ফরহাদ মজহার। দার্শনিক, গবেষক, কবি, মানবাধিকারকর্মী ও পরিবেশবাদী।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা ব্যাখ্যা বা বোঝা অনেক বড় বিষয়। একটা পথ হতে পারে রাজনৈতিক তর্কবিতর্ক বোঝা; যেমন—সংবিধানকেন্দ্রিক তর্কবিতর্ক। রাজনৈতিক মহলে তথাকথিত ‘সংবিধান’ প্রশ্নে তর্কবিতর্কের তিনটি ধারা রয়েছে। একটি ধারা বলছে, পুরনো সংবিধান যেটা আছে, সেটাই ঠিক বা বৈধ।
আমাদের পুরনো সংবিধান বহাল রেখে তার অধীনে উপদেষ্টা সরকার গঠন করতে হবে। সেটাই নাকি তাঁরা করেছেন। কিন্তু এ রকম কোনো সরকার সংবিধানে নাই। যার কুফল আমরা ভোগ করছি।
তাঁরা আবার সংবিধানের সংস্কারও চান। এটা দ্বিতীয় জগাখিচুড়ি ধারা। সংবিধান সরক্ষণ ও রক্ষা করার শপথ নিয়ে সংবিধান সংস্কার বা সংশোধন যে স্ববিরোধিতা, সেটা এই ধারা আবার মানেন না। ফলে রাজনৈতিক ও আইনি—উভয় দিক থেকে একটা অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরি হয়েছে।
এটা খুবই বিপজ্জনক। কারণ কোনো কারণে ক্ষমতার ভারসাম্যে বদল ঘটলে সংবিধানকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে উপদেষ্টা সরকারকে ঘায়েল করা খুবই সহজ কাজ। হাসিনার পতনের পর ফ্যাসিস্ট সংবিধান বহাল রাখার ধারা সামনে দেখা যাচ্ছে না বটে, কিন্তু সাংবিধানিকতার দোহাই দিয়ে ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার ধারা বেশ প্রবল। তৃতীয় ধারা হচ্ছে গণ-অভ্যুত্থানের পরে ফরমানের মধ্য দিয়ে পূর্ণ ক্ষমতাসম্পন্ন অন্তর্বর্তী সরকার গঠন, যার কাজ জনগণের সার্বভৌম অভিপ্রায় বাস্তবায়ন করা। অর্থাৎ গণতন্ত্র কায়েম।
তা না করে ফ্যাসিস্ট সংবিধানের অধীনে সেনা সমর্থিত উপদেষ্টা সরকার গঠন করা হয়েছে। এই সরকারের কোনো আইনি ভিত্তি নাই। অথচ বিদ্যমান ফ্যাসিস্ট সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়ে যে সরকার সংবিধানে নাই সেই সরকার গঠিত হয়েছে। এই ধারারই বিপরীতে রয়েছে গণ-অভ্যুত্থানের পরে নতুন গঠনতন্ত্র (Constitution) প্রণয়ন। অর্থাৎ রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে বাংলাদেশের জনগণের নিজেদের নতুনভাবে গঠন। এটাও গণ-রাজনৈতিক ধারা। জনগণের সার্বভৌম অভিপ্রায় বাস্তবায়ন বা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েমের ধারা।
জনগণের সার্বভৌম অভিপ্রায়কে পূর্ণ রূপ দিয়ে গণতন্ত্র কায়েম করতে হবেদেখুন, সামরিক অভ্যুত্থানের পর যখন সামরিক শাসন জারি হয়, তখন সামরিক শাসকরা সংবিধান স্থগিত রাখে এবং ফরমান বা আদেশ দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করে। তাহলে জনগণ স্বয়ং যেখানে অভ্যুত্থানের কর্তা, সেখানে অতি অনায়াসে সংবিধান বাতিল করে জনগণের সার্বভৌম অভিপ্রায়ের প্রতিনিধি হিসেবে পূর্ণ ক্ষমতাসম্পন্ন অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার গণফরমান বা আদেশ (Proclamation) দিয়ে দেশ পরিচালনা করতে পারত। সেটা তারা করেনি। দিন যত যাবে, এই গোড়ার ভুলের কাফফারা আমাদের গুনতে হবে। এর কুফল বা ব্যর্থতা নানাভাবে দৃশ্যমান হতে থাকবে।
সেনাশাসকরা সেনা অভ্যুত্থানের পরে কিংস পার্টি বানায় এবং নিজেদের দলকে নির্বাচিত করিয়ে আনে এবং সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ আসনের জোরে সাংবিধানিকভাবে অবৈধ সরকারকে সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদের বলে ‘বৈধ’ ঘোষণা করে। এই যে পেছনের পাপ বা অবৈধ সামরিক শাসনকে কাগুজে সংবিধান ব্যবহার করে বৈধ করার তামাশা, আমরা সেসব মেনে নিয়েছি। কিন্তু বিপরীতে কী দেখছি? এত বড় গণ-অভ্যুত্থানের পরে—জনগণের সার্বভৌম অভিপ্রায় বিপুল ও দৃশ্যমানভাবে ব্যক্ত হওয়ার পরও জনগণের পক্ষে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেনি। ক্ষমতা গ্রহণ করেছে ফ্যাসিস্ট সংবিধানের অধীনে এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রপতির হাতে শপথ গ্রহণের মাধ্যমে। গণ-অভ্যুত্থানের পূর্ণ বিজয় ঘোষণা করা হলো না। ঘোষণা জরুরি ছিল যে পুরনা সংবিধান বা বিধি-বিধান মতে নয়, আজ থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের আদেশে দেশ চলবে। গণ-অভিপ্রায়ের সার্বভৌম ক্ষমতার দ্বারা বৈধ ফরমান বা ঘোষণার মাধ্যমে আমরা জনগণই সার্বভৌম—এই সত্য প্রতিষ্ঠা করলাম না। এই চরম ঐতিহাসিক ভুলের চরম মূল্য আমাদের পরিশোধ করতে হবে। আমরা গণতন্ত্রের কথা বলি, কিন্তু গণসার্বভৌমত্ব কায়েমই গণতন্ত্র—এই অতি সাধারণ ও প্রতিষ্ঠিত কাণ্ডজ্ঞান আমাদের নাই। এই হলো আমাদের অবস্থা।
বাহাত্তরের সংবিধান প্রণয়ন নিয়ে কী বলবেন? এবার কী হতে যাচ্ছে?
