ঢাকা: আমাদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে প্রাণিজ আমিষের চাহিদা বাড়লেও দেশের সব মানুষ সমান হারে প্রাণিজ আমিষ গ্রহণ করছে না, বিশেষ করে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। ফলে দেশে এখনও পাঁচ বছরের কম বয়সী ১০ শতাংশ শিশু খর্বকায়, বৃদ্ধি জনিত সমস্যা রয়েছে ২৮ শতাংশ শিশু এবং ২৩ শতাংশ শিশুর ওজনস্বল্পতা রয়েছে৷ এঅবস্থা থেকে উত্তরণে খাদ্যনিরাপত্তা, সুষম পুষ্টি নিশ্চিতকরণ, কর্মসংস্থান ও নারীর ক্ষমতায়ন, দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন করতে হবে।
এক্ষেত্রে আমাদের প্রাণিসম্পদ খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আর এই সূচকগুলো জাতিসংঘের এসডিজি বা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৯টি লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পর্কযুক্ত। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন, আধুনিক প্রযুক্তিগত সহায়তার অভাব, জনবল ও বাজেট সংকট রয়েছে। পাশাপাশি এ খাতকে শুল্কমুক্ত করা, গবেষণায় বরাদ্দ বাড়ানো, খামারিদের বিমার আওতায় আনার প্রয়োজন রয়েছে। এ খাতকে গুরুত্ব দিলে এসডিজির দারিদ্র্য দূরীকরণ, ক্ষুধা দূর করা, সুস্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে প্রাণিসম্পদখাতের মধ্যে পোলট্রি কিছুটা এগিয়েছে, কিন্তু ডেইরী খাত বিশেষ করে দুধ উৎপাদন পরিস্থিতি আশাব্যঞ্জক নয়। গ্রামীণ কর্মশক্তির ২০ শতাংশ প্রাণিসম্পদ খাতের সঙ্গে জড়িত। ৪৪ শতাংশ আমিষ পাওয়া যাচ্ছে এ খাত থেকে। পুষ্টি, খাদ্যনিরাপত্তার দিক থেকেও খাতটি গুরুত্বপূর্ণ। এ খাতকে শুল্কমুক্ত করা, গবেষণায় বরাদ্দ বাড়ানো, খামারিদের বিমার আওতায় আনা এবং সর্বোপরি এ খাতে সরকারের জবাবদিহি বাড়ানোর বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। পাশাপাশি বাজেটে বরাদ্দও বাড়াতে হবে।
জানা গেছে, প্রাণিসম্পদ সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখবে আমাদের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ক্ষুধা নিরসন এবং সবার জন্য পুষ্টিবিধান ও দারিদ্র্য নিরসনসংক্রান্ত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে। প্রাণিসম্পদ উন্নয়নের ক্ষেত্রে জমির স্বল্পতা আমাদের একটি বড় বাধা। গবাদিপশু পালন এবং সেগুলোর খাদ্যের জোগান দেওয়ার জন্য জমির প্রয়োজন। অনেকেই দেশের চরাঞ্চলগুলো ব্যবহার করে এই সমস্যা সমাধানের কথা ভাবছেন। কিন্তু সেক্ষেত্রে আমাদের ভাবতে হবে যে এসব চরাঞ্চল চিকিৎসাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকে অনেক দূরে। চরাঞ্চলে পশুপালন জনপ্রিয় করতে হলে এসব এলাকায় পশুর চিকিৎসাসহ অন্যান্য সুবিধা পৌঁছে দিতে হবে। আর সে জন্য অবশ্যই বিনিয়োগ করতে হবে। দেশের ক্ষুদ্র খামারিদের উন্নয়নের জন্য ছোট খামারগুলোকে এলাকাভিত্তিক গুচ্ছ খামারের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এর মাধ্যমে উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ এবং বণ্টন করার ক্ষেত্রে ছোট খামারিরা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারবেন এবং বড় খামারগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবেন।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) লক্ষ্যগুলোর মধ্যে দারিদ্র্য দূর করা, খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা, সুস্বাস্থ্য, উন্নত শিক্ষা নিশ্চিত ও লিঙ্গবৈষম্য প্রতিরোধ অন্যতম। অথচ দেশে এখনও পাঁচ বছরের কম বয়সী ১০ শতাংশ শিশু খর্বকায়, শিশুদের মধ্যে বৃদ্ধি জনিত সমস্যা রয়েছে ২৮ শতাংশ এবং ২৩ শতাংশ পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর ওজনস্বল্পতা রয়েছে। নগরে- দারিদ্র্য ও ঘনবসতি, পার্বত্য চট্টগ্রামে- দুর্গম এলাকা, খাদ্য ঘাটতি, ফসলি জমির অভাব, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক পার্থক্যের কারণে খাদ্যাভাসে পরিবর্তন এবং পোশাক শিল্পে- নারীদের কঠোর পরিশ্রম ও অসচেতনতার কারণে পুষ্টি পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নত হয়নি।
এদিকে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বর্তমানে দিনে জনপ্রতি মাংসের চাহিদা ১২০ গ্রাম, পাচ্ছে ১৪৭.৮৪ গ্রাম, দুধের চাহিদা ২৫০ এমএল, পাচ্ছে ২০৮.৬১ এমএল এবং ডিমের চাহিদা বছরে ১০৪ টি পাচ্ছে ১৩৬ টি। ২০৩০ সালের মধ্যে দিনে জনপ্রতি মাংস পাবে ১৫০ গ্রাম, দুধ ২৭০ এমএল এবং ডিম বছরে ১৬৫ টি। আর ২০৪১ সালের মধ্যে দিনে জনপ্রতি মাংস পাবে ১৬০ গ্রাম, দুধ ৩০০ এমএল এবং বছরে ডিম পাবে ২০৮ টি।
মানুষের চাহিদা হিসাব করে মাংস, দুধ ও ডিম উৎপাদনের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বর্তমানে মাংস উৎপাদন হচ্ছে ৯২ দশমিক ৬৫ লাখ মেট্রিকটন, ২০৩০ সালে উৎপাদন দাঁড়াবে ১০৯ দশমিক ৩ লাখ মেট্রিকটনে এবং ২০৪১ সালে দাঁড়াবে ১১৬ দশমিক ৩ লাখ টন। দুধ উৎপাদন হচ্ছে ১৩০ দশমিক ৭৪ লাখ মেট্রিকটন। ২০৩০ সালে হবে ১৯৬ দশমিক ৭ লাখ টন এবং ২০৪১ সালে হবে ২৪৪ দশমিক ৭ লাখ টন। বর্তমানে জনপ্রতি বছরে ১৬৫ টি ডিম হিসেবে উৎপাদন হচ্ছে ২ হাজার ৩৩৫ দশমিক ৩৫ টি ডিম, ২০৩০ সালে মধ্যে জনপ্রতি বছরে ১৬৫ টি ডিম হিসেবে ৩ হাজার ২৯৩ দশমিক ৪০ টি ডিম এবং ২০৪১ সালে দাঁড়াবে ৪ হাজার ৬৪৮ দশমিক ৮০ টি ডিম।
এ বিষয়ে এসডিজি বিষয়ক প্রাণিসম্পদ পরিসংখ্যান কর্মকর্তা ডা. হোসেন মো. সেলিম বাংলানিউজকে বলেন, এসডিজির মোট ১৭টি গোলের ১৬৯টি লক্ষ্যমাত্রা। এরসধ্যে ৯টি গোল প্রাণিসম্পদ খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই ৯টি গোলের আবার ২৮টি লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। আর এসব কিছু কভার করে গোল নং ১ ও ২। এক নং গোলে রয়েছে দারিদ্রবিমোচন। আমাদের উপজেলা পর্যায়ে প্রাণিসম্পদ খাতে দারিদ্য বিমোচনে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। আর ২ নম্বর গোলে রয়েছে পুষ্টি, খাদ্য নিরাপত্তা ও ক্ষুধা দূর। আমাদের মূল কাজ হলো দুধ মাংস ও ডিম উৎপাদন। আমরা বর্তমানে মাংস উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আমাদের ১২০ গ্রাম করে প্রতিদিন দরকার সেখানে আমরা ১৩৬ গ্রাম করে পাচ্ছি। প্রতিদিন দুধ ২৫০ এমএল দরকার সেখানে আমরা ২০৮ এমএল করে পাচ্ছি। বছরে ডিম ১০৪টি দরকার সেখানে আমরা পাচ্ছি ১৩৫টি। দুধ, মাংস ও ডিম উৎপাদন এগুলো পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। তবে মাংস ও ডিমে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও দুধে ঘাটতি রয়েছে। এ লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে প্রাণিসম্পদ ও ডেইরী উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্প এসডিজি ৯টি গোলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
এছাড়া ২০৩০ সালের মধ্যে যে প্রকল্পগুলো আসবে সেগুলো গোল অনুযায়ী বাস্তবায়ন করা হবে। তবে আমাদের কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যেমন জলবায়ু নেতিবাচক পরিবর্তন হলো আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এছাড়া আধুনিক প্রযুক্তি, জনবল ও বাজেট সংকট রয়েছে। এ বিষয়গুলোর প্রতি যদি একটু নজর দেওয়া হয় তাহলে আমাদের এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সহজ হবে। পাশাপাশি বাজেট বরাদ্দও বাড়াতে হবে।
