বরিশাল: জাঁকালো অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সামাজিক প্রতিবন্ধী সৃষ্টি ও তানজিলার বিয়ে দিয়েছেন রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান, বিভাগীয় কমিশনার ও চার জেলা প্রশাসকসহ প্রশাসনের কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।
শনিবার (২৯ অক্টোবর) দুপুরে বরিশাল নগরের রুপাতলীর সামাজিক প্রতিবন্ধী মেয়েদের প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে এ বিয়ের অনুষ্ঠান হয়।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম, বরিশালের বিভাগীয় কমিশনার মো. আমিন উল আহসান, কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের কর কমিশনার তাসনিমা হোসেন লুনা, কর কমিশনার কাজী লতিফুর রহমান, বরিশালের জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দার, পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামাল হোসেন, ভোলার জেলা প্রশাসক মো. তৌফিক -ই-লাহী চৌধুরী ও পিরোজপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহেদুর রহমান, জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক আল মামুন তালুকুদার হোসেন, বরিশাল সদর উপজেলার চেয়ারম্যান সাইদুর রিন্টু, শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত বরিশাল প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসেন, বিসিসির পরিচালক আলমগীর হোসেন আলো, সমাজসেবক মাহমুদুল হক খান মামুন, জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের প্রবেশন অফিসার সাজ্জাদ পারভেজ প্রমুখ ।
গত তিন বছর আগে বিভিন্ন কারণে পরিবার ও সমাজ থেকে দূরে চলে আসা ১৯ বছরের তরুণী তানজিলা আক্তার এবং শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধী সৃষ্টি আক্তার আশ্রয় নেয় বরিশালের সামাজিক প্রতিবন্ধী মেয়েদের প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে।
জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের প্রবেশন অফিসার সাজ্জাদ পারভেজ বলেন, সামজিক প্রতিবন্ধী সেন্টারের নিবাসী তানজিলা আক্তারের বাড়ি শরীয়তপুরের ঘোষাইর হাট উপজেলার তুলাতলি এলাকায় আর সৃষ্টি আক্তারে বাড়ি বরিশাল সদর উপজেলার পলাশপুর এলাকায়। তিনবছর আগে সামাজিক প্রতিবন্ধী এই দুই মেয়ে আমাদের প্রতিবন্ধী মেয়েদের প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে আসেন। এরপর থেকে তাদের সেলাইসহ এখানে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। আর সর্বশেষ আজ আনুষ্ঠানিক ও সামাজিকভাবে তাদের বিয়ে দেওয়া হলো।
তিনি বলেন, একটি পরিবারের সন্তানকে যেভাবে বিয়ে দেওয়া হয়, সেভাবেই তানজিলা ও সৃষ্টির বিয়ের সব আয়োজন করা হয়। পাত্র দেখা থেকে শুরু করে, গায়ে হলুদ, বিয়ের মূল অনুষ্ঠান সবকিছুই জাঁকালো অনুষ্ঠানে মাধ্যমে করা হয়েছে। ফলে কোনো কিছুর কমতি না রেখে পুরো সেন্টারেই এখন বিয়ের উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে।
তিনি আরও বলেন, আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে সামাজিক প্রতিবন্ধী তানজিলা আক্তার কথা বলা থেকে সবকিছু স্বাভাবিকভাবে করতে পারলেও সে বিয়ে করছেন বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার নগরবাড়ী গ্রামের কৃষক ও বাকপ্রতিবন্ধী মো. রেজাউল সরদারকে। আর বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী সৃষ্টি আক্তার বিয়ে করছেন বরিশালের উজিরপুরের দক্ষিণ মোরাকাঠি এলাকার বাসিন্দা ও অটোরিকশাচালক ওবায়দুল মৃধাকে। যে কিনা স্বাভাবিক একজন মানুষ। তবে উভয় দম্পতিই এ বিয়েতে বেশ খুশি।
৩০০ জন মেহমানের আপ্যায়নের মধ্য দিয়ে শনিবার দুপুরে তিন লাখ টাকা করে দেনমোহর ধার্য করে বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে জানিয়ে সাজ্জাদ পারভেজ বলেন, মজার বিষয় হলো বিয়ের আগে আমরা আমাদের দুটি মেয়ের পরিবারকেই খুঁজে পেয়েছি। তারা এ বিয়েতে যেমন উপস্থিত ছিলেন, তেমনি দুই ছেলের পরিবারেরও সবাই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