বাহাত্তরে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলাদেশের জনগণ নতুন গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করতে পারেনি। অথচ নিজেরা নিজেদের রাজনৈতিকভাবে ‘গঠন’ (Constitute) করা যেকোনো জনগোষ্ঠীরই রাজনৈতিক অধিকার।
বাহাত্তরের সংবিধান আইনি অর্থে পাকিস্তানিদের প্রণীত সংবিধান। কারণ যারা সামরিক বাহিনীর দেওয়া লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার মেনে পাকিস্তানের গণপরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত হয়েছিল, তারাই বাহাত্তরের সংবিধান প্রণয়ন করে। অন্যদিকে একাত্তরের স্বাধীনতাসংগ্রামের সময় স্বাধীনতার ঘোষণায় যে তিন নীতি ঘোষিত হয়েছিল, তা অস্বীকার ও নস্যাৎ করে দিয়ে বাঙালি জাতিবাদী ফ্যাসিস্ট শক্তি বা আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের জনগণের রাজনৈতিক অধিকার হরণ করে। স্মরণ রাখা দরকার যে স্বাধীনতার ঘোষণার তিন নীতি ছিল—সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার।
এবার গণ-অভ্যুত্থানের পরে ফ্যাসিস্ট দল আওয়ামী লীগ মোটামুটি পরাজিত। কিন্তু স্পষ্ট ও দৃশ্যমান না থাকলেও পুরনো ফ্যাসিস্ট ও গণবিরোধী রাজনৈতিক ও আইনি মতাদর্শ, ফ্যাসিস্ট বিধি-বিধান, আইনি প্রক্রিয়া, বিচারব্যবস্থা ইত্যাদি প্রায় সব কিছুই আগের মতোই রয়েছে। অর্থাৎ ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ব্যবস্থা কম শক্তিশালী নয়। গণ-অভ্যুত্থানের বিপরীতে অনায়াসে তারা সে কারণে একটি ‘সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লব’ ঘটাতে পেরেছে।
বাহাত্তরের সংবিধান বাঙালি জাতিবাদ, অর্থাৎ পরাজিত আওয়ামী ফ্যাসিস্ট শক্তির মতাদর্শিক ভিত্তি। বাহাত্তরের সংবিধানের বাঙালি জাতিবাদ, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিস্ট ক্ষমতার ভিত্তি। তথাকথিত বাহাত্তরের সংবিধান মূলত ফ্যাসিস্ট একনায়কতন্ত্র, অর্থাৎ এক ব্যক্তির হাতে সাংবিধানিকভাবে ফ্যাসিস্ট ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখার দলিল। শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশ থেকে পালিয়েছে বটে, কিন্তু তথাকথিত ফ্যাসিস্ট সংবিধান বহাল রাখা এবং ফ্যাসিস্ট হাসিনা দ্বারা নিয়োজিত রাষ্ট্রপতির হাতে শপথ গ্রহণ মানে ফ্যাসিবাদের মতাদর্শিক, রাজনৈতিক এবং আইনি ভিত্তি ও প্রবণতা সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার নামে জারি রয়েছে। এই শক্তি চাইছে শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সংবিধান বহাল থাকুক, তার সংস্কার হোক; কিন্তু এই সংবিধান বহাল রাখা মানে পুরনো জায়গায় ফিরে যাওয়ার শর্ত জারি রাখা। বাংলাদেশের জনগণকে আবারও নিজেদের রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে নতুনভাবে গঠন করতে দেওয়া হলো না।
যখন জনগণের অভ্যুত্থান ঘটে, তখন একটি গণ-অভিপ্রায়, গণ-অভিব্যক্তি সৃষ্টি হয়। গঠনতন্ত্র হচ্ছে জনগণের অভিপ্রায়ের ‘পরম অভিব্যক্তি’। কারণ গণ-অভ্যুত্থানের মধ্যে জনগণ সম্পৃক্ত রয়েছে। জনগণ গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেখায়, গণতন্ত্রের যে ভিত্তি সেটা হলো গণসার্বভৌমত্ব। জনগণই সার্বভৌম—এটাই গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জনগণ প্রমাণ করে। এটা কোনো আইনের দ্বারা প্রমাণিত হয় না। কোনো রাজনৈতিক দলের ভোটাভুটির দ্বারা হয় না। আইন রাষ্ট্রকে সার্বভৌম দাবি করে। কিন্তু রাষ্ট্র সার্বভৌম কি না সেটা নির্ভর করে জনগণ সেই রাষ্ট্রকে আদৌ বৈধতা দিয়েছে অর্থাৎ জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে কি না তার দ্বারা। জনগণের ইচ্ছা না, সামষ্টিক অভিপ্রায়েই রাষ্ট্র গঠন হয়। এই অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিকে বলা হয় গণ-অভ্যুত্থান। ফলে গণ-অভ্যুত্থানই হচ্ছে গণতন্ত্র। রাজনৈতিক দলগুলো আবার লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করার জন্য দাবি করে, ‘নির্বাচনই গণতন্ত্র’। তা একদমই ঠিক নয়। নির্বাচন হচ্ছে সরকার গঠন করার ব্যবস্থা। অথচ আগে দরকার রাষ্ট্র গঠন। রাষ্ট্র গঠনের জন্যও নির্বাচন দরকার হয়। তাকে বলা হয় গণপরিষদ নির্বাচন বা রাষ্ট্র গঠন সভার নির্বাচন। আমাদের সমাজে রাষ্ট্র গঠনের জন্য গণপরিষদ নির্বাচন আর বিদ্যমান গঠনতন্ত্রের ভিত্তিতে সরকার নির্বাচনের ফারাক খুবই অস্পষ্ট। রাজনৈতিক দলগুলো এই অস্পষ্টতা বজায় রাখতে চায়। এই ধোঁয়াশা প্রবল রেখে তারা সরকার নির্বাচন চায়। এই ক্ষেত্রে সমাজে প্রবল বুদ্ধিবৃত্তিক অস্পষ্টতা ও অপরিচ্ছন্নতা আছে। আমাদের গণমাধ্যমও এ বিষয়ে জনগণকে স্পষ্ট ধারণা দিতে পারছে না। গণ-অভ্যুত্থানের পর জনগণের সার্বভৌম অভিপ্রায়ের গণ-অভিব্যক্তি গণতন্ত্র বা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রূপ নিয়ে হাজির হয়। এখন যে সরকার রয়েছে, এই সরকার পরিপূর্ণভাবে গণক্ষমতা বা গণসার্বভৌমত্বের (Popular Sovereignty) ওপর গঠিত হয়নি। এটা আধাখেচড়া কাজ হয়েছে। পুরনো সংবিধান সংরক্ষণ ও হেফাজতের শপথ নিয়েও তাঁরা সংবিধান সংস্কার করতে চাচ্ছেন। এটা স্ববিরোধিতা। এর আইনি কোনো ভিত্তি নাই। অবৈধ ভিত্তির ওপর একটা সরকার চলতে পারে না। সরকারকে পরিষ্কার ঘোষণা দিতে হবে, আমরা জনগণের অভ্যুত্থানের দ্বারা নির্বাচিত অন্তর্বর্তী সরকার। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচিত কিভাবে? ভোট তো হয়নি! বলতে হবে, জনগণ আমাদের রক্তের বিনিময়ে, শহীদ হয়ে, পঙ্গু হয়ে নির্বাচিত করেছে। এটা তথাকথিত ভোটাভুটির চেয়েও অনেক বেশি বৈধ সরকার। রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, এই সরকার তো নির্বাচিত সরকার নয়। রাজনৈতিক দলগুলো অবশ্যই ভুল বলছে। গণতন্ত্র কী, গণ-অভ্যুত্থান কী, সে সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই। তারা আগের ফ্যাসিস্ট সরকারের মতোই দ্রুত ক্ষমতায় গিয়ে একই আচরণ, অর্থাৎ আগের মতোই লুটপাট করতে চায়।
