পাবনা (ঈশ্বরদী): ১০৭ বছর আগের সেই ব্রিটিশ আমলের কথা। ইটের মাঝে চুন-সুড়কি, ভাতের মাড় দিয়ে গাঁথুনি, ৪শ ফুট লম্বা ১৫টি পিয়ারের গার্ডার রেলব্রিজটি নির্মাণ করা হয়েছিল।
বর্তমানে ওই গার্ডার রেলব্রিজে ট্রেনগুলো ওঠার আগে শূন্য কিলোমিটারে থামানো হয়। অতঃপর উত্তর-দক্ষিণাঞ্চলের ১৯ জোড়া ট্রেন এসে থেমে যায়। নিরাপদেই অব্যাহত রয়েছে ট্রেন চলাচল। তবে গার্ডার ব্রিজটি ঝুঁকিপূর্ণ না হলেও পুরোনো হয়ে গেছে, সেকারণে সংস্কার করতে হবে। বন্যার পানি কমে গেলে চলমান কাজ শুরু হবে।
শত বছর অতিবাহিত হওয়ায় গার্ডার ব্রিজে গাঁথুনির চুন-সুড়কির যে গুণাগুণ ছিল তা নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে লোহার গার্ডারের নিচে ঢালাই করা বেডব্লকে ফাটল, পিয়ার নড়বরে হওয়াতে ট্রেন চললে ব্রিজটি কাঁপতে থাকে। অচিরেই সংস্কার কাজটি শুরু হওয়া দরকার বলে মনে করেন সচেতন মহল।
এদিকে ভ্রমণপ্রিয় ট্রেনযাত্রী যেন আতঙ্কিত না হয়, যার কারণে ট্রেন চালক ওপিটিতে স্বাক্ষরের পর ৮৫ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন না চালিয়ে ১০ কিলোমিটার গতিতে গার্ডার ব্রিজ অতিক্রম করে।
শুক্রবার (৩০ সেপ্টেম্বর) সকালে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ের আওতায় পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার দিলপাশার ইউনিয়নের ঈশ্বরদী-ঢাকা রেলপথের বড়ালব্রিজ-দিলপাশার স্টেশনের ২৫ নাম্বার বাউজান ব্রিজে সরেজমিন গিয়ে এ চিত্র দেখা যায়।
ঝুঁকিপূর্ণ অস্বীকার করে পাকশী প্রকৌশলী বিভাগের দাবি, ব্রিজটি পুরোনা তাই সংস্কার করা হবে, সংস্কারের আগে ব্রিজটি ডেডস্টপ ঘোষণা করা হয়েছে। টেন্ডারও হয়ে গেছে। তাই ট্রেনগুলো ধীর গতিতে পারাপার করা হয়।
শুক্রবার (৩০ সেপ্টেম্বর) সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, ঈশ্বরদী-ঢাকা রুটে গার্ডার ব্রিজের ১৪টি পিয়ারের মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দুটি পিয়ারের সংস্কার কাজ হয়েছে। বাকি ১২টা পিয়ারের কাজ বাদ রয়েছে। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি দেড় বছরের মধ্যে সংস্কারের কাজ শেষ করার কথা। ব্রিজের দুইপাশে ট্রেন থামানোর জন্য দিন রাত্রিতে ছয়জন শ্রমিক নিয়োগ করা রয়েছে।
ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের নিয়োগকৃত পোর্টারের দায়িত্বে থাকা জহুরুল ইসলাম সরকার জানান, বর্ষার আগে কাজ শুরু হয়েছিল। ওই সপ্তাহেই কাজ বন্ধ হয়ে যায়। কারণ ব্রিজের নিচে বন্যার পানি জমে যায়। ট্রেন থামানোর জন্য ছয়জন রয়েছে। রাতে চারজন দিনে দুইজন দায়িত্ব পালন করছেন। ট্রেন পার করতে পাঁচ মিনিট সময় লাগে। ট্রেনের চালক ওপিটিতে স্বাক্ষর করে অর্ধেকটা নিজের কাছে রাখেন অর্ধেকটা আমাদের দিয়ে যায়।
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী শিপন আলী বাংলানিউজকে জানান, ব্রিটিশ আমলে প্রকৌশলীরা ইট, বালু, সিমেন্টের বদলে চুন-ইটের সুড়কি, ভাতের মাড় দিয়ে নির্মিত করেছিল ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ রেলরুটে কয়েকটি গার্ডার ব্রিজ। একশ বছর অতিবাহিত হওয়ায় চুন-সুড়কির গুণ নষ্ট হয়ে গেছে।
এছাড়া ব্রিজে সংস্কার কাজ শুরুর কয়েকদিনের মাথায় বন্যার পানিতে ব্রিজের গোড়া তলিয়ে যাওয়াতে সংস্কার কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ব্রিজের ওপর দিয়ে চলাচলকারী আন্তঃদেশীয় দুইজোড়া মৈত্রী এক্সপ্রেস এবং ১৮ জোড়া আন্তঃনগর, মেইল ও লোকাল এবং ট্রেন ঝুঁকি নিয়ে ৮৫ কিলোমিটার গতিতে চলাচল না করে ১০ কিলোমিটার গতিতে অতিক্রম করছে।
