খুলনা: খুলনাঞ্চলের সড়কগুলোতে ভয়াবহভাবে বাড়ছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। বেপরোয়া গতিতে নিয়ম না মেনে মোটরসাইকেল চালাতে গিয়ে যুবক ও উঠতি বয়সী কিশোররা দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন।
সর্বশেষ মঙ্গলবার (১৫ মার্চ) সকালে খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলায় ট্রাকের সঙ্গে সংঘর্ষে মোটরসাইকেল আরোহী রাজন নামের এক কলেজছাত্র নিহত হয়েছেন। রাজন ও মেহেদি নামের দুই কলেজ ছাত্র মোটরসাইকেলযোগে ঢাকায় যাচ্ছিলেন। চুকনগর এলাকায় পৌঁছালে বিপরীত দিক থেকে আসা একটি ট্রাক তাদের মোটরসাইকেলে ধাক্কা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যান চালকের আসনে থাকা রাজন। এ দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন মেহেদি।
শনিবার (১২ মার্চ) দুপুর ২টায় তেরখাদার আজগড়া ইউনিয়নের পূজাখোলা এলাকায় ইটবাহী ট্রলির সঙ্গে মোটরসাইকেলের সংঘর্ষে গোলাম মোহাম্মদ মুহিত (৩৫) নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়। গোলাম মোহম্মাদ মুহিতের গ্রামের বাড়ি হাড়িখালী থেকে তার আত্মীয় স্বজন, বাবাসহ সাতটি মোটরসাইকেলে এক সঙ্গে খুলনার উদ্দেশে রওয়ানা হন।
আজগড়া ইউনিয়নের পূজাখোলা এলাকায় পৌঁছালে বিপরীতমুখী ইটবোঝাই ট্রলির সঙ্গে মুহিতের মোটরসাইকেল সংঘর্ষ হলে তিনি আহত হন। পরে তাকে উদ্ধার করে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। নিহত মুহিত হাড়িখালী এলাকার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী মো. গোলাম মোস্তফার একমাত্র ছেলে।
এর আগে খুলনার ফুলতলার জামিরায় শুক্রবার (১১ মার্চ) বিকেলে মোটরসাইকেল ও ইজিবাইক সংঘর্ষে মোটরসাইকেল চালক অনুজ কুমার মণ্ডল (৩২) ঘটনাস্থলে নিহত হন। এ সময় ইজিবাইক চালকসহ আরও চার ব্যক্তি গুরুতর আহত হন।
মোংলায় মেলা থেকে ফেরার পথে বুধবার (৯ মার্চ) রাত সাড়ে ১২টার দিকে মোটরসাইকেলের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বৈদ্যুতিক খুঁটির সঙ্গে ধাক্কা লেগে চালক ও আরোহীসহ তিনজন নিহত হন। চাঁদপাই পীর মেশের শাহ মাজারের পূর্ব পাশে স্কুল সংলগ্ন এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। মেলা দেখে মোটরসাইকেলে তিন বন্ধু বাড়ি ফিরছিল। পথিমধ্যে চাঁদপাই স্কুল সংলগ্ন মৌখালী নতুন সংযোগ রাস্তায় (মুচি বাড়ি সংলগ্ন) এলাকায় বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালানোর সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার পাশে একটি বৈদ্যুতিক খুঁটির সঙ্গে ধাক্কা লাগে। এ সময় মোটরসাইকেল চালক জাকারিয়া, আরোহী শাকিব ও বায়েজিত তিনজনই ঘটনাস্থলে হাত-পা ও মাথায় আঘাত পান এবং মাথা ও নাক মুখ দিয়ে রক্তক্ষরণ হয়। তাদের মোটরসাইকেলটি ধুমড়ে-মুছড়ে রাস্তার পাশে পড়ে থাকে। পথচারীরা মুমূর্ষু অবস্থায় তাদের উদ্ধার করে মোংলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন।
