ঢাকা, মঙ্গলবার, ২০ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

নৌ-ট্র্যাজেডি

মৃত্যু নিয়ে ইতিহাসের সাক্ষী হলো আউলিয়া ঘাট!

সোহাগ হায়দার, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯২৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ২, ২০২২
মৃত্যু নিয়ে ইতিহাসের সাক্ষী হলো আউলিয়া ঘাট!

পঞ্চগড়: শুভ মহালয়ার ক্ষণ গণনা দিয়ে শুরু হয় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। কিন্তু এই উৎসবের শুরুতেই নৌ ট্র্যাজেডির মাধ্যমে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে অনন্য দুর্ঘটনার নজির স্থাপন করলো পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার মাড়েয়া বামনহাট আউলিয়া ঘাট।

 

এ ঘাটের করতোয়া নদীতে নৌকা ডুবির ঘটনায় একজন মুসলিমসহ ৬৯ জন সনাতন ধর্মীর মৃত্যু হয়েছে। নিখোঁজ রয়েছে শিশুসহ আরও ৩ জন। তবে সপ্তম দিনেও উদ্ধার অভিযান অব্যাহত রেখেছে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল।

এদিকে শনিবার (১ অক্টোবর) সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা শুরু হয়েছে। সন্ধার পর আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে শুরু হবে দুর্গাপূজা। তবে বৃহৎ এই উৎসব এলেও মাড়েয়া ইউনিয়নের করতোয়া পাড়ে নেই উৎসবের আমেজ। শোকের মাতম চলছে বাড়ি বাড়িতে। ফলে উৎসবের মণ্ডপ জনশূন্য হয়ে পড়েছে। এদিকে মণ্ডপে ঝুলানো হয়েছে শোকের ব্যানার।

জানা যায়, ষষ্ঠী পূজার মধ্য দিয়ে এ দুর্গোৎসব শুরু হয়। যা বুধবার (৫ অক্টোবর) বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে পাঁচদিনের এ মহোৎসব।

ঐতিহাসিক বদেশ্বরী মন্দির পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলার বড়শশী ইউনিয়নের অন্তর্গত একটি প্রাচীন মন্দির। প্রতিবছর মহালয়ার দিনে পূজা অনুষ্ঠিত হয় এই মন্দিরে। এই পূজা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে সারা দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা আসেন। আত্মীয় স্বজনের মঙ্গল কামনায় তারা করোতোয়া ও ঘোড়ামাড়া নদীর মিলন স্থানে স্নান করেন।  

রোববার (২৬ সেপ্টেম্বর) মহালয়ার দিনে ওই মন্দিরে হাজারো পূণ্যার্থী উপস্থিত হন। তাদের অধিকাংশই আউলিয়া ঘাট দিয়ে নৌকা যোগে মন্দিরে যান। ওই দিন করতোয়া নদীতে নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে। আর এসব মানুষদের উদ্ধারে এগিয়ে আসেন স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষজন। ঘটনার মুহূর্তে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে অনেককেই জীবিত উদ্ধার করেন তারা। এমনকি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গভীর নদীতে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দলের সাথে নদীতে ডুব দিয়ে উদ্ধার করেন ২৫টির অধিক মরদেহ। আর এর মাধ্যমে করতোয়া পাড়ে স্থাপিত হলো হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায় সম্প্রীতির এক অনন্য নজির।

শনিবার (১ অক্টোবর) সরেজমিন মন্দির ও ঘাট সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, শ্যালোচালিত একটি নৌকা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের নিয়ে করতোয়ার ৭০০ ফিট নদী অতিক্রম করে মন্দিরের দিকে রওয়ানা হয়। মাঝ নদীতে পৌঁছাতেই নৌকাটি দুলতে শুরু করে। পরে ইঞ্জিন বিকল হয়ে নৌকাটি কাঁত হয়ে ডুবে যায়। এ সময় নৌকাটির যাত্রীদের বাঁচাতে পাড়ে দাঁড়ানো মানুষরা নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়তে শুরু করেন। তাদের একান্ত প্রচেষ্টায় সে সময় নদী থেকে অনেককেই জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়।

নৌকা থেকে জীবিত ফিরে আসা বাদল রায় বাংলানিউজকে বলেন, আমরা ওপারে যাওয়ার জন্য নৌকায় উঠে। এসময় অনেক মানুষও নৌকায় উঠে। প্রথমে ঘাটের মানুষরা বাঁধা দিলেও কেও শুনেনি। পরে নৌকাটি নদীর মাঝ খানে গেলে তুলতে থাকে। একপর্যায়ে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে নৌকাটি ডুবে যায়। এসময় সবাই বাঁচার জন্য নদীতে ঝাঁপ দেয়। ঘটনার সময় আশপাশের লোকজন দ্রুত উদ্ধারে নদীতে নেমে আসে। এর মাঝে আমি সাঁতরে নদীর ওপরে উঠি। তবে এ ঘটনায় আমার ভাতিজা শোভন নদীতে ডুবে মারা গেছে।

