ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৯ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

যে কারণে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ চর আবদুল্লাহ ছাড়ছেন বাসিন্দারা

মো. নিজাম উদ্দিন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৫৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ৪, ২০২২
যে কারণে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ চর আবদুল্লাহ ছাড়ছেন বাসিন্দারা

লক্ষ্মীপুর: মেঘনা নদীর বুকে জেগে ওঠা একটি দ্বীপ, যা চর আবদুল্লাহ নামে পরিচিত। এটি লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি উপজেলার আটটি ইউনিয়নের মধ্যে একটি ইউনিয়ন।

 

উপজেলার মূল ভূখণ্ড থেকে এ দ্বীপের দূরত্ব প্রায় ২৫ কিলোমিটারের বেশি।
 
আলেকজান্ডার মাছঘাট থেকে ট্রলারের মাধ্যমে এ দ্বীপে যাতায়াত করেন বাসিন্দারা। নানা প্রতিকূল পরিবেশ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এ দ্বীপের বাসিন্দাদের জীবনযাপন অনেকটা অনিরাপদ হয়ে উঠেছে।

যে চরে এখনো আধুনিকতার কোনো ছোঁয়া লাগেনি। বাসিন্দারা বঞ্চিত নানামুখী নাগরিক সুবিধা থেকে। অনিরাপদ ভবিষ্যৎ নিয়ে বেড়ে ওঠে চরের শিশুরা।  

মাঝ নদীতে জেগে ওঠা এ চরটিকে এখন আবার গ্রাস করে ফেলছে মেঘনা। প্রায় ২২ বর্গ কিলোমিটারে চর ভাঙতে ভাঙতে অর্ধেকের চেয়েও কমে এসেছে।  

নদী ভাঙা, অনিরাপদ বাসস্থান, অনিরাপদ জীবন, নিরাপদ খাদ্যাভাব, অনুন্নত পরিবেশ এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, লবণ পানির আধিক্য, কৃষি বিপর্যয়, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার অভাবসহ নানা প্রতিকূলতার কারণে দ্বীপ ছাড়তে শুরু করেছে এখানকার বাসিন্দারা।  

চরে বসতি শুরু হয় ১৯৮২ সালের পর থেকে। পরিত্যক্ত এ চরটিতে শুধুমাত্র কেওড়া গাছ ছিল। বসতি স্থাপনের লক্ষ্যে কেওড়া গাছের এ চরটিকে কৃষি জমিতে রূপান্তর করা হয়, আর চরে বিক্ষিপ্তভাবে গড়ে ওঠে কুড়ে ঘর। রামগতি এবং হাতিয়া অঞ্চলের নদী ভাঙনের শিকার ভূমিহীনরা এখানে বসতি গড়ে তোলে।

আস্তে আস্তে বাড়তে শুরু করে বাসিন্দাদের সংখ্যা। সরকারি খাস এ চরটিতে গড়ে ওঠে হাটবাজার, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, মাছঘাট। বসতি শুরুর দীর্ঘ ৪০ বছর পরও চরের বাসিন্দাদের ভাগ্য পরিবর্তন হয়নি। অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনো অনুন্নত রয়ে গেছে। কাঁদাযুক্ত গ্রামীণ রাস্তা দিয়ে মাইলের পর মাইল হাঁটতে হয় বাসিন্দাদের।

চরের ভেতর দিয়ে মেঘনা নদী থেকে দু’টি সংযোগ খাল বয়ে গেছে। একটি কাইছার খাল, আরেকটি চেয়ারম্যান খাল। খালের কয়েকটি স্থানে সড়ক যোগাযোগের জন্য কাঠের পুল তৈরি হলেও কিছু কিছু স্থানে যেতে হয় খাল সাঁতরে।  

বঙ্গোপসাগর খুব কাছে হওয়ায় প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়তে হয় লোকজনকে। জোয়ারের পানি চরের বাসিন্দাদের নিত্য সঙ্গী। এতো বছরেও দ্বীপে তৈরি হয়নি কোনো সাইক্লোন শেল্টার। গবাদি পশু রাখার জন্য স্থানীয়দের কয়েকটি উঁচু কেল্লা তৈরি হলেও সেগুলো নদীতে বিলীন হয়ে গেছে।  