ডুমুরিয়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় আহত মোটরসাইকেল আরোহী অ্যাডভোকেট সোহেল পারভেজ বাবু সোমবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) সকাল সাড়ে ৭টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আট দিন মারা গেছেন। তিনি ডুমুরিয়া উপজেলার মিকশিমিল গ্রামের বাসিন্দা।
গত ২০ ফেব্রুয়ারি খুলনা সাতক্ষীরা মহাসড়কের জিলেরডাঙ্গা এলাকায় পিকআপ ভ্যানের সঙ্গে তার মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে মহাসড়কে ছিটকে পড়ে গুরুতর আহত হন সোহেল পারভেজ বাবু। আহত অবস্থায় প্রথমে তাকে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। পরে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়।
রোববার (১৩ ফেব্রুয়ারি) রাত সাড়ে নয়টার দিকে মহানগরীর শিপইয়ার্ড সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকায় ট্রাক ও মোটরসাইকেল সংঘর্ষে সুজন (৩০) নামে এক যুবক নিহত হন। নিহত সুজন রূপসা উপজেলার বিল্লালের ছেলে।
রোববার (২৩ জানুয়ারি) দুপুরে খুলনার খালিশপুর নতুন রাস্তার মোড়ে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রশান্ত কুমার বালা (৪০) নামে এক মোটরসাইকেল আরোহী নিহত হন। নগরীর খালিশপুর নতুন রাস্তার মোড়ে এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত প্রশান্ত গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া উপজেলার সেনেরচর গ্রামের প্রফুল্ল বালার ছেলে।
প্রশান্ত তার আত্মীয় সুজিৎ কুমার বিশ্বাসকে সঙ্গে নিয়ে মোটরসাইকেল যোগে খুলনা থেকে দৌলতপুরের দিকে যাচ্ছিলেন। পাশাপাশি আরেকটি ট্রাক একই দিকে যাচ্ছিল। এ সময় হঠাৎ করে একজন পথচারী মোটরসাইকেলের সামনে এসে পড়লে প্রশান্ত মোটরসাইকেল ব্রেক করলে ট্রাকের নিচে চাপা পড়ে। এতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।
ডুমুরিয়া উপজেলার রামকৃষ্ণপুরের সুনিল মণ্ডলের ছেলে অনুজ কুমার মণ্ডল এবং খোকন চন্দ্রের ছেলে অনুপ চন্দ্র (৩২) মোটরসাইকেল যোগে ভবদাহ থেকে জামিরা বাজারে যাচ্ছিলেন। জামিরার শেখ বাড়ির সামনে পৌঁছালে বিপরীতমুখী ইজিবাইকের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এ সময় মোটরসাইকেল চালক অনুজ ঘটনাস্থলেই নিহত হন।
খুলনা সাতক্ষীরা সড়কে ডুমুরিয়ার জিলেরডাঙ্গায় শুক্রবার (৭ জানুয়ারি) সড়ক দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেল চালক নিহত ও অপর যাত্রী আহত হন। উপজেলার শোভনা পশ্চিম পাড়ার মৃত শরীয়াতুল্লাহের ছেলে আজিজ শেখ ও একই গ্রামের সিদ্দিক মোল্যা (৫৫) নামে দুই ব্যক্তি মোটরসাইকেলে খুলনা থেকে বাড়ি ফেরার পথে ডুমুরিয়ার জিলেরডাঙ্গায় পৌঁছালে অজ্ঞাত গাড়ির চাকায় পৃষ্ট হয়ে মোটরসাইকেল চালক আজিজ ঘটনাস্থলেই নিহত হন।
