নড়াইল থেকে: দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের সঙ্গে রাজধানী শহর ঢাকার যাতায়াতের দীর্ঘদিনের সমস্যা দূর হচ্ছে। রাত পেরোলেই নড়াইলের লোহাগড়ার কালনা পয়েন্টে নির্মিত দেশের প্রথম ছয় লেনের দৃষ্টিনন্দন ‘মধুমতি সেতু’ উদ্বোধন হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোমবার (১০ অক্টোবর) বেলা ১২টায় গণভবন থেকে ভার্চ্যুয়ালি সেতু উদ্বোধন করবেন। এর মাধ্যমে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্তত ১০ জেলার মানুষের দীর্ঘদিনের দুর্ভোগ লাঘব হবে।
এ সেতুর পূর্ব পাড়ে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলা এবং পশ্চিম পাড়ে নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলা।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০০৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর নড়াইলের নির্বাচনি জনসভায় এ সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি মাসে সেতুর কাজের ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করেছিলেন।
গত ২৫ জুন পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর যশোর ও নড়াইলসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের কাছে কালনা ঘাটে সেতুর প্রয়োজনীয়তা বহু গুণ বেড়ে যায়। পদ্মা সেতু পার হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের প্রবেশদ্বার কালনা ঘাট।
সেই অপেক্ষা পূরণের জন্যে অপেক্ষা এখন কেবলমাত্র এক রাতের।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্ক ইম্প্রুভমেন্ট প্রজেক্টের আওতায় জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) অর্থায়নে এ সেতু নির্মাণ হয়েছে।
নড়াইলের জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান বলেন, প্রধানমন্ত্রী ২০০৮ সালে নড়াইলের সুলতান মঞ্চে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, কালনা পয়েন্টে একটি সেতু হবে। প্রধানমন্ত্রীর সেই প্রতিশ্রুতি আগামীকাল পূরণ হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, সবমিলিয়ে দূরত্ব কমে আসবে ১১৫ কিলোমিটার ঢাকা থেকে নড়াইল। অন্যান্য জেলার ক্ষেত্রে ৯০ থেকে ৯৮ কিলোমিটার দূরত্ব কমে আসবে। আর্থ-সামাজিক, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভূত ক্ষেত্রে উন্নতি সাধিত হবে। এ এলাকার সকল স্টেকহোল্ডার, নদীর দুই পাড়ের অগণিত ছাত্র শিক্ষক, যারা ছোট খাটো ব্যবসায়ী, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, তারা কালকের দিনের জন্যে অপেক্ষা করছে মধুমতী সেতু দিয়ে তাদের জীবনমান পরিবর্তন হবে।
ঢাকার সাথে সারাদেশের কমিউনিকেশন নেটওয়ার্কের ক্ষেত্রে নড়াইল হাব হিসেবে পরিচিতি পেতে যাচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন জেলা প্রশাসক।
ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্ক ইম্প্রুভমেন্ট প্রজেক্টের প্রকল্প পরিচালক শ্যামল ভট্টাচার্য বলেন, ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্ক ১৭ টি সেতু নেওয়া হয়েছিল। এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল যে, এশিয়ান হাইওয়ে প্রকল্পের আওতায় এ সেতুই প্রথম উদ্বোধন করছি। এ সেতু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। স্বপ্নের পদ্মা সেতুর সুফল ইতিমধ্যেই পেয়েছি কিন্তু সেই সুফল পুরোপুরি পেতে নড়াইল, যশোর ও এই অঞ্চলের যেসব স্থলবন্দর রয়েছে বা অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে পুরোপুরি নেওয়ার জন্য এই মধুমতী সেতুর কানেকশন জরুরী ছিল। কাল সেই স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে।
