ঢাকা, বুধবার, ১৪ কার্তিক ১৪৩১, ৩০ অক্টোবর ২০২৪, ২৬ রবিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

কথিত হিজরতে ‘ট্যুরিস্ট বেশে’ বান্দরবানে

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৫৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ৫, ২০২২
কথিত হিজরতে ‘ট্যুরিস্ট বেশে’ বান্দরবানে

ঢাকা: দেশের পর্যটনের জন্য অন্যতম জেলা বান্দরবান। যেখানে বছরের প্রায় সবসময়ই থাকে অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় ও পাহাড় প্রেমীদের ভিড়।

সম্প্রতি গুরুত্বপূর্ণ এই পর্যটন এলাকা কেন্দ্র করে বিচ্ছিন্নতাবাদী ও জঙ্গি সংগঠনের অপতৎপরতার বিষয়টি এখন আলোচনায়।

যেখানে কথিত হিজরতের নামে ঘরছাড়া অর্ধশতাধিক তরুণ অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে। কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) এবং তাদেরই নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার সংগঠিত হওয়ার এই বিষয়টি এখন আশঙ্কার।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জঙ্গি সংগঠনটির ডাকে হিজরতে বের হওয়া তরুণদের বান্দরবানে পাঠানো হচ্ছে ট্যুরিস্টের বেশে। সংগঠনের হিযরতকৃত সদস্যদের সমন্বয়কের মাধ্যমে সর্বশেষ দুইধাপে প্রায় ২৯ জনকে ট্যুরিস্টবেশে সেখানে পাঠানোর তথ্য পাওয়া গেছে।

এ অবস্থায় প্রায় এক মাস ধরে দুর্গম পার্বত্য এলাকার গহীনে যৌথবাহিনীর অভিযান অব্যাহত রয়েছে। গত ৬ অক্টোবর থেকে মুন্সীগঞ্জ, নারায়নগঞ্জ, ময়মনসিংহ, যাত্রাবাড়ী, কেরানীগঞ্জ, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান এলাকায় অভিযান চালিয়ে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার ২২ জনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। ।  

সর্বশেষ বৃহস্পতিবার (৩ নভেম্বর) কুমিল্লার লাকসাম থেকে আরো চারজনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব।  

এরমধ্যে সংগঠনটির অর্থ বিষয়ক প্রধান সমন্বয়ক মুনতাছির আহম্মেদ ওরফে বাচ্চু, সারাদেশে হিযরতরত সদস্যদের সার্বিক সমন্বয়ক আব্দুল কাদের ওরফে সুজন ওরফে ফয়েজ ওরফে সোহেল ও ইসমাইল হোসেন ওরফে হানজালা ওরফে মানসুর। আর সামরিক শাখার তৃতীয় সর্বোচ্চ ব্যক্তি হেলাল আহমেদ জাকারিয়া।

গ্রেফতার সোহেল ও হানজালাকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে র‌্যাব জানায়, তারা সংগঠনের আমীর মাহমুদের একান্ত সহযোগী ও সারাদেশে হিজরতকৃত সদস্যদের সার্বিক সমন্বয়ক ছিলেন। তারা বিভিন্নদেশে মুসলমানদের ওপর নির্যাতনসহ ধর্মীয় বিভিন্ন বিষয়ে অপব্যাখ্যা দিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি নিতে আগ্রহী করে তুলতেন। কুমিল্লা থেকে নিরুদ্দেশ তরুণরা উগ্রবাদের উদ্বুদ্ধ হওয়ার পর তাদের মাধ্যমেই ঘর ছাড়তে আগ্রহী হয়।

তারা সারাদেশে বাড়ি ছেড়ে যাওয়া সদস্যদের তাত্ত্বিক ও সশস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠানোর কার্যক্রম সমন্বয় করতেন। পটুয়াখালী, ভোলাসহ সমতলের বিভিন্ন এলাকায় প্রশিক্ষণ শেষে সদস্যরা তাদের সহযোগিতা ও তত্ত্বাবধানে কুমিল্লাতে তাদের সেইফ হাউসে অবস্থান করতেন।

পরে সুবিধাজনক সময়ে তারা নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় হিজরতকৃত সদস্যদের পর্যটক বা অন্যান্য ছদ্মবেশে পার্বত্য অঞ্চলে প্রশিক্ষণ শিবিরে পাঠাতেন। তারা গত মার্চ-এপ্রিলের দিকে ১৭ জন এবং সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে ১২ জন তরুণকে পর্যটকের ছদ্মবেশে বান্দরবানে পাঠিয়েছেন বলে জানা গেছে।

বান্দরবানের ভেতরের দিকে যেতে হলে এনআইডির প্রয়োজন হয়, এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, জঙ্গি সংগঠনটির নির্দেশনা অনুযায়ী সদস্যদেরকে ঘর ছাড়ার আগে সঙ্গে আসল জাতীয় পরিচয়-পত্র (এনআইডি) রাখতে বলা হয়েছে। এছাড়া, এনআইডির সকল কপি ধ্বংস করে দিতে বলা হয়েছে। সেক্ষেত্রে তারা সেখানে গেলে তাদের কাছে এনআইডি দেখতে চাওয়া হলে হয়তো ট্যুরিস্ট হিসেবে তারা সেটি দেখাতে পারে।

