ঢাকা: কবিরাজি পেশার আড়ালে দীর্ঘদিন ধরে প্রতারণা করছিলেন হেমায়েত ওরফে জাহিদ কবিরাজ। প্রতারণার তদন্তে নেমে রোগী সেজে হেমায়েত কবিরাজের দরবারে যায় র্যাব।
প্রতারণার অভিযোগে হেমায়েতকে আটকের পর জানতে পারে তিনি বাগেরহাটের নারী উদ্যোক্তা মনোয়ারা মনু হত্যা মামলার পলাতক আসামি। যিনি ১৭ বছর ধরে কবিরাজের ছদ্মবেশে ভারত ও দেশের বিভিন্ন এলাকায় পলাতক ছিলেন।
বুধবার (২৬ অক্টোবর) দিবাগত রাতে রাজধানীর বছিলা এলাকা থেকে হেমায়েত খান ওরফে জাহিদ কবিরাজকে (৫২) গ্রেফতারের পর এসব কথা জানায় র্যাব।
এ সময় তার কাছ থেকে কবিরাজি চিকিৎসায় ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের ১২৯টি আংটি, শঙ্খ ৩টি, আলাদিনের চেরাগ ১টি, ক্রেস্ট ২টি, কবিরাজি সংক্রান্ত বই ১৫টি, পিতলের পাঞ্জা ১টি ও কবিরাজি সংক্রান্ত অন্যান্য সরঞ্জামাদি জব্দ করা হয়।
র্যাব জানায়, ২০০৫ সালে বাগেরহাটের চাঞ্চল্যকর মনু হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হেমায়েত। হত্যাকাণ্ডের পর যশোর হয়ে ভারতে পালিয়ে যান তিনি। সেখানেও কবিরাজির নামে প্রতারণা করে আবার দেশে ফিরে আসেন। প্রথমে ঢাকার মিরপুর ও পরে মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় বসবাস করে চালিয়ে যান প্রতারণা।
২০০৫ সালের অক্টোবরে বাগেরহাটের মনোয়ারা মনু হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ২০০৯ সালে হেমায়েতের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন আদালত।
বৃহস্পতিবার (২৭ অক্টোবর) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ানবাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, হেমায়েত ১৫-১৬ বছর বয়স থেকে কবিরাজি পেশা শুরু করেন। কবিরাজির পেশার মাধ্যমে নানাভাবে মানুষের সঙ্গে আর্থিক প্রতারণা করতেন। তবে নারীরাই ছিল তার প্রতারণার মূল টার্গেট। ২০০৩ সালে তিনি স্ত্রী-সন্তানসহ পিরোজপুর থেকে বাগেরহাটে এসে কবিরাজি ব্যবসা শুরু করেন।
২০০৫ সালের জানুয়ারি মাসে ভুক্তভোগী মনু মাথাব্যথার কবিরাজি চিকিৎসার জন্য হেমায়েতের কাছে যান। মনুর স্বামী ঢাকায় চাকরি করতেন, আর মনু কাপড়ের ব্যবসা করতেন এলাকায়। তার কাছে থাকা জমানো নগদ টাকা ও জমির লোভে তাকে টার্গেট করেন হেমায়েত। এক পর্যায়ে মনুকে তার যাবতীয় সম্পত্তি এবং টাকা-পয়সায় জিনের আসর পড়তে পারে বলে ভয় দেখিয়ে সবকিছু হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। মনুও সরল বিশ্বাসে তার টাকা-পয়সা ও সম্পত্তির দলিল হেমায়েতের কাছে জমা রাখেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী একদিন মনুকে চেতনানাশক ওষুধ খাইয়ে দলিলে টিপসই নেওয়ার চেষ্টা করেন হেমায়েত। এতে ব্যর্থ হয়ে মনুকে কুপিয়ে এবং শেষ পর্যন্ত গলা কেটে হত্যা করেন তিনি।
র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, হত্যার পর গ্রেফতার এড়াতে পালিয়ে যশোরের একটি মাজারে গিয়ে আশ্রয় নেন হেমায়েত। পরদিন অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের আজমীর শরীফের পাশে বসবাস করতে থাকেন। ২০০৮ সালে দেশে ফিরে এসে ঢাকার মিরপুরে বসবাস শুরু করেন।
পরিচয় গোপন করে লম্বা চুল ও দাড়িসহ ছবি ব্যবহার করে জাহিদুল ইসলাম ছদ্মনামে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করেন। মিরপুরে থাকাকালীন কবিরাজির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা শুরু করেন হেমায়েত। ভাগ্য পরিবর্তনে তাবিজ, স্বামী-স্ত্রীর কলহ দূরীকরণ, বশীকরণসহ নানা কথা বলে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিতেন তিনি।
প্রতারণার কারণে জনরোষের মুখে ঠিকানা পরিবর্তন করে কিছুদিন আদাবর, কিছুদিন কেরানীগঞ্জ এবং সবশেষে বিগত ৫ বছর ধরে বছিলায় বিভিন্ন স্থানে বসবাস করেন। বছিলায় একইভাবে তিনি কবিরাজি ব্যবসা করতে থাকেন।
এরমধ্যে হেমায়েতের বিরুদ্ধে মানবপাচার ও কষ্টি পাথরের মূর্তি রাখার দায়ে মামলা হয়। ২০১৭ সালে একবার গ্রেফতার হয়ে দেড়মাস জেলও খাটেন তিনি। তবে তিনি ২০০৫ সালের হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি গোপন রাথতে সক্ষম হন।
খন্দকার আল মঈন বলেন, কবিরাজির মাধ্যমে প্রতারণার অভিযোগের তদন্ত করতে গিয়ে হেমায়েতকে আটক করা হয়। পরে নকল জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে তার আসল পরিচয় বেরিয়ে আসে।
হেমায়েত নিজেও প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি স্বীকার করেছেন। হত্যা মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে পলাতক ছিলেন বলে জানান তিনি। তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।
আরও পড়ুন:
কবিরাজের ছদ্মবেশে ১৭ বছর পলাতক হত্যা মামলার আসামি
বাংলাদেশ সময়: ১৫২০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৭, ২০২২
পিএম/এমজেএফ