এই সরকারের কাজ কী? কোন কোন কাজ তাদের করা দরকার?
জনগণের সার্বভৌম অভিপ্রায়কে পূর্ণ রূপ দিয়ে গণতন্ত্র কায়েম করতে হবেএই সরকারের কাজ নিয়ে আলোচনারও দুটি ধারা আছে। একটা ধারা হচ্ছে, সরকারের পক্ষ থেকেই বলা হচ্ছে, আমরা কমিশন-টমিশন বানিয়ে সংস্কার করব। আরেকটি ধারা বলছে, গণ-অভ্যুত্থানের অভিপ্রায় অনুসারে গণতন্ত্রকে পূর্ণ রূপ দিতে হবে। জনগণের কাছে যেতে হবে। এর জন্য বিভাগ, জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন, গ্রামে গিয়ে সভা করতে হবে। জনগণ কোন ধরনের রাষ্ট্র চায়, সেটা জনগণের কাছে গিয়েই সবার আগে শুনতে হবে। জনগণের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। এটা রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়—এ রকম বিভিন্ন ধরনের প্রতিনিধি হতে পারে, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি হতে পারে ইত্যাদি। এদের সবার সঙ্গে কথা বলতে হবে। জনগণের সঙ্গে কথা বলার মধ্য দিয়ে জেনে নিতে হবে কী ধরনের রাষ্ট্র জনগণ চায়। গণমাধ্যম এই ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
সেদিক থেকে আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের একটা ইতিবাচক দিক দেখছি। তারা এরই মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলেছে। রাজনৈতিক দল জনগণের অন্তর্গত বটে, কিন্তু রাজনৈতিক দল মানেই জনগণের প্রতিনিধি নয়। ‘গণ’ আর ‘দল’ এক কথা নয়। গণ-সার্বভৌমত্ব (Popular Sovereignty) মানে রাজনৈতিক দলের সার্বভৌম ক্ষমতা নয়। এই ধারণা আমাদের সমাজে রয়েছে বলেই আমরা এমন এক সংবিধান বানিয়ে রেখেছি, যেখানে সাংবিধানিকভাবে একজন ফ্যাসিস্টের হাতেই ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়। রাজনৈতিক দলগুলো সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্র কায়েমের অধিক আমাদের কিছু দিতে পারেনি। গণ-অভ্যুত্থান সে কারণে রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধেও পরিচালিত হয়েছে। গণ-অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক দলের কোনো নেতৃত্ব ছিল না।
এ নিয়ে সমাজের মধ্যে একটা বিভ্রান্তি আছে। রাজনৈতিক দলগুলো দাবি করে, আমাদের সঙ্গে কথা বললেই তো হলো। আবার জনগণের সঙ্গে কথা বলার দরকার কি! আর আমরা বলছি, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অবশ্যই কথা বলতে হবে। কিন্তু সেটা গৌণ। কারণ অন্তর্বর্তী উপদেষ্টা সরকারকে জনগণের সঙ্গেই সবার আগে কথা বলতে হবে। যে কৃষক কথা বলতে পারছেন না, যে শ্রমিক ও খেটে খাওয়া মেহনতজীবী জনগণ কথা বলতে পারছেন না, তাদের সবাইকে কথা বলার সুযোগ করে দিতে হবে, যেন তাঁরা তাঁদের ইচ্ছা বা অভিপ্রায়ের কথা হাজির করতে পারেন। বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার কথা শুনতে হবে, তাদের অভিপ্রায়কে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেতে হবে। যে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কথা আমরা শুনছি না, শুনিনি, কিংবা উপেক্ষা করেছি, গণ-অভ্যুত্থানের পর তাদের অভিপ্রায়ের কথাও আমাদের শুনতে হবে। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা নিজেরাই আট দফা দাবি নিয়ে এসেছে। তারা রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে নিজেদের প্রতিনিধিত্ব চাইছে না। তারা বলছে, ‘এযাবৎকাল বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আমাদের ব্যবহার করেছে। ফলে রাজনৈতিক দলের মধ্যে আমরা যেতে চাইছি না। আমরা আমাদের একটা জোট গঠন করেছি। সেই জোটের মাধ্যমে আট দফা দাবি জানাচ্ছি। ’ তাহলে সরকারকে সেই জোটের কাছেই যেতে হবে। এই জোটও জনগণের প্রতিনিধি। আবার শ্রমিকরাও বলছেন, ‘রাজনৈতিক দল আমাদের প্রতিনিধি নয়। শ্রমিকের যে স্বার্থ, সেই স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব রাজনৈতিক দল করে না। আমাদের নিজস্ব দাবিদাওয়া আছে। ’ ফলে সরকারকে রাজনৈতিক দলের বাইরে শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তেমনি ভেবে দেখুন, আমরা এখনো কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজ নিয়ে আছি। তাহলে অবশ্যই কৃষকের সঙ্গে কথা বলতে হবে, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে তাদের অভিপ্রায়ের কথা বলতে দিতে হবে। