ঢাকা: সফিকুল ইসলাম ওরফে শফিউল্লাহ শেখ, পরিবারের অভাব ঘোচাতে পাড়ি জমাতে চেয়েছিলেন ইতালি। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, প্রথমে দুবাই, সেখান থেকে সিরিয়া এরপর লিবিয়া গেলেও পৌঁছতে পারেননি স্বপ্নের দেশে।
শফিউল্লাহর বাড়ি পিরোজপুরের নাজিপুর উপজেলায়। ইতালি যাত্রায় বাদশা নামে মানব পাচারকারী চক্রের এক সদস্যের সঙ্গে টাকায় চুক্তি করেন তিনি। চুক্তি অনুসারে বাদশাকে ৭ লাখ টাকা দেন শফিউল্লাহ। তাকে প্রথমে দুবাই পাঠায় বাদশার চক্র। সেখান থেকে সিরিয়া, পরে লিবিয়ার বেনগাজি পৌঁছান ভুক্তভোগী। সেখানেই অপহরণ ও জিম্মিদশায় আটকা পড়েন পিরোজপুরের এ বাসিন্দা। তাকে বেনগাজিতে আটকে রেখে চাওয়া হয় ৫ লাখ টাকা মুক্তি পণ।
গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার সময় শফিউল্লাহ নিজেই এসব তথ্য দেন। তিনি জানান, বাদশার সঙ্গে কাজ করেন রাজীব। তিনিও মানব পাচারকারী চক্রের সদস্য। বাংলাদেশ থেকে তাকেসহ সাতজনকে প্রথমে দুবাই নিয়ে যাওয়া হয়। দুবাই এয়ারপোর্ট থেকে তাদের একটি বাসায় নিয়ে যান রাজিবের সহযোগী সবুজ। সেখানে তাদের সঙ্গে দেখা হয় আরও ৩৫ জনের। মোট ৪২ জনকে চক্রের সদস্যরা দুবাই থেকে সিরিয়া নিয়ে যায়।
এ যাত্রায় তিনদিন অভুক্ত ছিলেন শফিউল্লাহ। পরে সিরিয়া থেকে তাদের নেওয়া হয় লিবিয়ায়। দেশটির বিমানবন্দর থেকে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় বেনগাজিতে একটি বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাদের পাসপোর্ট আটকে ফেলে চক্রের সদস্যরা। সুলতান নামে এক ব্যক্তি তাদের নির্যাতন করতেন। তিনি রাজিবের ভগ্নীপতি। শফিউল্লাহর কাছে ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ চান সুলতান। সুযোগ পেয়ে শফিউল্লাহ এসব তথ্য জানান পরিবারকে। শফিউল্লাহ দেশে ফেরার আগ পর্যন্ত নির্যাতনের শিকার হতে থাকেন।
তিনি আরও জানান, প্রতারণার বিষয়টি পরিবার জানতে পারলে তার ভগ্নীপতি পুলিশের সহায়তা নেন। পরে পুলিশের সহায়তায় দেশে ফেরেন তিনি।
সম্প্রতি ভুক্তভোগী শফিউল্লাহর পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতে গত শুক্রবার (২৮ অক্টোবর) রাজধানীর যাত্রাবাড়ী ও ডেমরা থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে ইউরোপ ও ইতালিসহ মধ্যপ্রাচ্যের আন্তঃদেশীয় সংঘবদ্ধ পাচারকারী চক্রের মুলহোতা বাদশা ও রাজিব মোল্লাকে গ্রেফতার করে ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের মোহাম্মদপুর জোনাল টিম।
মঙ্গলবার (১ নভেম্বর) দুপুরে রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর-রশিদ।
তিনি বলেন, গ্রেফতার রাজিবের আত্মীয় দুবাই অবস্থানকারী সংঘবদ্ধ পাচারকারী চক্রের সদস্য সবুজ। তিনি দুবাই এয়ারপোর্টে ভুক্তভোগীসহ আরও ২০ জনকে রিসিভ করে একটি বাসায় নিয়ে যান। দুবাই থেকে সিরিয়া হয়ে লিবিয়ার মিসরাত এলাকার একটি ক্যাম্পে গ্রেফতার বাদশা ও রাজিবের বোন জামাই সুলতানের নেতৃত্বে ভুক্তভোগীকে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়।
হারুন অর রশীদ আরও বলেন, ভুক্তভোগী শফিউল্লাহকে নির্যাতন করে মোবাইল ফোনে তার পরিবারকে কান্না শুনিয়ে ৫ লাখ টাকা দাবি করা হয়। পরবর্তীতে ভুক্তভোগীর পরিবার গোয়েন্দা তেজগাঁও বিভাগে এলে যাত্রাবাড়ী থানায় মানবপাচার আইনে গত ২৭ অক্টোবর একটি মামলা করা হয়। গোয়েন্দা তেজগাঁও বিভাগ তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তায় সংঘবদ্ধ পাচারকারী চক্রের দেশিয় দুই সদস্য বাদশা ও রাজিব মোল্লাকে গ্রেফতার করা হয়।
গ্রেফতার আসামিদের মাধ্যমে লিবিয়ায় অবস্থানকারী সংঘবদ্ধ পাচারকারী চক্রের অন্যতম সদস্য সুলতানের সঙ্গে যোগাযোগ করে ভুক্তভোগী শফিউল্লাহকে লিবিয়া থেকে উদ্ধার করে দেশে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়। বর্তমানে তিনি চিকিৎসাধীন।
গ্রেফতারদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে গোয়েন্দা প্রধান বলেন, আন্তঃদেশীয় সংঘবদ্ধ পাচারকারী চক্রের সদস্য বাদশা ও রাজিব ভুক্তভোগীসহ দেশের বেকার যুবক ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে ইতালি ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে লিবিয়ায় পাচার করে থাকে। চক্রটি বিদেশে অবস্থান করা অন্যান্য সদস্যদের মাধ্যমে ভুক্তভোগীদের অপহরণ করে ক্যাম্পে আটক রেখে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে তাদের পরিবারদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করে থাকে। গ্রেফতারদের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলেও জানান হারুন অর রশীদ।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ১, ২০২২
এসজেএ/এমজে