উপকূলীয় চরাঞ্চলে সমন্বিত প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ডা.এসএম জিয়াউল হক বাংলানিউজকে বলেন, সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল (এসডিজি) ১৭ টি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে ৫ টির সঙ্গে সরাসরি সংযোগ রয়েছে। ১. নোপ্রভাটি বা দরিদ্র মুক্তদেশ, ২. ক্ষুধা মুক্ত দেশ, ৫. নারী ক্ষমতায়ন, ৮. সকলের জন্য কর্মসংস্থান এবং ১৩. জলবায়ু পরিবর্তন এই গোলের সঙ্গে আমাদের সম্পৃক্ততা রয়েছে। উপকূল জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারণে যে ক্ষতি হয় সে ক্ষতি যাতে সহজে কাটিয়ে উঠতে পারে সেটা নিয়ে কাজ করছি। এ লক্ষ্যে আমরা নারীদের বেশি প্রাধান্য দিচ্ছি। যাতে তারা পরিবারের পুষ্টির চাহিদা পূরণ, দারিদ্রবিমোচন, লিঙ্গ বৈষম্য কমানো এবং অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী হতে পারে। একই সঙ্গে হাঁস, মুরগি, ছাগল, ভেড়া ও গরু পালনের মাধ্যমে ক্ষুদ্র খামার স্থাপন করে উদ্যোক্তা তৈরি করছি। যাতে তারা জাতীয় অর্থনীতিসহ এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সহায়তা করতে পারে আমরা সে লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছি।
তিনি বলেন, আমরা উপকূলের চরাঞ্চলের বরিশাল, ভোলা, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, নোয়াখালী, লক্ষীপুর, ফেনী ও কক্সবাজার এই ৮ জেলার ২০টি উপজেলার ১০৯টি ইউনিয়ন নিয়ে কাজ করছি। এখানে ৫৪ হাজার ৫০০ জন উপকারভোগী রয়েছে। এরমধ্যে ৪৯ হাজার ৫০ জন নারী। এদের আমরা ট্রেনিং দিচ্ছি। প্রতিটি ইউনিয়নে ৫০০ জন করে উপকারভোগী রয়েছে।
আধুনিক প্রযুক্তিতে গরু হৃষ্টপুষ্টকরণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ডা. প্রাণকৃষ্ণ হাওলাদার বাংলানিউজকে বলেন, আমরা এখন মাংসে স্বয়ংসম্পূর্ণ। মানুষের জন্য এই মাংসকে নিরাপদ করা হচ্ছে আমাদের প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য। এ লক্ষ্যে আমরা খামারিদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে গড়ে তুলি। তাদেরকে আর্গানিক ও হাইজেনিক উপায়ে কীভাবে মাংস উৎপাদন করতে হয় এটা আমরা প্রমোট করছি। এটা হলো এসডিজির নিরাপদ পুষ্টি নিশ্চিতকরণ গোলের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
তিনি বলেন, আমরা এক লাখ ১১ হাজার খামারিকে প্রশিক্ষিত করেছি। এর ফলে গত ৩ বছরে আমরা আমদানি ছাড়া নিজস্ব উৎপাদিত পশু দিয়ে কোরবানি সম্পন্ন করেছি। পাশাপাশি আমরা মাংসে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়াসহ আমিষ ও পুষ্টির চাহিদা পূরণ করতে পেরেছি। যা এসডিজির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত।
তিনি বলেন, দেশের ৬৪ টি জেলার ৪৯১টি উপজেলায় এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছি। এরমধ্যে রাজশাহী ও ঢাকা বিভাগকে চরাঞ্চল, হাওড়কে বিশেষ প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। গরু মোটাতাজা করণ একটি লাভজনক ও সিজনাল ব্যবসা হওয়ায় খামারিদের আগ্রহও অনেক বেশি।
