গাইবান্ধা: গ্রাম বাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মৃৎ শিল্প। একটা সময়ে মানুষের দৈনন্দিন ব্যবহার্য পণ্যের প্রায় সবটাই ছিল মৃৎশিল্প নির্ভর।
জেলার সদর উপজেলার পালপাড়া, শিবপুর, কলাকোপা, ধুতিচোরা, ফুলছড়ির রসুলপুর, কঞ্চিপাড়া, ভাষারপাড়া, সাঘাটার ঝাড়াবর্ষা, পুটিমারী, সুন্দরগঞ্জের বেলকা, পাঁচপীর, ধুবনী, চন্ডিপুর, কঞ্চিবাড়ী, শ্রীপুর, ধর্মপুর, সাদুল্যাপুরের রসুলপুর, দামোদরপুর, পলাশবাড়ীর হিজলগাড়ী, গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কোচাশহর, আরজিশাহপুর ও শক্তিপুর গ্রামের ৭শ’ পরিবার এখনও পৈত্রিক পেশাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন।
পলাশবাড়ী পৌরশহরের হিজলগাড়ী গ্রাম ঘুরে এমনই চিত্র চোখে পড়ে।
নিজেদের পেশা-ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে দিনরাত লড়াই করে যাচ্ছেন ওই গ্রামের পাল পাড়ার প্রতিটি বাড়ির মৃৎশিল্পী নারী-পুরুষরা।
কেউ ব্লেড দিয়ে মাটি কেটে তাতে পানি দিয়ে ছানছেন, কেউবা সেই মাটি দিয়ে বৈদ্যুতিক মেশিনে তৈরি করছেন বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী, কেউ সেগুলো রোদে শুকতে ব্যস্ত, কেউ তৈরিকৃত পণ্য রঙে রাঙিয়ে তোলার কাজ করছেন, আবার কেউ সেগুলোকে দীর্ঘস্থায়ী রূপান্তরের লক্ষ্যে আগুনে পুড়ছেন।
তাদেরই একজন ষাটোর্ধ্ব পুলিন চন্দ্র পাল। এ বয়সে বিদ্যুৎচালিত মেশিনে তৈরি করছেন ফুলদানি ও দইয়ের বাটিসহ বিভিন্ন খেলনা সামগ্রী। পাশেই রঙের কাজে ব্যস্ত তার স্ত্রী মধু রানি। অন্যদিকে স্ত্রী ঝর্ণা রানীকে নিয়ে রং করা পণ্যগুলো আগুনে পোড়াচ্ছেন ওই দম্পতির ছেলে খোকন চন্দ্র পাল। শেবেন চন্দ্র পাল নামে এ দম্পতির আরও এক ছেলে। নাতি- নাতনীসহ পরিবারের সদস্য সংখ্যা দশজন। এ পেশাতেই মিটছে পরিবারটির মৌলিক চাহিদা।
টিকে থাকার লড়াইয়ের সম্পর্কে তিনি জানান, আগে ঘাড়ে করে মাটির তৈরি বিভিন্ন সামগ্রী নিয়ে গ্রামে-গ্রামে বিক্রি করতাম। এর মধ্যে ছিল মাটির হাড়ি, কলসি, বাসন, সানকি, পাতিল, মিষ্টি-দইয়ের পাতিল, বাটি, মাটির ব্যাংক, ফুলদানি, ছাইদনি, কলমদানি, ধুপদানি ও পুতুলসহ নানা খেলনা সামগ্রী। বর্তমানে এসব সামগ্রীর প্রায় পুরোটাই দখল করে নিয়েছে এ্যালুমিনিয়াম ও প্লাস্টিকের তৈরি সামগ্রী।
তার পরেও মাটির তৈরি কিছু সামগ্রীর যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন নার্সারিতে ব্যবহৃত নানা সাইজ-ডিজাইনের ফুলের টব, দইয়ের বাটি-হাড়ি ও বিভিন্ন খেলনা দ্রব্যাদি। পাশাপাশি মাটি তথা পাটের তৈরি রিংয়ের বেশ চাহিদা রয়েছে। যা টয়লেট বা পানি ফেলানোর কুয়া তৈরিতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
এসব সামগ্রী তৈরির প্রক্রিয়া সম্পর্কে পলিন চন্দ্র পালের ছেলে খোকন চন্দ্র পাল বাংলানিউজকে জানান, প্রথমে পণ্য তৈরির উপযুক্ত মাটি সংগ্রহ করতে হয়। মাটি ভালভাবে ব্লেড দিয়ে কেটে পানি মিশিয়ে ছানার পর হাতের ছোঁয়ায় এসব পণ্য তৈরি করতে হয়। আকাশ মেঘলা না থাকলে তৈরি পণ্য শুকানোর জন্য দুদিনের রোদ যথেষ্ট। এরপর শুরু হয় রঙ করার পালা। শেষে টানা তিন ঘণ্টা আগুনে পুড়িয়ে সামগ্রীগুলো ব্যবহারের উপযুক্ত হয়।
তিনি বলেন, প্রতিটি ফুলের টব আকার ভেদে ৬ টাকা থেকে ৮০ টাকা দরে বিক্রি হয়ে থাকে। তবে নার্সারি মালিকদের কাছে হাজার প্রতি পাইকারি হিসেবে কিছু দাম কম রাখা হয়। এছাড়া দইয়ের খুঁটি (ছোট) প্রতি হাজার ১৬শ’ টাকা এবং দইয়ের প্রতিটি সরা (বড়খুঁটি) প্রতিটি ৮ টাকা দরে বিক্রি হয়ে থাকে। পাশাপাশি মাটির কুয়া তৈরিতে ব্যবহৃত প্রতিটি পাট-রিং বিক্রি হয় ৩০ টাকায়।
প্রতিবেশী মাধব চন্দ্র পাল বাংলানিউজকে জানান, মৃৎশিল্প আমাদের প্রাচীন পৈত্রিক পেশা। বর্তমানে এ পেশার দুর্দিনে আমরা কৌশলগত লড়াই করে এ শিল্পকে টিকিয়ে রেখেছি। সরকারীভাবে ঋণ সহায়তা পেলে এ পেশাকে আরও এগিয়ে নেওয়া সম্ভব।
এ ব্যাপারে পলাশবাড়ী উপজেলা নির্বাহী অফিসার কামরুজ্জামান নয়ন বাংলানিউজকে জানান, কুমারপল্লীর মৃৎশিল্পীরা চাইলে তাদের ঋণ প্রাপ্তিতে সহায়তা করা হবে। এছাড়া করোনাকালিন সময়ে তাদের সম্ভাব্য সবধরণের সাহায্য-সহযোগিতা করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১০৩৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৬, ২০২২
এনএইচআর