এ বিষয়ে বরিশালের জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দার বলেন, সামাজিক প্রতিবন্ধী মেয়েদের প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের সবাই আমাদের মেয়ে। সেখানে থাকা আজ আমার দুই মেয়ের বিয়ে এতো জাঁকালোভাবে দিতে পেরেছি এটাই আনন্দের। আর এ উৎসবমুখর পরিবেশের পেছনে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম স্যার সার্বিক সহায়তা করেছেন। তার সহযোগিতার মধ্য দিয়ে আমরা নব এই দম্পতিকে কর্মসংস্থানের জন্য দুটি অটোরিকশা দিয়েছি। এছাড়া বরিশালের বিভাগীয় কমিশনার মো. আমিন উল আহসান নির্দেশনায় বিয়েতে যা যা মেয়ের পরিবার থেকে দেওয়া প্রয়োজন তার সবকিছু যেমন লেপ, তোষক, ডিনারসেটসহ অনেক উপহার দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সে সঙ্গে মেয়েরা সেলাইয়ের কাজ করতে পারেন, তাই তাদের দুজনকে দুটি সেলাই মেশিনও দিয়েছি। এছাড়া বরিশাল সদর উপজেলার চেয়ারম্যান সাইদুর রিন্টু, বিসিসির পরিচালক আলমগীর হোসেন আলো সমাজসেবক মাহমুদুল হক খান মামুন এ তিনজনে মিলে ৫০ হাজার টাকা উপহার দিয়েছেন, যা দুই দম্পতিকে ২৫ হাজার টাকা করে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত বরিশাল প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসেন এখানে নিজ উদ্যোগে ৩০০ মেহমানের দুপুরের খাবারের আয়োজন করেছেন। সবমিলিয়ে আমার মেয়ের বিয়েতে যা করা প্রয়োজন ছিল, তাই করা হয়েছে।
রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু হেনা রহমাতুল মুনিম বলেন, এই কেন্দ্রের বাইরে সামাজিক প্রতিবন্ধী নামটা লেখা রয়েছে, এ জায়গাটাতে আমার থাকলেও আসলেই তারা সামাজিক প্রতিবন্ধী। সমাজ তাদের প্রতিবন্ধী করে রেখেছে, সমাজ তাদের গ্রহণ করতে চায় না। এ জায়গাতে আমি এড্রেস করতে চাই, সমাজ যেন তাদের গ্রহণ করে নেয়। আমি যখন বরিশালের বিভাগীয় কমিশনার ছিলাম, তখন এই মেয়েদের জন্য কিছু করতে চেয়েছি কিন্তু বেশি কিছু করতে পারিনি। এরপর এখান থেকে চলে গেলেও তাদের কথা আমার মনে ছিল। আজ এখানকার দুটি মেয়ের বিয়ে হয়েছে। আমি আশা করি সমাজে যারা প্রতিষ্ঠিত রয়েছেন, তারা এভাবে এখানকার মেয়েদের বিয়েতে আমার মতো সবাই এগিয়ে আসবেন। এখানে শেষ নয়, এভাবে সামাজিক প্রতিবন্ধী মেয়েরা আসবে আর আমাদের সমাজের লোকদেরই তাদের রেসকিউ করতে হবে।
এদিকে কথা না বলতে পারলেও হাত দিয়ে বিয়েতে খুশি হওয়ার কথা বুঝিয়েছেন সৃষ্টি আক্তার। আর তানজিলা বলেন, আমাদের দু বোনের জন্য দোয়া করবেন। আমি কথা বলতে পারছি কিন্তু আমার বোন কথা বলতে পারছে না, আবার আমার সঙ্গে যিনি সংসার করতে যাচ্ছেন তিনি কথা বলতে পারেন না, কিন্তু বাকপ্রতিবন্ধী আমার বোনের স্বামী কথা বলতে পারেন। আমরা দু-বোনই নিজ ইচ্ছায় এ বিয়েতে খুশি মনে রাজি হয়েছি। কারণ সবকিছুই তো আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন, কথা বলতে না পারাটা দোষের কিছু নয়। মনের মিল থাকলে সবকিছু ঠিক থাকবে। আমাদের জন্য দোয়া করবেন।
এদিকে দুই বরের বাবা-মা, স্বজনরা বিয়েতে এসেছেন, তারাও এ বিয়েতে বেশ খুশি হয়েছেন বলে জানিয়েছেন। বিয়ের পর তানজিলাকে নিয়ে আগৈলঝাড়ায় গ্রামের বাড়িতে থাকবেন বাকপ্রতিবন্ধী রেজাউল সরদার, আর সৃষ্টিকে নিয়ে বরিশাল নগরেই থাকবেন অটোরিকশাচালক ওবায়দুল মৃধা।
তিনি বলেন, কোনো কিছু পাওয়ার আসায় বিয়ে করিনি। সৃষ্টিকে ভালো লেগেছে, তাই প্রস্তাবের মাধ্যমেই তাকে বিয়ে করছি। সবাই আমাদের জন্য দোয়া করবেন।
এদিকে ওবায়দুলের মা বেবী নাজনীন বলেন, সন্তানের উজ্জল ভবিষ্যৎ কামনা করছি। যেন বিয়ের পর স্ত্রীকে নিয়ে সুখে সংসার করতে পারেন। ছেলের পছন্দই আমাদের পছন্দ। আমরা এ বিয়েতে খুশি।
বাংলাদেশ সময়: ১৭১৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৯, ২০২২
এমএস/আরআইএস