বসতি শুরুর পর থেকে থেকে মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রায় ৫০ হাজার লোকের বসবাস থাকলেও নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে এখন লোকসংখ্যা নেমে এসেছে হাজার পাঁচেকের মধ্যে। বর্তমানে এ ইউনিয়নের ভোটার সংখ্যা প্রায় নয় হাজার হলেও তাদের বেশিরভাগ মূল ভূখণ্ডে চলে গেছে। চরের জনসংখ্যা এখন হাজার পাঁচেকের মধ্যে। চরের প্রায় ৯০ শতাংশ বাসিন্দা জেলে এবং কৃষি পেশায় জড়িত।

এ চরটি ঘুরে ও বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে। চরের মানুষের জীবনচিত্র এবং চরের ভূখণ্ড নিয়ে কথা হয় অনেকের সঙ্গে।  

তারা জানান, চর আবদুল্লাহ ইউনিয়নের নয়টি ওয়ার্ডের মধ্যে মাত্র একটি ওর্য়াড ছিল মূল ভুখণ্ডের সঙ্গে। তবে সেটি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। বাকি আটটি ওয়ার্ড রয়েছে মেঘনা নদীর মাঝখানে। চরে গ্রামের সংখ্যা ছিল পাঁচটি, আর হাটবাজার ছিল তিনটি। গ্রামগুলো হলো- মধ্য চর আবদুল্লাহ, চর সেবাজ, চর গজারিয়া, তেলির চর ও সোনার চর। আর বাজারগুলো হলো- জনতা বাজার, চেয়ারম্যান বাজার ও কামাল বাজার।  

ভাঙতে ভাঙতে গ্রামের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে দু’টিতে, আর বাজারের সংখ্যাও দুটি। চর সেবাজ, চর গজারিয়া ও সোনার চরের অস্তিত্ব নেই, সাথে কামাল বাজারও নদী গর্ভে চলে গেছে। ভাঙনের হুমকিতে আছে চেয়ারম্যান বাজার।  

চর আবদুল্লাহ আশেপাশে আরও কয়েকটি চর জেগে উঠেছে, এর মধ্যে একটি ভোলা জেলার অধীনে, অন্য আরেকটি চরের সীমানা নিয়ে বিরোধ রয়েছে নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার সঙ্গে।  

চর আবদুল্লাহ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি ) সাবেক চেয়ারম্যান বেলাল হোসেন জানান, চরের পশ্চিমে ভোলা জেলার তজিমুদ্দিন উপজেলার আওতাধীন চর জহুরুদ্দি ও চর মোজাম্মেল, উত্তরে মেঘনা নদী পেরিয়ে রামগতির আলেকজান্ডার, পূর্বেও মেঘনা নদী এবং চরগাজী ইউনিয়নের বয়ারচর আর দক্ষিণে মৌলভীর চর বা চর ঘাইসা- যা রামগতি এবং হাতিয়ার সীমানা নিয়ে জটিলতার মধ্যে রয়েছে। আর চরের প্রায় ১০০ কিলোমিটার দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। চরের ঠিক কাছাকাছি উত্তর পাশের মেঘনা নদী দিয়ে চলাচল করে পণ্যবাহী অসংখ্য জাহাজ। যেগুলো চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা এবং খুলনার দিকে যাতায়াত করে।  

চরের উত্তর-দক্ষিণের দৈর্ঘ্য প্রায় সাত কিলোমিটার, পূর্ব অংশে দেড় কিলোমিটার এবং পূর্ব থেকে পশ্চিম অংশে প্রায় ১০ কিলোমিটার। চরে প্রায় নয়শ’ পরিবারের বসবাস।  