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে এই সরকার কথা বলছে, এটা ইতিবাচক দিক। কিন্তু বিপজ্জনক হলো, তাদের আধিপত্য মানতে গিয়ে জনগণকে গৌণ বা অসার করে ফেলার রাজনীতি আবারও শক্তিশালী করে তোলা হচ্ছে। এ কারণে অন্যদের সঙ্গেও কথা বলতে হবে। জনগণের অভিপ্রায় সরকারকে বুঝতে হবে। জনগণের অভিপ্রায়ের ভিত্তিতেই নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করতে হবে। জনগণের সঙ্গে কথা বলা, জনগণের অভিপ্রায়কে সঠিকভাবে চিহ্নিত করা এবং তার একটা সারমর্ম হাজির করা এই সরকারের দায়িত্ব। সরকারকে একটা সম্ভাব্য গঠনতন্ত্র কী হতে পারে তা হাজির করতে হবে। এরপর এই সরকার প্রথম যে নির্বাচন করবে, সেটা হবে গণপরিষদ নির্বাচন; সরকার গঠনের নির্বাচন নয়। গণপরিষদে ওই সম্ভাব্য গঠনতন্ত্র পেশ করা এবং তা নিয়ে আলাপ-আলোচনা, তর্কবিতর্ক হবে। এরপর একটা খসড়া গঠনতন্ত্র চূড়ান্ত করে রেফারেন্ডামের (গণভোট) জন্য জনগণের কাছে যেতে হবে। ভোটের মাধ্যমে জনগণ সেটা গ্রহণ করলে নতুন গঠনতন্ত্র (Constitution) চূড়ান্ত হবে। তখন এটা রাজনৈতিক ও আইনিভাবে বৈধ দলিলে পরিণত হবে। পরে নতুন গঠনতন্ত্র অনুসারে জনগণ যে ধরনের সরকার চায়, সেই সরকার গঠনের জন্য নির্বাচন হবে। শুধু কেন্দ্রীয় সরকার নির্বাচন হলে তো হবে না; বিভিন্ন স্থানীয় সরকারের নির্বাচনও করতে হবে।
রাজনৈতিক দলগুলো দ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে। এ বিষয়টি সম্পর্কে কী বলবেন?
জনগণের সার্বভৌম অভিপ্রায়কে পূর্ণ রূপ দিয়ে গণতন্ত্র কায়েম করতে হবেবাংলাদেশে এখনো ফ্যাসিবাদ বনাম জনগণের লড়াই চলছে। নির্বাচন দাও এবং তার বিপরীতে নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়নের প্রক্রিয়া জোরদার করো—এই দুটি পরস্পরবিরোধী ধারা বিদ্যমান। যারা নির্বাচনের কথা বলছে, তারা ফ্যাসিস্ট শক্তির প্রতিনিধি। কিন্তু ‘জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তি’ জানা ও নির্ণয় করাই এখন এ সরকারের প্রধান কাজ। এই কাজটি অন্তর্বর্তী সরকার যতক্ষণ চালিয়ে যাবে, ততক্ষণ তাকে সমর্থন করাটা সব নাগরিকের কর্তব্য। নতুন গঠনতন্ত্র প্রণীত হওয়ার পর নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি যদি নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসে আসবে। জামায়াত যদি নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসে আসবে। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তার ফ্যাসিস্ট চরিত্র নিয়ে নির্বাচন করতে পারবে কি না, আওয়ামী লীগ নামে বাংলাদেশে রাজনীতি করা যাবে কি না; ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হবে কি না—এসব প্রশ্নের মীমাংসা জনগণের অভিপ্রায় অনুযায়ী করতে হবে। একই সঙ্গে একাত্তরে জামায়াতে ইসলামী নামের যে দল আমাদের জন-আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে ছিল, ২৫ মার্চের নারকীয় হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল, সেই দল সেই নামে বাংলাদেশে রাজনীতিতে অংশ নিতে পারবে কি না, সেটা এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়নে এটাও একটা প্রশ্ন হওয়া উচিত। আমি জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান ভূমিকার প্রশংসা করি। দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান ভাইয়ের সঙ্গে আমার কোনো বিরোধ নাই। তিনি প্রজ্ঞাবান এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ। কিন্তু কেন আপনারা জামায়াতে ইসলামী নামটা বহাল রাখতে চাইছেন? এই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর আমার নাই। কারণ এই নাম জারি থাকলে এর পাল্টা বাঙালি জাতিবাদী ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগও টিকে থাকবে। আমাদের রাজনৈতিক অসুখের নিরাময় দরকার। এসব প্রশ্নেরও মীমাংসা দরকার। আমরা উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদ পরাস্ত করেছি। এখন কি উগ্র ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করা উচিত না? উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদ পরাস্ত হওয়ার কারণে একটা উগ্র ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠছে, যারা মাজার ভাঙছে, অন্যদের অধিকার হরণ করতে চাইছে। এটা তো গুরুত্বপূর্ণ একটা রাজনৈতিক ইস্যু। গণতন্ত্র মানেই তো এই আত্মবিধ্বংসী বিষয়গুলোর মীমাংসা করা।
আবারও বলি, নির্বাচন মানেই গণতন্ত্র—এটা সঠিক নয়। অন্তর্বর্তী সরকারকেও বুঝতে হবে, তারা গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জনগণের রক্তে নির্বাচিত সরকার। জনগণের ইচ্ছার প্রতিনিধিত্ব তারা করতে পারছে কি না, তার দ্বারাই তাদের বৈধতা নির্ণয় হবে। এই সরকারের অনেক শৈথিল্য, ভুলভ্রান্তি থাকা সত্ত্বেও সেনা সমর্থিত উপদেষ্টা সরকারই আমাদের বাস্তবতা। দুর্বল ও শিথিল সরকার হলেও তারা এখনো সঠিক পথে আছে বলেই মনে করি। যে দুর্বলতা আমরা দেখছি, তা আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক এবং রাজনৈতিক চেতনা ও আত্মসচেতনতার অভাব। সরকারের বাইরে থেকে আমাদের কাজ হবে, তারা যেন সঠিক পথ থেকে, সত্যিকারের অভিমুখ থেকে বিচ্যুত না হয় সে বিষয়ে সতর্ক করা। গণ-অভ্যুত্থানের পূর্ণ বিজয় না হলেও যা আমরা অর্জন