স্থানীয়দের সহায়তার বেঁচে ফেরা সজীব রাজ বাংলানিউজকে বলেন, ভগবানের মন্দিরের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলাম। স্থানীয়রা না হলে বেঁচে ফিরতে পারতাম না। তবে এ ঘটনায় আমার ছেলেটাকে কেউ বাঁচাতে পারলো না।

চা শ্রমিক আইনুল হক বাংলানিউজকে বলেন, আমরা নদীর পাড়ে চা বাগানে কাজ করছিলাম প্রায় ২০ জনের মত। একসময় চিৎকার শুনতে পেয়ে আমরা সবাই নদীতে ঝাপিয়ে পড়ি। যে যতজনকে পেরেছি উদ্ধার করার চেষ্টা করেছি। একই সময় কয়েকজনের মরদেহ উদ্ধার করেছি।

নদী থেকে জীবিত উদ্ধার হওয়া সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বলেন, যখন নৌকা ডুবে গেলো আমরা তখন দিশা হারিয়ে ফেলি। মুসলিম ভাইয়েরা নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমাদের উদ্ধার কাজে নেমে পড়েন। তবে এবার পূজার সব আনন্দ সেই করতোয়ার জলে ভেসে গেছে। আমরা প্রতিদিনই মরদের আত্মার শান্তির জন্য প্রার্থনা করছি।

কথা হয় শ্রী শ্রী বদেশ্বরী শক্তিপীঠ মন্দিরের পুরোহিত বকুল চক্রবর্তীর সাথে। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, প্রতিবছর নানা আয়োজনে আমাদের এখানে মহালয়া দিয়ে শুরু হয় শারদীয় দুর্গোৎসব। আনন্দ উৎসব মুখর পরিবেশে এবার আউলিয়া ঘাট থেকে আসার পথে অনেকজনের প্রাণ চলে গেছে। আমরা তাদের আত্মার শান্তির জন্য পূজা করছি তিনবেলা। গত বছর যেমন মানুষের মাঝে আনন্দ ছিল, এবারে পূজাতে তা নেই।

মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবু আনসার মো. রেজাউল করিম বাংলানিউজকে বলেন, ঘটনার পর পরেই স্থানীয়দের সহায়তায় অনেককে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। তবে এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৬৯ জনের মৃত্যু হলেও ৩ জন নিখোঁজ।

পঞ্চগড়ের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ও পঞ্চগড়ের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট দীপঙ্কর রায় বাংলানিউজকে বলেন, দুর্ঘটনায় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন  আজ জমা দেওয়া হবে জেলা প্রশাসকের কাছে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত শিশুসহ তিনজন নিখোঁজ রয়েছে। তাদের মরদেহ উদ্ধারে অভিযান অব্যাহত থায়েছে। যেহেতু গত সাতদিন ধরে তিনজনের মরদেহ পাওয়া যাচ্ছে না, সে বিষয়ে এখনো কিছু না বলা গেলেও উদ্ধার টিমসহ ফায়ার সার্ভিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করে পরে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে এখন পর্যন্ত আমাদের উদ্ধার কার্যক্রম চলছে।

এর আগে, গত রোববার (২৫ সেপ্টেম্বর) পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের আউলিয়া ঘাট এলাকার করতোয়া নদীতে শতাধিক যাত্রীসহ নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে। এখন পর্যন্ত ৬৯ জনের মরদেহ উদ্ধার হয়েছে। এরমধ্যে ৬৮ জনই সনাতন ধর্মের। কেবলমাত্র মাঝি হাশেম আলীই ছিলেন ইসলাম ধর্মাবলম্বী। এছাড়া শিশুসহ আরও তিনজন সনাতনী নিঁখোজ রয়েছেন।

নিখোঁজ তিনজন হলেন- দেবীগঞ্জ উপজেলার শালডাঙ্গা ইউনিয়নের ছত্রশিকারপুর হাতিডুবা গ্রামের মদন চন্দ্রের ছেলে ভুপেন ওরফে পানিয়া (৪০), বোদা উপজেলার সাকোয়া ইউনিয়নের ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের সরেন্দ্রনাথ (৬৫) এবং পঞ্চগড় সদর উপজেলার ঘাটিয়ারপাড়া গ্রামের ধীরেন্দ্রনাথের মেয়ে জয়া রানি (৪)।

বাংলাদেশ সময়: ১৯২৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ০২, ২০২২
এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।