সিরাজগঞ্জ: যমুনা নদী থেকে মাত্র কয়েক ফুট দূরে আছিয়া খাতুনের টিনের একখানা ছাপড়া ঘর। যার চাল ছেয়ে আছে মিস্টি কুমড়ার সবুজ পাতায়।
আছিয়ার ভূমিহীন স্বামী সাহেব আলী বেশ কয়েক বছর আগে গুচ্ছগ্রামে জমিসহ বাড়িটি পেয়েছিলেন। যার শেষ অংশ হিসেবে ওই ছাপড়াখানাই টিকে আছে। চলতি বছরে ভয়াবহ আগ্রাসনে শতাধিক বাড়িঘরের সঙ্গে সঙ্গে সাহেব আলীর বাড়িটাও গিলে নিয়েছে রাক্ষসী যমুনা।
বৃহস্পতিবার (২২ সেপ্টেম্বর) সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার জালালপুর ইউনিয়নে পাকুরতলা গুচ্ছগ্রাম এলাকায় গিয়ে কথা হয় আছিয়া খাতুনের সঙ্গে। নাতিকে কোলে নিয়ে ঘরের কোনায় দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি।
তিনি বলেন, তার তিন মেয়ে ও দুই ছেলের মধ্যে একজন অবিবাহিত। বড় ছেলে বিয়ে করে ভিন্ন সংসার পেতেছেন। মেয়েদেরও বিয়ে দিয়েছেন। ছোট ছেলে ও স্বামীকে নিয়ে তার বর্তমান সংসার। কৃষি দিনমজুর স্বামী সাহেব আলী দিনশেষে আয়ের টাকা দিয়ে বাজার করে আনলেই তার চুলো জ্বলবে।
আক্ষেপের স্বরে আছিয়া বলেন, আমার জামাই (স্বামী) ছোটকাল থাইহ্যাই ভূমিহীন। কুন বাড়িঘর আছিল না, সরকার গুচ্ছগিরাম দিয়া আমারে একটা আশ্রয় দিছিল, কিন্তু রাক্ষসী যমুনার সইলো না, ওই বাড়িডাও কাইর্যা নিলো। এ্যাহন ওই ঘর জাল্লাই আচে। প্রতি রাতই আতঙ্কে থাহি কহন জানি বাড়িডা ভাইঙা যায়।
একই এলাকার তাঁত শ্রমিক কামরুজ্জামানের স্ত্রী বিলকিছ খাতুন নদীর কিনারে একটি ঝুপড়ি ঘরের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন।
জানতে চাইলে তিনি বলেন, গুচ্ছগিরামে বাড়ি আছিল, এ্যাহন সিডা নদীর মইধ্যি চলি গেছে। কুনহানে জায়গা পাই নাই, এই জন্যি লাভলী আপার ইহেনে একখান ঝুপড়ি ঘর তুইল্যা ছওয়ালপাল নিয়্যা থাহি। ইডাও যে কহুন ভাইঙা যায়, তার ঠিক নাই। ইডা চইল্যা গেলে আর আমাগোরে থাহার কুন জায়গা নাই।
কিছুটা দূরে বেগুন গাছের চারা তুলছিলেন ফজর আলী বেপারী ও তার স্ত্রী। যেকোন সময় নদী ভাঙতে পারে এ আশঙ্কায় তারা আগেই ঘর সরিয়েছেন। এখন বেগুনের চারাগুলো নিয়ে হাটে বিক্রি করবেন বলে জানান ফজর আলী।
ফজর আলী আরও বলেন, এনায়েতপুরের আরকান্দি এলাকায় তাদের নিজস্ব বাড়ি ছিল। যমুনার ভাঙনে সেটা এখন সম্পূর্ণ বিলীন। এরপর গোপীনাথপুর বাঁধের ওপর আশ্রয় নিয়েছিলেন, সেই বাঁধটিও যমুনা গর্ভে চলে গেছে। পরে এই গুচ্ছগ্রামে আশ্রয় পান তিনি। গত এক মাসের ভাঙনে সেই আশ্রয়ও গিলে নিয়েছে যমুনা।
শঙ্কা নিয়ে দিন কাটছে ভাঙন কবলিত আব্দুস সাত্তার, ফুলেয়ারা খাতুন, লাভলী খাতুন, হাসনা বেওয়া, রওশন আরাসহ অনেকেরই।
হতদরিদ্র পরিবারের এসব মানুষের দাবি, ঘর-বাড়ি নয়, আগে যমুনার বাঁধ দিতে হবে। বাঁধ দেওয়ার কথা বলে এক বছর ধরে কোনো কাজ হয়নি বলে অভিযোগ তাদের। ফলে এ বছর অসংখ্য বাড়িঘর ও ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে।
সরেজমিনে জানা যায়, শাহজাদপুর উপজেলার জালালপুর ইউনিয়নের পাকুরতলা ও জালালপুর গুচ্ছগ্রাম এলাকার গত এক মাস ধরে ভাঙন শুরু হয়েছে। এর ফলে আবারও ভূমিহীন হয়ে পড়েছে গুচ্ছগ্রামের মানুষগুলো। কেউ অন্যের জমি ভাড়া নিয়ে, কেউ আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। যাদের সাধ্য নেই, তারা যমুনা পাড়েই কোনোমতে ঝুপড়ি তুলে বাস করছে।
এদিকে যমুনার ভাঙন থেকে রক্ষায় এনায়েতপুর থেকে সাড়ে ৬ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে। ৬শ কোটি টাকার এ প্রকল্পের কাজ শুরু করলেও ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের গাফিলতি ও ধীরগতির কারণে ভাঙন দেখা দিয়েছে।
জালালপুর ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য মহির উদ্দিন জানান, ৭/৮ বছর আগে পাকুরতলা ও জালালপুরে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ১২০টি ঘর নির্মাণ হয়েছিল। দুই একটি বাদে আশ্রয়ণ প্রকল্পের সবগুলো বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। ঘরগুলো যার যার তারা সরিয়ে নিয়ে গেছেন। ২০/২২ বছর আগে পাকুড়তলার দক্ষিণ দিকে গুচ্ছগ্রাম হয়েছিল। তারও অধিকাংশই এখন যমুনার পেটে চলে গেছে। এসব মানুষগুলো বর্তমানে অন্যের জমি ভাড়া নিয়ে ঘর তুলে বসবাস করছেন বলে জানান তিনি।
জালালপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সুলতান মাহমুদ জানান, দীর্ঘদিন ধরেই ভাঙন চলছে এই এলাকায়। এখানার মানুষগুলো একে একে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়ন করার দাবি জানান তিনি।
সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মিল্টন হোসেন জানান, যমুনার পানি বৃদ্ধির ফলে ওই অঞ্চলে ভাঙন শুরু হয়েছিল। বর্তমানে ভাঙন নেই। যমুনায় পানি বাড়ার কারণে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ করা যাচ্ছে না। পানি কমলেই কাজ শুরু হবে।
শাহজাদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ তরিকুল ইসলাম বলেন, ওই অঞ্চলে দুই দফায় আবাসন প্রকল্প ও গুচ্ছ গ্রামের ২৩৮টি ঘর নির্মাণ করা হয়। গত শুক্রবার (১৬ সেপ্টেম্বর) ঘটনাস্থলে গিয়েছিলাম। দীর্ঘদিন ধরে যমুনার ভাঙনে ৯০টি বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪০০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২২
আরএ