করেছি, তাকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কথা বলেছে, বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলেছে—এগুলো অবশ্যই সঠিক কাজ। কিন্তু এখনো সরকার কৃষকদের সঙ্গে, নারীদের সঙ্গে, ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অন্তর্গত জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কথা বলেনি। প্রান্তিক মানুষ, যারা বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, তাদের সঙ্গে কথা বলেনি। প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ নিয়ে কথা বলেনি। নদীগুলো বেদখল হয়ে গেছে, এগুলো দখলমুক্ত করার জন্য কী করা দরকার তা নিয়ে কথা বলেনি। খাদ্য ও বীজের সার্বভৌমত্ব কায়েম করার জন্য যাদের সঙ্গে কথা বলা দরকার, তাদের সঙ্গে কথা বলেনি। মানবাধিকার নিয়ে কথা বলেনি। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের জাতীয় প্রতিরক্ষাব্যবস্থা কেমন হবে, সেটা নিয়েও কথা বলেনি। কথা বলার বহু ক্ষেত্র এখনো বাকি রয়েছে।
সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে কথা বলতে হবে। তাদের বাদ দিয়ে নতুন রাষ্ট্র গঠন কি সম্ভব? জাতীয় প্রতিরক্ষাব্যবস্থার কথাও আমাদের নতুন গঠনতন্ত্রে থাকতে হবে। পুরোটাই একটা গঠনতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। এটা নানাভাবে করা যায়। আমার একটা চিন্তা ছিল, আমার নিজস্ব রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনা আছে, যার পক্ষে জনসমর্থনও রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার সেটা গ্রহণ করেনি তাদের দুর্বল অবস্থানের কারণে। এ নিয়ে হৈচৈ করার, বিরাট প্রতিবাদ করার দরকার বলেও আমি মনে করি না। আমার কাজ বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই চালিয়ে যাওয়া। তার পরও বিদ্যমান বাস্তবতার কারণে যা বাস্তবে পাওয়া গেছে, সেই ইতিবাচক অর্জনকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করতে হবে।
চলমান গঠনতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, যাকে অন্তর্বর্তী সরকার বলছে সংস্কার প্রক্রিয়া, ‘সংস্কার’ কথাটা আমার পছন্দ না, আমাদের নতুনভাবে বাংলাদেশ ‘গঠন’ করতে হবে। আমরা নতুন গঠনতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যেই আছি। এটাকে আরো শক্তিশালী, বেগবান করতে হবে। জনগণের কাছে দৃশ্যমান করতে হবে। এটা হলে আমরা গণতন্ত্রের আরেকটা রূপ দেখব। সেই রূপটা রাজনৈতিক দলগুলো আমাদের কাছ থেকে ছিনতাই করে নিতে পারবে না। গণ-অভ্যুত্থান যাতে ছিনতাই হয়ে যেতে না পারে, তার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। সেনাবাহিনীকে পাহারাদারের ভূমিকায় রাখতে হবে। কারণ ছিনতাই হওয়ার নানা রকম অপচেষ্টা সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরে নানাভাবে সক্রিয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের সময়সীমাকে আপনি কিভাবে দেখছেন? কেমন প্রতিরক্ষাব্যবস্থা প্রয়োজন বলে মনে করেন? সম্প্রতি প্রতিবেশী দেশ থেকে বাংলাদেশবিরোধী যে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে, সে বিষয়টি সম্পর্কে আপনার মতামত কী?
প্রথমে সময়সীমা নিয়ে বলি। ধরুন, সাঈদ (আবু সাঈদ) যখন দুই হাত তুলে শহীদ হয়েছিল, তখন তার মনে নিশ্চয়ই একটা অভিপ্রায় ছিল, সে কী ধরনের বাংলাদেশ চায়। মুগ্ধ যখন ‘পানি লাগবে, পানি’ বলে আন্দোলনকারীদের মধ্যে পানি বিতরণের সময় বুলেটবিদ্ধ হয়েছিল, তখন তারও মনে একটা অভিপ্রায় ছিল নতুন বাংলাদেশের। এই রকম প্রায় দেড় হাজার শহীদেরও অভিপ্রায় ছিল নতুন বাংলাদেশের। অন্তর্বর্তী সরকার তত দিনই থাকবে, যত দিন ছাত্র-জনতার সেই অভিপ্রায়, যে অভিপ্রায় এখনো লেখা হয়নি, সেটা লেখার জন্য যতটা সময় প্রয়োজন তত দিন অন্তর্বর্তী সরকারের থাকা উচিত। এর মধ্যে আমাদের কাজ অন্তর্বর্তী সরকারকে পূর্ণ ক্ষমতাসম্পন্ন করার জন্য লড়তে থাকা এবং প্রয়োজনে সরকারের পুনর্গঠনের কাজে সাহায্য করা। ভালো কাজ করলে এই সরকারকে আমরা সহযোগিতা করব। রাজনৈতিক দলগুলোকেও সহযোগিতা করতে হবে। অলিখিত অভিপ্রায়কে যত তাড়াতাড়ি আমরা লিখিত রূপ দিয়ে গণপরিষদে পাস এবং গণভোটে গ্রহণ করাতে পারব, তত তাড়াতাড়ি অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ ফুরিয়ে যাবে। তত দ্রুত অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ সমাপ্তির পথে যাবে। এরপর আসবে নির্বাচন। কিন্তু এই কাজে যদি রাজনৈতিক দলগুলো বাধা দেয়, জনগণ তা মানবে কি না সন্দেহ। আমরা যারা জনগণের পক্ষে কথা বলতে চাইছি, বা বলছি, বলব—অলিখিত যে অভিপ্রায় গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হয়েছে—তা লেখার প্রক্রিয়াকে জোরদার করতে হবে, যাতে আমরা দ্রুত গণপরিষদ নির্বাচনের দিকে যেতে পারি। রাজনৈতিক দলগুলো এ বিষয়ে সহযোগিতা করলে দু-তিন বছরের মধ্যে গণপরিষদ নির্বাচন হতে পারে। না করলে যত দিন পর্যন্ত আমরা নতুন গঠনতন্ত্র না পাচ্ছি, তত দিন অপেক্ষা করতে হবে।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে বিভিন্ন মত ও দলের ছাত্র-জনতা অংশ নিয়েছিল। তাদের সবার অভিপ্রায় কি এক বলে মনে করেন?