সমতল ভূমিতে অনগ্রসর ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর উন্নয়নে সমন্বিত প্রানিসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক অসিম কুমার দাস বাংলানিউজকে বলেন, এটি একটি অগ্রাধিকার প্রকল্প। এ প্রকল্পের মাধ্যমে সমতলে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীকে মূলধারায় ফিরিয়ে আনার বৃহত্তর প্রক্রিয়া। আমরা এই প্রকল্পের মাধ্যমে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এক লাখ ৩৮ হাজার পরিবারকে সহায়তার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করছি। এ পর্যন্ত ৩০ হাজার পরিবারকে আমরা গরু, ছাগল, ভেড়া, হাঁস মুরগি পালনসহ বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ ও উপকরণ দিয়ে সহায়তা করে আসছি৷ এই বছর শেষে আরও ১০ হাজার পরিবারকে যুক্ত করতে পারবো। আশা করছি আগামী ২ বছরের মধ্যে আমাদের লক্ষ্যমাত্রার প্রায় শতভাগ পূরণ করতে পারবো।
প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের (এলডিডিপি) প্রধান প্রযুক্তিগত সমন্বয়কারী মো. গোলাম রাব্বানী বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের এলডিডিপি প্রকল্প খামারিদেরকে সংগঠিত করবে। তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রযুক্তি দিয়ে তাদের সক্ষমতার উন্নয়ন করা। তাদের উৎপাদিত পণ্যের বাজারজাত করা। কিন্তু আমাদের ডেইরি খাতে বাজার ব্যবস্থা সেভাবে গড়ে ওঠেনি। এজন্য বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করা হচ্ছে যাতে করে উৎপানকারীদের কাছে ক্রয়কারীরা যেতে পারে। এ লক্ষ্যে আমরা কালেকশন সেন্টার তৈরি করছি।
এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এই খাতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা ১৭ কোটি মানুষের পুষ্টির নিশ্চয়তায় কাজ করছি। দুধ হলো এর একটি অন্যতম পণ্য। এই দুধ যেন ভোক্তার জন্য নিরাপদ হয়। সোজন্য সাপ্লাইচেইন, ফুড সেফটি মেন্টেইন করা জরুরি। যারা এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত তাদের সচেতন করা ও সহায়তা করা হলো আমাদের কাজ। পাশাপাশি ভোক্তাদেরও সচেতন করতে হবে। অনেকই প্রতিদিন দুধ, ডিম বা মাংস রুটিন করে খান না। তাদের এই রুটিনের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। এটা যদি আমরা করতে পারি। তাহলে পুষ্টি নিশ্চিত হওয়াসহ দেশের অভ্যন্তরে একটি বড় বাজার সৃষ্টি হবে। আর এই বাজার তৈরি হলে উৎপাদনকারীরা তাদের পণ্য বিপননে সমস্যায় পড়বে না। আর উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ ও বাজারজাতকরণ যদি বেগবান হয় তাহলে আত্ম কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে।
এছাড়া আমাদের আরেকটা বড় টার্গেট হলো, উৎপাদিত পণ্য দেশের বাইরে রপ্তানি করা। এজন্য আমাদের ডেটাবেস থাকতে হবে। সেখানে ঘাটতি রয়েছে। এলডিডিপি সেই ডেটাবেসের কাজটি করছে। বাহ্যিক দৃষ্টিতে মনে হতে পারে এটার গতি কম। কিন্তু আমাদের এভাবেই এগিয়ে যেতে হবে। এটি একটি অনেক বড় বিনিয়োগ, সরকার অনেক বড় প্রত্যাশা নিয়ে করছে।
তিনি বলেন, একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অনেক ধরনের লোকের সম্পৃক্ততা রয়েছে। তাদের একই দিকে ধাবিত করা একটা বড় চ্যালেঞ্জের বিষয়। আবার একই কাজের জন্য একাধিক প্রতিষ্ঠানের সম্মতি পাওয়া নিয়ে একটু সময় বেশি যায়। আমাদের প্রকল্প প্রণয়ন হয়েছে ২০১৮ সালে এরপর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে আমাদের নির্মাণ সামগ্রিক খরচ বেড়েছে, আমদানিতে ডলারের দাম বেড়েছে ফলে প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে একটু সময় সাপেক্ষ হয়ে যাচ্ছে এগুলোই হলো চ্যালেঞ্জ।
বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তারা বাংলানিউজকে জানান, বাংলাদেশকে মধ্যম আয় ও উন্নত দেশে পরিণত করতে হলে প্রথম প্রয়োজন মেধা। এ ক্ষেত্রে প্রাণিজ আমিষের বিকল্প নেই। এসডিজির লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সমন্বয় করে সরকার বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। তবে এ খাতে জলবায়ু পরিবর্তনে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়া, শুষ্ক মৌসুমে গবাদিপশুর খাদ্যের অভাব, গরুসহ বিভিন্ন গবাদিপশুর দেশীয় জাত সংরক্ষণ এবং রোগ নিয়ন্ত্রণের মতো চ্যালেঞ্জগুলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মোকাবিলা করতে হবে। এজন্য আমরা লবণসহিষ্ণু ঘাস আবিষ্কার, দেশীয় গরুর জাত সংরক্ষণ, রোগ নিয়ন্ত্রণে কাজ করে যাচ্ছি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পুষ্টি গবেষণা কাউন্সিলের সাবেক সদস্য পরিচালক ও পুষ্টিবিদ ড. মনিরুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রাণিসম্পদ খাতের গুরুত্ব অপরিসীম। আমরা বলে থাকি খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছি। কিন্তু আমরা পুষ্টির নিরাপত্তার কথা চিন্তা করলে প্রাণিসম্পদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। আমাদের প্রাণিজপ্রোটিন যেটা সেটা কিন্তু প্রাণিসম্পদ খাত থেকে আসে। আমরা মাছ, মাংস, ডিমে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও দুধে পিছিয়ে আছি। এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা ২এ শুধু ক্ষুধা দূর নয়, পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তার কথা বলা হয়েছে। যা আমাদের প্রাণিজসম্পদ থেকে আসে। ফলে এসডিজি লক্ষমাত্রা অর্জনে প্রাণিসম্পদ খাতের বিকল্প নেই।
তিনি বলেন, নিরাপদ খাদ্যে আমাদের মুরগি এখন অনেক ফিট। আমাদের নিশ্চিত করতে হবে ৩৫ দিনের আগে মুরগি বাজারে ছাড়া যাবে না।
তিনি বলেন, এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সরকারকে এখন কৃষি লোন, বীমা এসব বিষয়ে নজর দিতে হবে। পাশাপাশি দুধের বাজারজাত করণ করতে হবে। দুধ সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাত করার ব্যবস্থা করতে হবে। আপদকালীন সময়ে সরকারকে নজর দিতে হবে। খামারিদের বিভিন্ন বীমার আওতায় এনে তাদেরকে আরো সহায়তা করতে হবে, নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে হবে। উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনতে হবে। খামারিদের জন্য সহজ শর্তে লোনের ব্যবস্থা করতে হবে।
এ বিষয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মনজুর মোহাম্মদ শাহজাদা বাংলানিউজকে বলেন, এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা ২ নম্বর হচ্ছে ক্ষুধা দুরীকরণ। এর লিড মন্ত্রণালয় হচ্ছে কৃষি মন্ত্রণালয় আর কো-লিড হচ্ছে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। আমরা সেই লক্ষ্য পূরণে দায়িত্ব পালন করে চলেছি। এসডিজির অনেকগুলো স্টেকহোল্ডারের মধ্যে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর একটা স্টেকহোল্ডার। আমরা নিরাপদ প্রাণিজপুষ্টি সরবরাহের মাধ্যমে মেধাবী জাতি গঠনে কাজ করছি৷ সে হিসেবে প্রাণিসম্পদ খাতটি গুরুত্বপূর্ণ এবং তা এসডিজির বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এসডিজির মূল থিম হলো কাউকে পশ্চাতে ফেলে নয়, উন্নয়নটা হবে সবাইকে নিয়ে। এলক্ষ্যে আমাদের কিছু পরিকল্পনা রয়েছে। সে অনুযায়ী