পিডি বলেন, এই অঞ্চলের যে সাব-রিজিনিওয়াল কানেক্টিভিটি মায়ানমার ও ভারতের সঙ্গে এই সেতুর মাধ্যমে তৈরি হবে। এই প্রকল্পের অধীনে শুধুমাত্র সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে, রাস্তাগুলো অন্য প্রকল্পের মাধ্যমে নির্মাণ করা হবে। এটা একটা সাপ্লিমেন্টারী প্রজেক্ট। অন্যান্য যে প্রজেক্ট তৈরি হবে এটার কমপ্লিমেন্টারী প্রজেক্ট।
ভাঙ্গা থেকে বেনাপোল পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প ইতিমধ্যে সরকার সাবমিট করেছে। সেটা হলে এ অংশের পুরোপুরি সুফলটা পাওয়া যাবে বলে মন্তব্য করেন প্রকল্প পরিচালক।
যশোর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সাবেক সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলন বলেন, সেতুটি এ অঞ্চলের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করবে এবং সড়ক যোগাযোগ ব্যাপকভাবে সহজ করবে।
এ ব্যবসায়ী নেতা বলেন, একইভাবে ঢাকার সঙ্গে শিল্প ও বাণিজ্যিক শহর নওয়াপাড়া ও মোংলা বন্দর ও সাতক্ষীরার দূরত্বও কমে যাবে। এশিয়ান হাইওয়েতে থাকা এই সেতুটি সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে সিলেটের তামাবিল হয়ে ঢাকা, বেনাপোল, কলকাতা পর্যন্ত সরাসরি ভূমিকাও রাখবে।
প্রকল্পের সূত্রমতে, সেতুর মাঝখানে বসানো হয়েছে ১৫০ মিটার দীর্ঘ স্টিলের স্প্যান। নেলসন লোস আর্চ টাইপের (ধনুকের মতো বাঁকা) এ স্প্যানটি তৈরি হয়েছে ভিয়েতনামে। ঐ স্প্যানের উভয় পাশের অন্য স্প্যানগুলো পিসি গার্ডারের (কংক্রিট)। ছয় লেনের এ সেতু হবে এশিয়ান হাইওয়ের অংশ। চারটি মূল লেনে দ্রুতগতির ও দুটি লেনে কম গতির যানবাহন চলাচল করবে। সেতুর দৈর্ঘ্য ৬৯০ মিটার ও প্রস্থ ২৭ দশমিক ১০ মিটার। উভয় পাশে সংযোগ সড়ক ৪ দশমিক ২৭৩ কিলোমিটার, যার প্রস্থ ৩০ দশমিক ৫০ মিটার। সেতু নির্মাণে মোট ব্যয় হবে ৯৫৯ দশমিক ৮৫ কোটি টাকা।
সেতুটি এশিয়ান হাইওয়ের একটি অংশ যা রাজধানীকে দেশের বৃহত্তম বেনাপোল স্থলবন্দরসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে সংযুক্ত করবে। ২৭ দশমিক ১ মিটার চওড়া সেতুটিতে চারটি উচ্চ গতির লেন ৪ দশমিক৩০ কিলোমিটার অ্যাপ্রোচ রোড এবং দুটি সার্ভিস লেনসহ ছয়টি লেন রয়েছে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা আরো জানিয়েছেন, পদ্মা সেতু চার লেনের হলেও দেশের প্রথম ছয় লেনের সেতু মধুমতী। পদ্মা সেতুর পাইলক্যাপ পানির ওপর পর্যন্ত। কিন্তু এ সেতুর পাইলক্যাপ পানির নিচে মাটির ভেতরে। তাই নৌযান চলাচল সমস্যা হবে না, পলি জমবে না এবং নদীর স্রোতও কম বাধাগ্রস্ত হবে।
মধুমতি সেতুর টোল নির্ধারণ
মধুমতী সেতু পারাপারের জন্য বড় ট্রেইলার ৫৬৫ টাকা, তিন বা ততোধিক এক্সসেল বিশিষ্ট ট্রাক ৪৫০ টাকা, দুই এক্সসেল বিশিষ্ট মাঝারি ট্রাক ২২৫, ছোট ট্রাক ১৭০ টাকা, কৃষিকাজে ব্যবহৃত পাওয়ার ট্রিলার ও ট্রাক্টর ১৩৫ টাকা, বড় বাসের ক্ষেত্রে ২০৫ টাকা, মিনিবাস বা কোস্টার ১১৫ টাকা, মাইক্রোবাস, পিকআপ, কনভারশনকৃত জিপ ও রে-কার ৯০ টাকা, প্রাইভেট কার ৫৫ টাকা, অটোটেম্পো, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, অটোভ্যান ও ব্যাটারিচালিত তিন চাকার যান ২৫ টাকা, মোটরসাইকেল ১০ টাকা এবং রিকশা, ভ্যান ও বাইসাইকেলের ক্ষেত্রে পাঁচ টাকা টোল নির্ধারণ করা হয়েছে।
সেতু পরিদর্শনকালে আরও উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেস সচিব হাসান জাহিদ তুষার, সহকারী প্রেস সচিব এম এম ইমরুল কায়েস।
বাংলাদেশ সময়: ২৩০৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৯, ২০২২
এনবি/এনএইচআর