সবার অভিপ্রায় এক। তারা সবাই ফ্যাসিস্ট সরকারের অবসান চেয়েছে। অভিপ্রায় ভিন্ন হলে বিএনপি- ছাত্রদল, জামায়াত-ছাত্রশিবির তাদের নিজ নিজ দলের নামেই আন্দোলনে অংশ নিত। তা নেয়নি। একই অভিপ্রায়ে, একই ব্যানারে তারা আন্দোলন করেছে। তাদের অভিপ্রায় ভিন্ন—এটা ভুল অনুমান। বাংলাদেশে ইসলামী বনাম সেক্যুলার—এই বাইনারি তো আমরা অনেক আগেই ভেঙে দিয়েছি। ২০১৩ সালে হেফাজতের আন্দোলনের সময় আমাদের লেখালেখিতে এটা শেষ হয়ে গেছে। নতুন প্রজন্ম এসব পুরনো বাইনারি বা আবর্জনা বহন করে বেড়ায় না। এগুলো বহন করারও কোনো যুক্তি নাই। রাজনৈতিক দলগুলো এবারের আন্দোলনে তরুণদের আকাঙ্ক্ষা, অভিপ্রায় সম্পর্কে অবহিত নয় বলে তাদের আচরণ বিশৃঙ্খল। এবং একটা নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি রাজনৈতিক দলগুলো বারবার তৈরি করছে। কারা করছে? করছে পুরনো রাজনৈতিক দলগুলো। তরুণরা কিন্তু পরিষ্কার, তারা কী চায়।
আপনি কি মনে করেন—ধরুন শিবিরের একটা ছেলে, সে কি ন্যায়বিচার, সাম্য চায় না? সে কি মানবিক মর্যাদা চায় না? প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ ঠিক থাকুক সে কি চায় না? মানবিক মর্যাদা, দেশের সার্বভৌমত্ব চায় না? অবশ্যই চায়।
শিবিরের ছেলেরা যেমন এটা চায়, বাম সংগঠনের ছেলেরাও এসবই চায়। তথাকথিত বাম বনাম শিবির—এগুলো এখন প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্যানধারণা। ভুল ধারণা, অচল বাইনারি। এই ধরনের ভুল ধারণা ও অনুমান থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।
আমাদের নদীগুলো আমরা উদ্ধার করব—এ নিয়ে বাম আর জামায়াত-শিবিরের মধ্যে কি ভিন্নমত আছে? বনগুলো ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে, আমরা বনের জমি উদ্ধার করে বনায়ন করব—এ নিয়ে কারো দ্বিমত নেই। বনের সবচেয়ে বড় রক্ষক বনবাসীরা, যাদের ক্ষুদ্র জাতিসত্তা বলা হয়। তারা তাদের অধিকার ক্ষুণ্ন হচ্ছে বলে সংগ্রাম করছে। তাদের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করব কি না? বাম বলুন, শিবির বলুন—সবাই বলবে, অবশ্যই করতে হবে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অধিকার ক্ষুণ্ন হলে শিবিরের ছেলেরা কি তাদের পাশে দাঁড়াবে না? শিবিরের ছেলেরা তো বেশি ভুক্তভোগী। তারা টুপি পরে বলে, লুঙ্গি-পাজামা পরে বলে, মাদরাসার ছেলে বলে তাদের কি ‘জঙ্গি’ আখ্যা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়নি? সনাতন ধর্মাবলম্বীর কেউ তার অধিকারের কথা বললে তাকে দিল্লির এজেন্ট, বিজেপির দালাল কেন বলা হবে? এসব পুরনো চর্চা। রাজনৈতিক কুফরি। এগুলো বন্ধ করতে হবে। মন্দিরগুলো কি শুধু সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ঐতিহ্য? না, এগুলো আমাদের দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যও বটে। মাজার ভাঙা হচ্ছে। মাজার কি আমাদের ঐতিহ্য না? প্রতিটি মাজারের সঙ্গে এ দেশে ইসলাম প্রচারের ইতিহাস জড়িত আছে। মন্দির, মাজার—এগুলো পর্যটনকেন্দ্র, তীর্থস্থান। যারা এগুলো ভাঙছে বলে সন্দেহ হয় তারা মোসাদের এজেন্ট, ইসরায়েলি এজেন্ট। কারণ এ ধরনের কাজ জায়নবাদী ইসরায়েলই করে। ইসরায়েলকে আমরা দেখেছি ওয়েস্ট ব্যাংকে স্মৃতিস্তম্ভগুলো গুঁড়িয়ে দিতে। মন্দির, মাজার যারা ভাঙতে চায় তারা ‘র’-এরও এজেন্ট বৈকি। কেন? কারণ ইসলামের ইতিহাস উপমহাদেশ থেকে মুছে ফেলার জন্য তারা মসজিদ ধুলায় মিশিয়ে দিচ্ছে। বিভিন্ন স্থান ও নাম পাল্টে দিচ্ছে। ইতিহাসের শিক্ষা বা নিজেদের অতীত জানার জন্য বাংলাদেশকে একটা বিশাল পর্যটনের ক্ষেত্রে পরিণত করতে পারাও রাজনৈতিক কাজ। যদি আমরা আমাদের প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকাগুলো, স্মৃতিস্থানগুলো রক্ষা করতে পারি, সেটা আমাদের স্মৃতি ও ইতিহাস রক্ষা করাও বটে। আমাদের নতুন প্রজন্মকে এসব ভাবতে শিখতে হবে।
আপনি প্রতিরক্ষাব্যবস্থার কথা বলছিলেন, সেটি কেমন হওয়া দরকার? সম্প্রতি আমাদের অন্তর্বর্তী সরকার সম্পর্কে প্রতিবেশী দেশের বিদ্বেষমূলক অপপ্রচারকে কিভাবে দেখছেন?