এসব দুর্ঘটনা অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অতিরিক্ত গতি ও ওভারটেকি, অপ্রশস্ত রাস্তা, সড়কে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক, চালানোর সময় ফোনে কথা বলা, গান শোনা, ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানা, একাধিক বাইক এক সঙ্গে চলাচল, সিগন্যাল লাইটের সদ্ব্যবহার না করা, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় মোটরসাইকেল চালানো, কিশোর ও যুবকদের বেপরোয়াভাবে মোটরসাইকেল চালানো, প্রতিযোগিতা করা, হেলমেট ব্যবহার না করাসহ নানা কারণে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটছে।
নিরাপদ সড়ক চাইয়ের (নিসচা) খুলনা মহানগর শাখার সভাপতি এসএম ইকবাল হোসেন বিপ্লব বাংলানিউজকে বলেন, দেশে গণপরিবহন ব্যবস্থা উন্নত ও সহজলভ্য না হওয়া এবং যানজটের কারণে মানুষ মোটরসাইকেল ব্যবহারে উৎসাহিত হচ্ছে এবং দুর্ঘটনা বাড়ছে। সম্প্রতি সময়ে খুলনাঞ্চলের সড়কগুলোতে ভয়াবহভাবে বাড়ছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। সেই সঙ্গে ঝড়ছে তাজা প্রাণ। অনেকে হচ্ছেন পঙ্গু। সাধারণত বেপরোয়া গতিতে নিয়ম না মেনে মোটরসাইকেল চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটছে। অনেক সময় দেখা যায় সড়ক মহাসড়কে কে কত কায়দা করে মোটরসাইকেল চালাতে পারেন তার প্রতিযোগিতা চলে। কেউ কেউ দুই হাত ছেড়ে চালানোর চেষ্টা করেন। আর এতে ঘটে দুর্ঘটনা।
খুলনা জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ মাহবুব হাসান (বিপিএম) বাংলানিউজকে বলেন, বেশিরভাগ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার প্রধান কারণ বেপরোয়া গতি ও অদক্ষ চালক। যারা সড়ক ব্যবহার করে তাদের সচেতন ও সাবধান থাকতে হবে। কোনো কোনো রাস্তায় কাজ চলছে আবার কোথাও ভালো। ভালো জায়গায় যে গতিতে মোটরসাইকেল চালানো যায় কাজ চলতে থাকা রাস্তায় সে গতিতে চালানো যায় না এটা মাথায় রাখতে হবে। চালককে মনে রাখতে হবে তার সঙ্গে থাকা সবার জীবনের দায়িত্ব তার। প্রতিযোগিতা করা যাবে না। অদক্ষ চালকরাই মূলত এ ধরনের প্রতিযোগিতা করে। হেলমেট মাথায় দিয়ে মোটরসাইকেল চালাবেন ট্রাফিক পুলিশের ভয় বা জরিমানা দিতে হবে এ জন্য নয়। আপনি হেলমেট পরবেন এজন্য যে আপনি নিরাপদে বাসায় যাবেন। আপনার যে সন্তান বা পরিবার পরিজন রয়েছে তাদের হাসি মুখটা দেখার জন্য। যখন একথাটা মনে রাখতে পারবেন পুলিশের ভয়ে নয় পরিবারের সদস্যদের হাসির জন্য পড়তে হবে হেলমেট তখন দুর্ঘটনা অনেক কমে আসবে। দুর্ঘটনা এড়াতে গতি সীমিত রেখার কোনো বিকল্প নেই। নিয়ন্ত্রণের বাইরে গতিতে মোটরসাইকেল চালানো যাবে না এই বিষয়টি মনে রাখতে হবে প্রতিটি বাইকারকে।
পুলিশ সুপার মনে করেন মোটরসাইকেল দুর্ঘটনাগুলো মূলত ঘটে বেপরোয়া গতি, ওভারটেকিংয়ের চেষ্টা, বারবার লেন পরিবর্তন, ট্রাফিক আইন না মানা, একাধিক বাইক এক সঙ্গে চলাচল ও চলন্ত অবস্থায় মোবাইল ফোনে কথা বলা ও গান শোনার কারণে। হেলমেট ব্যবহার না করা ও নিম্নমানের হেলমেটের কারণে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ও আহতের সংখ্যা বাড়ছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৯০৮ ঘণ্টা, মার্চ ১৬, ২০২২
এমআরএম/আরআইএস