আমাদের ১৪টি প্রকল্প চলমান রয়েছে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বাংলানিউজকে বলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন (এসডিজি) অর্জনে বর্তমান সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এসডিজির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে রয়েছে প্রাণিসম্পদ খাত। এ খাত মানুষের খাদ্যের জোগান দিয়ে ক্ষুধার অবসানে যেমন ভূমিকা রাখছে তেমনি পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি, উদ্যোক্তা তৈরি, গ্রামীণ অর্থনীতি সচল রাখাসহ মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নে এই খাত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। সর্বশেষ অর্থবছরে জিডিপিতে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান ১ দশমিক ৯ শতাংশ।
তিনি বলেন, এসডিজির ৯ টি অভীষ্ট ও ২৮টি লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে প্রাণিসম্পদ খাত সরাসরি সম্পৃক্ত। ইতোমধ্যে প্রাণিসম্পদ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অভীষ্ট-১ ও ২ অর্জনের লক্ষ্যে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বেশ কিছু কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এগুলো বাস্তবায়ন হলে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি সাধন হবে। বর্তমান সরকারের নিরলস প্রচেষ্টায় মাংস ও ডিম উৎপাদনে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে এবং দুধ উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন হয়েছে।
মন্ত্রী বলেন, ২০৩০ সালে এসডিজি অর্জনে দেশের মানুষের চাহিদা নিরূপণ করে মাংস, দুধ ও ডিম উৎপাদনের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এসডিজির এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পসহ এ খাতে নানা উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। সকলের জন্য নিরাপদ পুষ্টি নিশ্চিতকরণ ও দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্য নিয়ে এসডিজি'র নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সরকার একনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
জাতিসংঘ ২০১৫ সালে এসডিজি গ্রহণ করে। এটি ১৫ বছর মেয়াদি। এর উদ্দেশ্য ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বে শান্তি ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করা। সেই লক্ষ্যে ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। আর ১৬৯টি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। জাতিসংঘ এর আগে সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) গ্রহণ করেছিল। এরপরই এসডিজি আসে। এসডিজির লক্ষ্যগুলোর মধ্যে দারিদ্র্য দূর করা, খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা, সুস্বাস্থ্য, উন্নত শিক্ষা নিশ্চিত ও লিঙ্গবৈষম্য প্রতিরোধ অন্যতম।
এসডিজির এবারের সূচকে বাংলাদেশের সার্বিক স্কোর ৬৩ দশমিক ৫ শতাংশ। গত বছর এ স্কোর ছিল ৬৩ দশমিক ২৬ শতাংশ। ২০১৫ সালে যখন এসডিজি গৃহীত হয়, তখন বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৫৯ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। বিশ্বের ১৬৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৯। বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে আছে।
বাংলাদেশ সময়: ১১৩০ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩১, ২০২২
জিসিজি/এসআইএস