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার সম্পর্কে শুধু নয়, বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের জনগণের সম্পর্কে ভারতীয় কিছু কিছু উগ্র ও উদ্ভট প্রচারণা চলছে। এগুলো অর্থহীন। সাংবাদিকতাকে কিভাবে তুমুল ভাঁড়ামিতে পর্যবসিত করা যায় তা পশ্চিম বাংলার কিছু সংবাদমাধ্যম না দেখলে আগে বিশ্বাস করতাম না। উদ্ভট প্রচারণায় আমাদের কান না দেওয়াই ভালো। আমাদের কাজ হবে নিজেদের সংহত করা। ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা মাথায় রেখে ঠাণ্ডা মাথায় আমাদের চিন্তা করতে শিখতে হবে।
প্রথম বাস্তবতা হচ্ছে, ভারত শেখ হাসিনাসহ বাংলাদেশের খুনিদের আশ্রয় দিয়েছে। দিল্লির জন্য খুনিদের আশ্রয় দেওয়া মারাত্মক কূটনৈতিক বিপর্যয় তৈরি করতে পারে। এখন না হোক, এর জন্য ক্রমে ক্রমে দিল্লিকে প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে। দিল্লি এটা জানে এবং বোঝে। ফলে কৌশল হিসেবে দিল্লি ‘হিন্দু কার্ড’ বা ‘সংখ্যালঘু কার্ড’ খেলছে, যাতে ভারতে খুনিদের আশ্রয় দেওয়া সম্পর্কে বাংলাদেশ কোনো উচ্চবাচ্য না করে। ভারত বাংলাদেশকে যেকোনো মূল্যে অস্থিতিশীল এবং খুনিদের পুনর্বাসিত করার চেষ্টা করবে। স্থিতিশীল বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত। উন্নতি বা অর্থনৈতিক বিকাশ অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশকে একটি আঞ্চলিক অর্থনৈতিক শক্তিকে পরিণত করতে পারে, যার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব অবশ্যই বাংলাদেশের সন্নিহিত ভারতীয় রাজ্যগুলোতে পড়বে। হিন্দুত্ববাদী ভারত ও দিল্লির শঙ্কা এখানেই। সেই উদ্দেশ্যে নানা অপপ্রচার দিল্লি চালাবে। তবে তা সরকারিভাবে করতে পারবে না। কারণ খুনিকে আশ্রয় দিয়ে এরই মধ্যে তারা কূটনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যে আছে। শেখ হাসিনা দেশে ফিরতে পারবেন না। তাঁর বিরুদ্ধে মামলা আছে। তিনি খুনি, অপরাধী। কয়েক হাজার লোককে তিনি খুন করেছেন, গুম করেছেন, আয়নাঘর করেছেন ইত্যাদি। এসব অপরাধ থেকে তিনি নিষ্কৃতি পাবেন কী করে? আজ হোক কাল হোক, তাঁর বিচার হবেই। ভারত এ রকম একজন খুনিকেই আশ্রয় দিয়েছে। সে কারণে ভারত সরকারিভাবে কিছু বলবে না বটে, কিন্তু বিভিন্নভাবে বিভিন্ন মাধ্যমে অপপ্রচার ও উসকানি চালাবে। সেটাই চলছে। এতে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই।
এইসব উসকানির জবাব না দিয়ে আমাদের তিনটি কাজ করতে হবে। একটি হলো সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনা। তাদের যে নিরাপত্তাহীনতা, তা কাটিয়ে তুলতে হবে। তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। বলতে হবে, আপনাদের আট দফা দাবি এবং আরো যদি দাবি থাকে সেগুলো নিয়ে আসুন, আমরা সরকারের সঙ্গে বসে মীমাংসা করি। বলতে হবে, আসুন, আপনারাও আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের পক্ষে বক্তব্য দেন। ভারতের এইসব আচরণ এবং এই যে শুভেন্দু (পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী) সীমান্তে এসে রাজনৈতিক গুণ্ডাগিরি করছে, বিএসএফ যে গুণ্ডাগিরি করছে—এইসব যুদ্ধবাজ প্ররোচনার বিরুদ্ধে আসুন আমরা একসঙ্গে প্রতিবাদ করি। কারণ এই দেশ আমাদের সবার। আমি মনে করি, বেশির ভাগ সনাতন ধর্মাবলম্বী আমাদের সঙ্গে থাকবে, যদি আমরা তাদের নিরাপত্তাহীনতা—বিশেষত নিরাপত্তার অভাব আমরা আন্তরিকভাবে দূর করতে পারি। এটা পুলিশ দিয়ে কিংবা ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের দ্বারা তাদের মন্দির ও বাড়িঘর পাহারা দিয়ে হবে না। একদিকে দরকার সবার মানবিক ও নাগরিক অধিকার রক্ষা করে সে রকম একটি গঠনতন্ত্র তৈরি এবং পাশাপাশি জনগণের নৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনার বিকাশ। সনাতন ধর্মাবলম্বী কিংবা খ্রিস্টান, সব আস্তিক বা নাস্তিক সবাই বাংলাদেশের নাগরিক। তারা যাতে নির্ভয়ে কোনো আইনি, পুলিশি বা সামাজিক পাহারা ছাড়া বাংলাদেশে নিরাপদে বাস করতে পারে, সেই বাস্তবতা তৈরি করতে হবে। তাদের নিরাপত্তাজনিত আশঙ্কা ও ভয় কাটিয়ে তুলতে হবে। তাদের নিরাপত্তা দিতে না পারলে, তাদের যদি পুলিশি পাহারায় পূজা করতে হয়, তাহলে তারা স্বাভাবিকভাবেই নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ভারতের দিকেই তাকিয়ে থাকবে।
দুই নম্বর কাজ হবে, অবিলম্বে দেশের সবাইকে বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে হবে। এটা খুব কঠিন কিছু নয়। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোর শিক্ষার্থীদের শর্ট ও লং কোর্সে সামরিক প্রশিক্ষণ শুরু করতে হবে। লং কোর্স যারা শেষ করবে, তাদের সামরিক বাহিনীতে নেওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া যারা হাই স্কুল পাস, অন্তত দ্বিতীয় বিভাগের সমমানে পাস করেছে, তাদের বৃত্তি দিয়ে দুই বছরের জন্য সামরিক বাহিনীতে নিয়োগ প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে। সামরিক প্রশিক্ষণের সঙ্গে বিভিন্ন কারিগরি শিক্ষা তারা পাবে। নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য উপযুক্ত নৈতিক ও সাংস্কৃতিক শিক্ষাও তারা পাবে। এতে দেশে সুশৃঙ্খল জনসম্পদ গড়ে উঠবে। যারা একদিকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিকাশে ভূমিকা রাখবে, অন্যদিকে একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে তারা গড়ে উঠবে। সংকটের সময় ডাক পড়লে দেশরক্ষার জন্য প্রস্তুত থাকবে।
আর তিন নম্বর হচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা। যে কথাগুলো আগে বলেছি, এই কথাগুলো আরো খোলামেলাভাবে বুদ্ধিবৃত্তি ও রাজনৈতিক আলোচনার বিষয় হিসেবে আলোচনা ও পর্যালোচনা করা দরকার। মিডিয়াগুলোর উচিত হবে সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে, নীতিনৈতিকতা গঠনে, প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ও অর্থনীতি গঠনে অবদান রাখে সেইসব আলাপ-আলোচনা গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করা।
দেশটাকে যেভাবে গুছিয়ে তোলা দরকার, অন্তর্বর্তী সরকার সেভাবে পারছে কি না? আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় গাফিলতি, বিভিন্ন ধরনের আন্দোলন, যে যেভাবে পারছে রাস্তায় নেমে পড়ছে—এটি কি এ সরকারের ব্যর্থতার কারণেই?
