ঢাকা: বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মরণোত্তর বিচার করতে স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন ও তার কবর জাতীয় সংসদ এলাকা থেকে অপসারণ করার দাবি জানিয়েছে ‘মায়ের কান্না’ নামের একটি সংগঠন।  

১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর সেনা ও বিমান বাহিনীর কারাদণ্ডপ্রাপ্ত, চাকরিচ্যুত এবং ফাঁসির আদেশ পাওয়া সদস্যদের স্বজনরা এই সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছেন।

জিয়ার কবর অপসারণ করা না হলে, আগামী ১ ডিসেম্বরে ‘মায়ের কান্না’ সংগঠনের সদস্যরা কবর অপসারণের প্রাথমিক কাজ শুরু করবেন বলে জানিয়েছেন।

রোববার (০২ অক্টোবর) জাতীয় প্রেসক্লাবের আবদুস সালাম মিলনায়তনে ‘মায়ের কান্না’ সংগঠন আয়োজিত জিয়াউর রহমানের শাসনামলে নিহত সেনা ও বিমান বাহিনীর স্বজনরা এক সংবাদ সম্মেলনে এই দাবি তোলেন।

মায়ের কান্না সংগঠনের আহবায়ক কামরুজ্জামান মিয়া লেলিন বলেন, একটি চিঠি দিয়ে আমার মাকে জানানো হয়েছিল আপনার স্বামীকে মারা হয়েছে। শুধু চিঠি পেয়েছি কিন্তু লাশ পাইনি। রাতের আঁধারে আজিমপুর গোরস্থানে দাফন করা হয়। কিন্তু আজও আমরা আমাদের বাবাদের বিচার ও লাশ শনাক্ত করতে পারিনি। আমরা এর বিচার দাবি করছি।

কর্পোরাল মোবারক আলীর সন্তান মমতাজ বেগম বলেন, আমার ছয় মাস বয়সের সময় আমার বাবাকে হত্যা করে জিয়াউর রহমান। আমাদের পিতার মরদেহ কোথায় আমরা তা জানি না। কোন অপরাধে তাদের ফাঁসি দিলো খুনি জিয়া সেটাও জানি না। রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসেবে আমি আমার পিতার দাফনের স্থান কোথায় সেটা জানতে চাই? আমাদের মায়ের কান্না দেখেই বড় হয়েছি পিতৃহীন হয়ে, অনাদরে অবহেলায়। মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে আমাদের পিতাগণ দেশকে স্বাধীন করতে শুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। অথচ আমরা জানি না কোথায় তাদের কবর? কেন তাদের হত্যা করা হলো এই স্বাধীন বাংলাদেশে?

লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ফাঁসি হওয়া বিমান বাহিনীর সার্জেন্ট আবুল বাশার খানের মেয়ে বিলকিস বেগম।

তিনি বলেন, ১৯৭৭ এর সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে জাপান রেড আর্মির সদস্যরা জাপান এয়ারলাইন্সের একটি বিমান ছিনতাই করে। সেই বিমানটি জোরপূর্বক ঢাকা বিমান বন্দরে (পুরাতন তেজগাঁও বিমানবন্দরে) অবতরণ করায়। বিমান ছিনতাই এবং যাত্রী জিম্মির ঘটনায় ঢাকা সেনানিবাস এবং বিমানবন্দর এলাকায় ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। ১৯৭৭ সালের ১ অক্টোবর বিমান ছিনতাই ঘটনার অবসান ঘটে। কিন্তু সুযোগ বুঝে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে বিমান বাহিনীর সৈনিক ব্যারাকে বিদ্রোহের সূত্রপাত করান। কারণ তিনি বিমান বাহিনীকে সেনাবাহিনীর মধ্যে আত্মীকরণ করে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে চেয়েছিলেন।

