ঢাকা, মঙ্গলবার, ২০ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

বেদে জীবনের সবচেয়ে বড় উপহার প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া ঘর

হোসাইন মোহাম্মদ সাগর, ফিচার রিপোর্টার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭০৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ৮, ২০২২
বেদে জীবনের সবচেয়ে বড় উপহার প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া ঘর

ঝিনাইদহ থেকে ফিরে: দুই ছেলে আর অসুস্থ স্বামী নিয়ে ছোট্ট সংসার বেদেনী যুবাইদা আক্তারের। অসুস্থতার জন্য স্বামী যখন কাজে যেতে পারেন না, তখন তিনি গ্রামে গ্রামে দল বেধে ঘুরে বেদেনী হিসেবে উপার্জন করেন।

এতে কেউ টাকা দেন, কেউ চাল কিংবা ডালও দেন। এভাবেই চলে সংসার।

বাঁশের কঞ্চি আর পলিথিন দিয়ে তৈরি তাদের ছোট্ট ঘর। ঘরটা এতটাই ছোট যে, রাতে একজনকে শুতে হয় তাবুর বাইরে, অনেকটা খোলা আকাশের নিচে। রান্না-খাওয়ার ব্যবস্থাও এখানেই। হিসেব যেন ছোট্ট বেলার পুতুল খেলা সংসার। তবে এই সংসার এবার বড় হচ্ছে। বেদে সম্প্রদায়ের জীবনমান উন্নয়নে পিছিয়ে পড়া এই জনগোষ্ঠীকে মূল ধারায় নিয়ে আসতে এই প্রথম উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।

এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে বেদে সম্প্রদায়ের জন্য ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে ঝিনাইদহে কালীগঞ্জ উপজেলার জগন্নাথপুর গ্রামের মাজদিয়া বাঁওড় এলাকায়। সর্ববৃহৎ এই আবাসনের নির্মাণ কাজ ইতোমধ্যে শুরু করেছে উপজেলা প্রশাসন। শীঘ্রই যুবাইদার মতো ৫৯টি বেদে পরিবারকে বুঝিয়ে দেওয়া হবে মুজিববর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া এই উপহার।

সম্প্রতি ঝিনাইদহের এই এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বর্তমানে বসবাসরত বারবাজার ইউনিয়নের বাদেডিহি গ্রামের বেদে পল্লীতে বাঁশের কঞ্চি আর পলিথিন দিয়ে তৈরি তাঁবুতে বসবাস করছেন ৩১টি বেদে পরিবার। নেই স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট, গোসলখানা। তাবুর ঘরগুলো এতটাই ছোট যে, হাঁটু গেড়ে তাবুর ভেতরে ঢুকতে হয়। ভেতর সোজা হয়ে দাঁড়ানোর জায়গা পর্যন্ত নেই। ছোট্ট তাঁবুর ভেতরেই রান্না ও খাওয়ার ব্যবস্থা। এখানে এমন পরিবারও রয়েছে, স্বামীকে নিয়ে বাবা-মা, ভাই-বোনদের সঙ্গে ছোট্ট এই খুপরি ঘরে বসবাস করে আসছেন পরিবারের বিবাহিত মেয়েরা। বিবাহিত ছেলেও স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ছোট্ট তাবুতে বাবা-মার সঙ্গে থাকছেন, ঘুমচ্ছেন।

এই নিয়ে যুবাইদা আক্তার বলেন, আমার দুই সন্তান আর স্বামীকে নিয়ে ভাসা ভাসা এক সংসার। ছোট্ট এই খুপড়ি ঘরেই জীবন। বাবা-মা, শ্বশুর-শাশুড়ি থাকেন পাশেই। আর তাবুর জায়গা ছোট হওয়ায় রাতে একজনকে থাকতে হয় তাবুর বাইরে। আমাদের মতো কষ্ট জীবনে খুব কম মানুষই করে। তবে এবার যেন একটু সুখের স্বপ্ন দেখছি। কখনো ভাবিনি নিজের একটা ঘর হবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর উপহার আমাদের জীবনের সবথেকে বড় উপহার।

ঘর পাওয়ার আগাম খবরে খুশিতে আত্মহারা বেদে পরিবারগুলো। নতুন ঘরে কীভাবে থাকবেন, কীভাবে ঘর সাজাবেন- এখন সেই স্বপ্ন বুনছেন তারা। এ নিয়ে রঙ্গিলা বেগম নামে বেদে পল্লীর এক বাসিন্দা বলেন, কমাস আগে স্যাররা আইসা নাম নিয়া গেছে। হেরা বলছে, হামাগোরে নাকি ঘর দিবোইন। হে ঘরের কাজ চলছৈই। হামারা অপেক্ষায় আছি। ঘর পাওয়ার খবরে খুশি আমার বৃদ্ধ মা, ছোট ভাইসহ পরিবারের সদস্যরা। সে ঘরে কীভাবে থাকবো, কীভাবে সাজাবো, এখন সেইসব ভাবতেই মনটা চাঙ্গা হয়ে ওঠে।