সাবেক এ ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, চরের উত্তর অংশ ভাঙতে ভাঙতে চরের পরিধি ছোট হয়ে আসছে। নদী ভাঙনে চরের বিস্তীর্ণ কৃষি জমি, বসতি, একটি বিদ্যালয় ভবন, একটি বাজার, একটি কমিউনিটি ক্লিনিক বিলীন হয়ে গেছে। ফলে দিন দিন চরের জনসংখ্যা কমে যাচ্ছে। ১৫ বছর আগেও চরে ৪০ হাজারের বেশি মানুষের বসবাস ছিল।  

চরের বাসিন্দা আবদুল মালেক, মো. ইসমাইল হোসেন, শেখ ফরিদ, মো. সাদ্দাম হোসেন বলেন, প্রতিকূল পরিবেশ এবং নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে এ চরে মানুষ বসবাস করছে না। অনেকে চর ছেড়ে মূল ভূখণ্ড রামগতির বিভিন্ন স্থানে বসতি তৈরি করেছেন। কেউ কেউ মাঝে মধ্যে এ চরে আসেন। এক-দুইদিনের জন্য থাকেন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অনেকেই রামগতির আলেকজান্ডার এলাকায় থাকেন। তারাও মাঝে মধ্যে এসে চরের খোঁজ-খবর নেন। শুধুমাত্র যাদের কোথাও যাবার জায়গা নেই, তারাই এ চরে বসবাস করেন।  

চরের গবাদি পশু চিকিৎসক মো. বেলাল হোসেন বলেন, আমি আগে এ চরে বসবাস করতাম। বর্তমানে আলেকজান্ডার এলাকায় বসবাস করি। তবে সপ্তাহে একদিন এসে এ চরের গবাদি পশুর চিকিৎসা করি।  

মো. ফারুক হোসেন নামে একজন বলেন, রামগতির মধ্যে সবচেয়ে অসহায় এ চরের বাসিন্দারা। আমাদের পরিবারের বসবাস চর আব্দুল্লাহে ছিল, পরে তেলিরচর বসবাস করি। একপর্যায়ে নদী ভাঙনে অতিষ্ঠ হয়ে বয়ারচরে চলে আসি।  

তিনি বলেন, চর আব্দুল্লাহ ইউনিয়ন অনেক বড় ছিল, নদী ভাঙনে সব শেষ হয়ে গেছে। বাপ-দাদার জমিজমা সব নিয়ে গেছে এ মেঘনা নদী।  

মো. জামাল মাঝি নামে একজন বলেন, প্রায় ২০ বছর আগে চর ছেড়ে চলে গেছি। তবে চরে আত্মীয় স্বজন বসবাস করে। তাই মাঝে মধ্যে চরে আসতে হয়। চরে এখন থাকার পরিবেশ নেই।  

মো. সুমন হোসেন বলেন, সমতলের মানুষ যেখানে ৫০ বছর এগিয়ে আছে, সেখানে এ চরের মানুষ ৫০ বছর পিছিয়ে আছে। প্রতিটি দিক দিয়ে এখানে অনুন্নত এবং অনিরাপদ জীবন ব্যবস্থা।  

স্থানীয় বাসিন্দা আলাউদ্দিন হোসেন বলেন, চরের দিকে কারো নজরদারি নেই। আমরা এখানে কীভাবে বসবাস করি, তার খবর কেউ রাখে না। বসতি স্থাপনের শুরুতেই এ চরে বসবাস শুরু করি। চরে শিক্ষকতা পেশায় ছিলাম। এ চরের মায়া ছাড়তে পারি না, তাই চর ছেড়ে যেতেও পারি না।  

চরের বিভিন্ন বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান কামাল হোসেন মঞ্জুর বলেন, গত তিন বছর ধরে চরের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে বিভিন্ন দপ্তরে কথা বলে আসছি৷ কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। তাই এখন এগুলো নিয়ে কথা বলা বন্ধ রেখেছি।  

রামগতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এসএম শান্তুনু চৌধুরী বলেন, দুর্গম চর, তাই বাসিন্দারা নানা সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। চরের শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ বিভিন্ন বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানাবো।  

বাংলাদেশ সময়: ১৪২৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩, ২০২২
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।