আপনারা কি চাইছেন, এ সরকার কারফিউ জারি করুক? গণবিরোধী কড়া অবস্থান নিক? আমাদের গণ-অভ্যুত্থানটি একটি অভূতপূর্ব ঘটনা। আমাদের স্বীকার করতে হবে, এই অভূতপূর্ব ঘটনা আমরা ঘটাতে পেরেছি এবং এটি আমাদের জন্য গর্বের। গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী শৈথিল্য, দুর্বলতা ঐতিহাসিক। সরকারে যাঁরা আছেন, তাঁরা চাইলেই সমস্যাগুলোর সমাধান কালকেই করে ফেলতে পারবেন, এমন নয়। এই সমস্যা নিরসন ফেরেশতা নাজিল হলেও পারবে না। কেন পারবে না? কারণ আমরা একটি অসাধ্য সাধন করেছি ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে উত্খাত করে। হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু নতুনভাবে দেশকে গড়া বা গঠন করা অনেক বেশি কঠিন কাজ।
দেখুন, পুলিশকে ব্যবহার করা হয়েছে জনগণকে হত্যা করার জন্য, ফ্যাসিস্ট স্বার্থ কায়েম করার জন্য। এই পুলিশের অনেকে বিপুল অর্থ-সম্পদের মালিক হয়ে গেছে। দুর্নীতিগ্রস্ত সেই পুলিশরা কি শুধু বেতন নিয়ে কাজ করার জন্য ফিরে আসবে? ফলে আবার নতুন করে পুলিশি ব্যবস্থা গড়ে তোলা, রিফর্ম করা বিশাল চ্যালেঞ্জের বিষয়। সেই চ্যালেঞ্জ বর্তমান সরকারকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলো সরকারকে সহযোগিতা করছে না। দখলবাজি শুরু হয়ে গেছে। বাস্তবের বিপুল চ্যালেঞ্জের কথা ভাবলে সরকার কি আসলে খারাপ করছে? না, মোটেও না। তবে আমাদের প্রত্যাশা অনেক বড়, তাই অনেক সময় তা সরকারের ব্যর্থতা বলে মনে হয়। সেটা আমাদের অবাস্তব আকাশকুসুম প্রত্যাশাও তো হতে পারে।
এই সরকারের বিষয়ে আমার সমালোচনা ভিন্ন। আমি আগেই বলেছি, আমি এই সরকারকে সেভাবে অন্তর্বর্তী সরকার বলি না। সরকার যেটি হয়েছে সেটি হলো, সেনা সমর্থিত উপদেষ্টা সরকার, এই সরকারের হাতে ক্ষমতা খুব কম। তা ছাড়া কিছু গণবিরোধী, অর্থাৎ গণবিরোধী ব্যক্তি সরকারে ঢুকে পড়েছে, ফলে সরকার অনেক বেশি দুর্বল। কম ক্ষমতা নিয়েই এই সরকার চেষ্টা করছে যতটুকু সম্ভব পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার।
এ অবস্থায় আমাদের দরকার পূর্ণ ক্ষমতাসম্পন্ন অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের দাবি জোরদার করা। সংবিধান বাতিল করা, এটি করতে হলে, আমি বারবার বলেছি, এই সরকারকে ঘোষণা করতে হবে, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আমরা পূর্ণ ক্ষমতাসম্পন্ন অন্তর্বর্তী সরকার হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করলাম। আমরা কারো উপদেষ্টা বা উপদেষ্টা সরকার নই। প্রচলিত আইন দ্বারাই নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ন পর্যন্ত এই রাষ্ট্র চলবে। কিন্তু যদি কোনো আইন আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ হয়, শুধু সেই আইন বাতিল হবে। এটা হলে ড. মুহাম্মদ ইউনূস হবেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কিংবা পূর্ণ নির্বাহী ও আইনি ক্ষমতাসম্পন্ন প্রেসিডেন্ট। তাঁর আদেশ-নির্দেশেই দেশ পরিচালিত হবে। সরকারকে শক্তিশালী অবস্থায় দেখতে পারব। প্রেসিডেন্ট হিসেবে অন্য দেশের সঙ্গে তাঁর বোঝাপড়াও হবে পরিচ্ছন্ন ও সরাসরি। নিজে প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী না হয়ে প্রেসিডেন্টের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে তিনি অন্যান্য রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে প্রটোকল অনুযায়ী একই কাতারে বসতে পারেন কি না এ বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে।
(দৈনিক কালের কণ্ঠের ১৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশিত)
বাংলাদেশ সময়: ১৫০৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১০, ২০২৫