশাসনিক জরিমানার ক্ষমতা দিতে হবে। আর প্লাস্টিকদূষণসংক্রান্ত কার্যকর বিধিমালা প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। প্লাস্টিক ও পলিথিনের বিকল্প না থাকায় এর ব্যবহার কমানো যাচ্ছে না। তাই পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাটপণ্যের ও তন্তুজাতীয় পণ্যের ব্যবহার বাড়াতে হবে। বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক উৎপাদনে প্রণোদনা ও উৎসাহ প্রদানে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। ’
অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের ঘোষণা অনুযায়ী সারা দেশে নিষিদ্ধ পলিথিন শপিং ব্যাগ উৎপাদনকারী কারখানার বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে পরিবেশ অধিদপ্তর ও সমন্বিত মনিটরিং টিম। এ ছাড়া পরিবেশদূষণ নিয়ন্ত্রণে সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ এবং অধীন দপ্তর ও সংস্থার কার্যালয়ে ‘সিঙ্গল ইউজ প্লাস্টিক’ ব্যবহার বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে সরকার। গত বছর ৫ সেপ্টেম্বর এক চিঠিতে সব সচিব, সিনিয়র সচিব, বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকদের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এই নির্দেশ দিয়েছে। চিঠিতে পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের গত বছর ২৯ আগস্টের এক চিঠির উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া নিষিদ্ধ পলিথিনের বিরুদ্ধে গত বছর ৩ নভেম্বর থেকে অভিযান পরিচালনা করছে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত কমিটি।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ুু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের এসংক্রান্ত মনিটরিং কমিটির সভাপতি ও অতিরিক্ত সচিব তপন কুমার বিশ্বাস সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, পলিথিন শপিং ব্যাগের নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে সরকার বদ্ধপরিকর। এজাতীয় ব্যাগের ব্যবহার বন্ধে সবাইকে সরকারের নির্দেশনা মানতে হবে। অন্যথায় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পলিথিন শপিং ব্যাগ নিষিদ্ধে গত বছর ৩ নভেম্বর থেকে এ পর্যন্ত সারা দেশে নিষিদ্ধঘোষিত পলিথিন উৎপাদন, বিক্রয়, সরবরাহ ও বাজারজাত করার দায়ে ১৯৯টি মোবাইল কোর্ট অভিযান পরিচালনা করেছে। এসব অভিযানে ৪১৪টি প্রতিষ্ঠানকে মোট ২৫ লাখ ৭২ হাজার ৩০০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এ সময় আনুমানিক ৫০ হাজার ৫৫৬ কেজি নিষিদ্ধঘোষিত পলিথিন জব্দ করা হয়। চারটি পলিথিন উৎপাদনকারী কারখানার সেবা সংযোগ বিচ্ছিন্ন ও সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে।
সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ
বাংলাদেশ সময়: ১০২৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৪, ২০২৫
এমএম