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ের প্রকৌশলী-২ বীরবল মণ্ডল বাংলানিউজকে জানান, প্রায় চার কোটি টাকা ব্যয়ে টেন্ডারের মাধ্যমে ঈশ্বরদী-ঢাকা রেলপথের বড়ালব্রিজ-দিলপাশার স্টেশনের মাধামাঝি ২৪ নাম্বার বাউজান ব্রিজে দেড় বছর মেয়াদে কাজটি শুরু হয়। কাজটি শুরু হওয়ার কয়েকদিনের মাথায় বন্যার পানিতে তলিয়ে যায় ব্রিজ এলাকা। এতে বন্ধ হয়ে যায় শতবর্ষের রেলওয়ের গার্ডার ব্রিজের সংস্কার কাজ।
পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে প্রকৌশলী বীরবল মণ্ডল আরও বলেন, বাউজান গার্ডার ব্রিজটিতে যেটুকু ঝুঁকিপূর্ণ ছিল, সেটা সংস্কার করা হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ পুরোনো রেলওয়ে ব্রিজ দিয়ে ২৫ টনের এক্সেল লোড নেওয়ার কার্যক্ষমতা নেই যে সব ব্রিজের। সেগুলো ঝুঁকিপূর্ণ। আর শতবর্ষের যে সব পুরোনা রেল ব্রিজগুলো রয়েছে, রেল মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ধীরে ধীরে সেগুলো সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে পাকশী রেলওয়ে প্রকৌশলী বিভাগ। যে ব্রিজটি আমরা সংস্কার দরকার জরুরি মনে করছি সেগুলো কাজ আগে করছি।
তিনি আরও বলেন, মানুষ এখন ট্রেনমুখী। আর কেউ সড়কপথে দরকার ছাড়া চড়তেই চায় না। যদি ব্রিজটি ঝুঁকিপূর্ণ হতো, ট্রেন চলাচলে বিঘ্ন ঘটতো! এই রেলরুটে কেউ ট্রেনে যাতায়াতই করতো না। বিষয়টি এরকম। টেন্ডারের মেয়াদ এখনো রয়েছে, তবে আগামী এক মাসের মধ্যে সংস্কার কাজ শুরুর সম্ভাবনা রয়েছে।
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান প্রকৌশলী আসাদুল হক বাংলানিউজকে জানান, বর্তমান সরকারের দৃশ্যমান উন্নয়নে রেলওয়েতে অনেক বেশি বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। নতুন নতুন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। পাকশী রেলওয়ে বিভাগে ব্রিটিশ আমলের পুরাতন যে ঝুঁকিপূর্ণ রেলব্রিজ রয়েছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে রেলপথ মন্ত্রণালয় নির্দেশনা দিয়েছেন, নিরাপদে ট্রেন চলাচলের জন্য সব পুরোনো রেলব্রিজ সংস্কার করতে হবে। আমরা ধীরে ধীরে সব ব্রিজগুলো পরিদর্শন করে কিছু রেলব্রিজকে চিহ্নিত করেছি। ঝুঁকিপূর্ণ কয়েকটি রেল ব্রিজের কাজ শেষ হয়েছে ইতোমধ্যে। আর চলতি বছরে কয়েকটি রেলব্রিজের সংস্কারের কাজ শুরু হবে। পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়েতে কোনো ঝুঁকিপূর্ণ রেলব্রিজ থাকবে না বলে জানিয়েছেন ওই রেলওয়ের প্রধান প্রকৌশলী।
জানা যায়, ঈশ্বরদীর পাকশী পদ্মা নদীর ওপরে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নির্মিত হওয়ার পরপর ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ রেলরুটে ১৯১৫-১৬ সালে (সারাঘাট) ঈশ্বরদী রেলওয়ে জংশন থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত ট্রেন চলাচল করতো। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতার আসার পর ১৯৯৮ সালে যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু সেতুর ওপর দিয়ে ট্রেন চলাচল শুরু হয়। ঢাকার সঙ্গে উত্তর-দক্ষিণাঞ্চলের রেল যোগাযোগ চালু হয়। পরে ব্রডগেজ-মিটারগেজ রেললাইন নির্মিত হয়। পরে ধীরে ধীরে ট্রেন চলাচল শুরু হয়। বর্তমানে কলকাতাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় এই রুট দিয়ে ২২ জোড়া ট্রেন প্রতিদিন চলাচল করে।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৫৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৩, ২০২২
আরএ