বেদে পল্লীর আরেক বাসিন্দা আওলাদ (২১)। স্ত্রী কহিনুর ও এক ছেলে রাহুলকে নিয়ে থাকেন এখানে। তিনিও অন্যের মতো সাপ ধরেন, সাপ ও বানর খেলা দেখান। তার স্ত্রী গ্রামে গিয়ে সিঙ্গা দেন ও দাঁতের পোকা তুলেন। কালীগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন তারও নাম, ঠিকানাসহ যাবতীয় কাগজপত্র নিয়েছে। নির্মাণ কাজ শেষ হলে তিনিও ঘর পাবেন, এই আনন্দে আত্মহারা আওলাদ ও তার পরিবার। খুশিতে তিনি বলেন, কোনো আমলে কোনো সরকার আমাগো কথা ভাবেনি। আমরা যে কী কষ্টে দিন কাটাচ্ছি, এক আল্লাহ আর আমরা ছাড়া অন্য কেউ জানে না। এই যে গরমের দিন, মাথার ওপরে একটা ফ্যান পর্যন্ত নাই। আমাগো নামধাম নিয়া গেছে। শুনছি, প্রধানমন্ত্রী আমাদের ঘর দেবেন। যা আয় হয়, তাতেই সংসার চলে না। ঘর করার স্বপ্নও দেখিনি কখনও। ঘর পাইলে অন্তত মাথা গোঁজার ঠাঁই হবে।

কালীগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, কালীগঞ্জ পৌর এলাকার কাশিপুর গ্রামের ২৮টি এবং বারবাজার ইউনিয়নের বাদেডিহি গ্রামে ৩১টিসহ মোট ৫৯টি বেদে পরিবার রয়েছে। এই পরিবারগুলোর জমি ও ঘর কোনটাই না থাকায় মানবেতর জীবনযাপন করে আসছে। তাই আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের অধীনে সারাদেশের গৃহহীন ও আশ্রয়হীন পরিবারের জন্য নির্মিত ঘরের মতো কালীগঞ্জেও ২ একর খাস জমিতে বেদে সম্প্রদায়ের জন্য ঘরগুলো নির্মাণ করা হচ্ছে। বারবাজার ইউনিয়নেরই ৯ নম্বর ওয়ার্ডের জগন্নাথপুর গ্রামের ‘মাজদিয়া বাঁওড়’ এলাকায় বেদে পল্লীদের জন্য ঘর নির্মাণ কাজ চলছে। যেখানে কাজ চলছে এর সামনেই পাকা রাস্তা, পাশে হাওড়। আশপাশে রয়েছে ফসলি জমি, গাছগাছালি।

এ নিয়ে ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসক মনিরা বেগম বলেন, বেদেরা যেহেতু নদীতে থেকে অভ্যস্ত, তাই হাওড়ের পাশেই ঘরগুলো নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে তারা মনে করবেন, তারা নদীতেই বসবাস করছেন। আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের তৃতীয় পর্যায়ের নির্মিত ঘরগুলো অধিকতর টেকসই ও দুর্যোগ সহনীয় করে নির্মাণ করা হচ্ছে। এখানে বেদে সম্প্রদায়ের লোকরা থাকবেন বলে রাজি হয়েছেন। এই প্রথম বেদে সম্প্রদায়ের জন্য সর্ববৃহৎ আবাসস্থল করা হচ্ছে। ঘরের পাশে খালি জায়গা থাকবে। এতে চাইলে বেদে পরিবারগুলো গবাদি পশু পালন ও শাকসবজি চাষ করতে পারবেন। শিশুদের খেলাধুলার জন্য করা হবে পার্ক।

বেদে সম্প্রদায়ের লোকজন বলছেন, আগামীকাল কি খাব, সেই চিন্তা মাথায় নিয়েই প্রতি রাতে ঘুমাতে যেতে হয়। সকাল হতেই বেরিয়ে যেতে হয় দিনের আহারের সন্ধানে। জীবন যুদ্ধে টিকে থাকাই যেখানে দুষ্কর, সেখানে নিজে ঘর করবো, সেই ঘরে থাকব- এমন স্বপ্ন থাকলেও দৃশ্যমান বাস্তবতায় সেই স্বপ্ন লালন করা ও বাস্তবায়ন করার সাহস কখনই হয়নি। প্রধানমন্ত্রী ঘর দিলে সেই স্বপ্ন পূরণ হবে, রোদ-বৃষ্টি থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। সন্তানদের পড়ালেখা করিয়ে মানুষ করত পারবো।

আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক আবু ছালেহ মোহাম্মদ ফেরদৌস খান বলেন, সমতল ভূমিতে অন্যান্যদের যে ডিজাইনের ঘর দেওয়া হচ্ছে, ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীকেও একই ডিজাইনের ঘর করে দেওয়া হচ্ছে। সেটার মূল্যমানও একই। আমরা তাদের জীবনমান উন্নয়নেও কাজ করছি। অনেক জায়গায় ঘর দেওয়ার পরে সেখানকার সন্তানেরা প্রথম স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে দল বেধে। আমরা তাদেরকে শুধু ঘর দেইনি। তাদেরকে সাইকেল দিচ্ছি। উত্তরবঙ্গে এখন দলে দলে কিশোরী মেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে সাইকেল চালিয়ে। তাদের কিন্তু দারুণ পরিবর্তন হয়েছে। তাদের ১৮শ ছেলে মেয়ে কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে তাদের লেখাপড়ার খরচ দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। এই বেদে জনগোষ্ঠীর উন্নয়নেও কাজ করা হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৭০৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৮, ২০২২
এইচএমএস/কেএআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।