সেই সিদ্ধান্তের সাথে একমত ছিলেন না বিমান বাহিনীর তৎকালীন সদস্যরা। জাপানি বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনার সুযোগে জিয়া কিছু সৈনিককে লেলিয়ে দিয়ে বিমান বাহিনীর ১১ জন অফিসারকে গুলি করে হত্যা করায়। এই ঘটনাকে পুঁজি করে বিদ্রোহ দমনের নামে নির্বিচারে বিমান বাহিনীর বেশিরভাগ মুক্তিযোদ্ধা সৈনিকদের গ্রেফতার করে গুম করতে শুরু করে।

তিনি আরো বলেন, ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর তথাকথিত বিদ্রোহ দমনের নামে মুক্তিযোদ্ধা সৈনিকদের আগে ফাঁসি কার্যকর করে পরে কোর্ট মার্শাল করে বিচার করা হয়েছে। ফাঁসি কার্যকর শুরু হয় ১৯৭৭ সালের ৯ অক্টোবর। অথচ বিদ্রোহ দমনের বিচার কাজের আইন পাস হয় ১৪ অক্টোবর। জিয়া ঘোষিত মার্শাল ল' ট্রাইবুনাল গুলোতে বিচার প্রহসনের সময় একজন সৈনিকেরা জীবন মরণের সিদ্ধান্ত নিতে গড়ে ১ মিনিটের চেয়েও কম সময় দিয়েছিলেন তৎকালিন ট্রাইব্যুনাল প্রধানেরা।

পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসি কার্যকর হওয়া ১২১ জনের তালিকা পাওয়া গেছে। কুমিল্লা কারাগারে ৭২ জনের নামের তালিকা পাওয়া গেছে। বগুড়া কারাগারে ১৬ জন, রংপুরে ৭ জনের নামের তালিকা পাওয়া গেছে। কিন্তু বিমান বাহিনী সদর দপ্তরের হিসেবে ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর পরবর্তী সময়ে ৫৬১ জন সৈনিক নিখোঁজ হয়েছেন। যাদের কখনই আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।

ঠিক একই সময়ে বগুড়া ক্যান্টনমেন্টে ২২ বেঙ্গল বিদ্রোহ করলে খুনি জিয়া পুরো ইউনিটের সদস্যদের গুম করে দেয়। যাদের সংখ্যা দুই শতাধিক। সেনাবাহিনীর গুম হওয়া সদস্যদের বেশিরভাগ বীর মুক্তিযোদ্ধা। যাদের ফাঁসিতে নয় ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যু নিশ্চিত করেছিলো খুনি জিয়া।

ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর সংগঠন ‘মায়ের কান্না’র পক্ষ থেকে সরকারের কাছে ৫ দফা দাবি পেশ করা হয়। দাবিগুলো হলো-

• ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর তথাকথিত সামরিক বিদ্রোহ দমনের নামে যাদের অন্যায়ভাবে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে তাদের কোথায় সমাহিত করা হয়েছে রাষ্ট্রীয়ভাবে সেই স্থান চিহ্নিত করে দিতে হবে।

• জিয়াউর রহমান কর্তৃক যে সকল বীর মুক্তিযোদ্ধা সেনা ও বিমান বাহিনীর সদস্যদের অন্যায়ভাবে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে তাদের নামের তালিকা প্রকাশ করা এবং শহীদ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করতে হবে।

• নিহত সদস্যদের স্ব-স্ব পদে সর্বোচ্চ র‍্যাংকে পদোন্নতি দেখিয়ে বর্তমান স্কেলে বেতন-ভাতা, পেনশনসহ পরিবারের সদস্যদের পুনর্বাসন ও সকল সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।

• জিয়াউর রহমানের মরণোত্তর বিচার করতে স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে।

• জিয়াউর রহমানের কবর জাতীয় সংসদ এলাকা থেকে অপসারণ করতে হবে। অন্যথায়, আগামী ১ ডিসেম্বর মায়ের কান্না সংগঠনের সদস্যরা কবর অপসারণের প্রাথমিক কাজ শুরু করবেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৯০৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ০২, ২০২২
এমকে