যশোর: যশোরের চৌগাছা উপজেলা শহরে ঘুরে ঘুরে পত্রিকার হকারি করতেন শফিকুল ইসলাম (৬৫)। দীর্ঘ দিন ধরে এ কর্মে যুক্ত থাকায় স্থানীয়রা তাকে শফি ভাই বলেই জানেন, এ নামেই ডাকেন।
করোনা তাঁকে স্তব্ধ করে দেয়। ২০২০ সালের শেষ দিকে করোনা হয়েছে কিনা বুঝতে না পারলেও ব্রেন স্ট্রোক করেন শফি। সহায় সম্বল বিক্রি করে চিকিৎসা করে পরিবার। বিছানাধারী হয়ে পড়েন শফি। সারাদিন শুয়ে থাকেন মাটি-চাঁটাই-টিনের ঝুপড়ি ঘরের বারান্দার একটি চৌকিতে। বাম হাত একেবারেই অকেজো। কোনোভাবেই নিজে চলাচল করতে পারেন না তিনি। কলেজে এইচএসসি পড়া ছেলেকে নামতে হয় দিনমজুরের কাজে। পত্রিকা বিক্রিও করোনায় একেবারেই কমে গেলে মজুরি ছাড়া আর উপায়ও ছিল না এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছেলেটির। ছেলের মজুরিতে স্ত্রীর সেবায় শফির চিকিৎসা চলছিল কোনোভাবে। তবে সেই স্ত্রীও শফিকে ছেড়ে যান ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট। একেবারেই অসহায় অবস্থা। সদ্য এইচএসসি পাস করা ছেলে আর চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া মেয়ে বাবাকে নিয়ে কী করবে? তবুও দমে না যেয়ে ছেলে দিনমজুরের কাজ করতে থাকেন পরের ক্ষেতে। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া ছোট বোনকে বাড়িতে রেখে ছেলেটি যায় পরের ক্ষেতে মজুরি দিতে। দিন শেষে সন্ধ্যায় এসে বাবাকে প্রস্রাব-মলত্যাগ করিয়ে খাইয়ে আবারও শুইয়ে দেন। তবে, ঘরে কিছু খাবার থাকলেও দিনে বাবাকে খাওয়াতে পারেন না, খাওয়ার পর বাথরুমে নেবে কে এই ভয়ে। শফির ছোট মেয়েটি গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যায়, মাঝেমধ্যে নিজে রান্না করে খায়। আর বারান্দায় শুয়ে থাকা বাবাকে চৌকি দেয়।
শফির খুব ইচ্ছা একটি হুইল চেয়ার হলে অন্তত বসে থাকতে পারতেন দিনে কিছু সময়। বা শেষ জীবনে একটু ঘুরে বেড়াতে পারতেন।
বিষয়টি স্থানীয়দের মাধ্যমে সংবাদ পান চৌগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইরুফা সুলতানা। তিনি রোববার (২১ মে) বিকেলে একটি হুইল চেয়ার নিয়ে পৌঁছান শফির বাড়িতে। হুইল চেয়ার খুলে বের করতেই শফি আনন্দে কেঁদে ফেলেন। কানে না শোনা শফি জোরে জোরে বলতে থাকেন এটা আমার জন্য! ইচ্ছা প্রকাশ করেন সেটিতে ওঠার জন্য।
ইউএনওর নির্দেশে তার আনছার আর গাড়িচালক সেলিম ও স্থানীয় এক ব্যক্তির সহায়তায় হুইল চেয়ারে ওঠানো হয়। শফি বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না এটি তার জন্য। কানের গোড়ায় যেয়ে জোরে ইউএনও এসেছেন এটি নিয়ে বলতেই শুনে হাত ওপরে তুলে এটেনশনের মতো করে সালাম দেন ইউএনওকে। শুরু হয়ে যায় শফির জোরে জোরে কান্না। আল্লাহর কাছে দোয়া করতে থাকেন ইউএনওর জন্য।
ইচ্ছা পোষণ করেন তাকে একটু উঠানে নামানোর জন্য। আনছার ও গাড়িচালক সেলিমের সহায়তায় নামানো হয় উঠানে। দেখিয়ে দেওয়া হয় নিজেই চালাতে পারবেন হুইল চেয়ার। শফি আবেগে জোরে জোরে কেঁদে ফেলেন। বলতে থাকেন আমি নিজেই ঘুরতে পারবো, নিজেই চালাতে পারবো।
বাংলাদেশ সময়: ২১৫৫ ঘণ্টা, মে ২৩, ২০২২
ইউজি/এএটি