৬ ধাপে টার্গেট নির্ধারণ থেকে সংগঠনের সদস্য

সর্বশেষ গ্রেফতারদের কাছ থেকে সংগঠনের বিভিন্ন নির্দেশনা সম্বলিত দলিলাদি ও বই উদ্ধার করেছে র‌্যাব। এরমধ্যে একটি ট্রেনিং সিলেবাস পাওয়া গেছে, যেখানে সংগঠনের ট্রেনিংয়ের ধাপ বা মারহালা কী হবে উল্লেখ করা আছে।

র‌্যাব জানায়, সেখানে ৬টি মারহালার কথা সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে। প্রথমে টার্গেট নির্বাচন। এক্ষেত্রে ভীতু, কৃপণ, বাচাল, ঘরকোনো বা কোনো রাজনৈতিক সংগঠনে জড়িত এই পাঁচ শ্রেণির মানুষকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে।

এরপর সম্পর্ক যাচাইয়ের কথা বলা হয়েছে। যখন সদস্য সংগ্রহ করা হবে টার্গেট ব্যক্তির সঙ্গে সালাম দেওয়া, হাসিমুখে কথা বলা, প্রসংশা করাসহ হাদিসের বিভিন্ন কথা বলতে হবে।  

এরপর পর্যায়ক্রমে নানাভাবে ইমান নির্ধারণ, চিন্তার বীজ বপনের কথা বলা হয়েছে। ওপরের চারটি ধাপের পর ৫ম ধাপে সংগঠনের কাঠামো এবং কার্যক্রম সম্পর্কে জানানো এবং শেষধাপে জিহাদের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। যেখানে যুদ্ধের কৌশল হিসেবে তাত্বিক ও শারীরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে সংগঠনের আটটি সেক্টরের একটি সেক্টরে যোগ্য করে গড়ে তোলার প্রক্রিয়ার কথা বলা হয়েছে।

গাইডলাইন অনুযায়ী, নতুন এই জঙ্গি সংগঠনটিতে সৈনিক শাখা, হিজরত শাখা, আনসার শাখা, ডোনার শাখা, ওলামা শাখাসহ এমনকি মিডিয়া শাখার রূপরেখাও পাওয়া গেছে।

যেভাবে কথিত হিজরতে

 হিজরতের পরিস্থিতি ও প্রস্তুতি সম্পর্কে উদ্ধার আরেকটি বই প্রসঙ্গে র‌্যাব জানায়, হিজরতের ১ মাস আগে থেকে স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এবং বাসা থেকে বের হওয়ার সময় যেন কোনো যৌক্তিক কারণ দেখিয়ে বের হতে বলা হয়েছে। হিজরত চলাকালীন সময় কোনোধরনের ভিডিও-অডিও ফুটেজ বা কোনো ফুটপ্রিন্ট না থাকার বিষয়টি নিশ্চিতের পাশাপাশি ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোনো আইডি না থাকা, থাকলেও আইডি ডিলিট করতে বলা হয়েছে।

জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) থাকলে এর সকল কপি ধ্বংস করে শুধুমাত্র আসল এনআইডিটি সঙ্গে রাখতে বলা হয়েছে। দুর্গম এলাকায় হিজরত করতে হবে তাই স্বাস্থ্য চেকআপ করে প্রয়োজনে ওষুধ গ্রহণ শেষে যেতে বলা হয়েছে। এর বাইরে ২০ কেজি পর্যন্ত মালামাল বহনে সক্ষম এবং একটানা ৬-৮ ঘণ্টা কোনো ধরনের রসদ বা পানীয় ছাড়া হাঁটতে পারার কথাও রয়েছে নির্দেশনায়।

হিজরতকালীন সময়ে অভিজ্ঞ লোক সঙ্গে রাখা, হিজরতের সময় টিকে থাকতে কৃষিকাজ, ইলেক্ট্রিক কাজ, মিস্ত্রিসহ বিভিন্ন কারিগরী প্রশিক্ষণ নিতে বলা হয়েছে। সর্বশেষ হিজরতে বের হওয়ার পর পার্বত্য এলাকায় সংগঠনের নেতৃত্ব পর্যায়ের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ এবং কোথায় গিয়ে লিংক ‘কাটআপ’ হবে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়ার বিষয়টিও রয়েছে।

চার ভূমিতেই যুদ্ধের প্রস্তুতি

সংগঠনটির অপর একটি নির্দেশনা সম্বলিত বইয়ে বনভূমি, পাহাড়ভূমি, মরুভূমি ও জনভূমি এই চার ধরনের স্থানেই যুদ্ধের প্রস্তুতি রাখার কথা রয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে বনভূমিতে অবস্থান করে গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতির ওপর। কারণ তাদের মতে বনভূমিতে অবস্থান করলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পৌঁছানো কঠিন, স্যাটেলাইট বা ড্রোনের মাধ্যমেও ছবি পাওয়া কষ্টসাধ্য। এর বাইরে রসদ দিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দীর্ঘদিন বনভূমিতে অভিযান পরিচালনা করাও সহজ নয়, এজন্য এটি তাদের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত বলা হয়েছে।

পাহাড়ভূমিকে তাদের পরবর্তী উপযুক্ত স্থান বিবেচনায় সেখানে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কারণ তাদের মতামত, তারা যখন পাহাড়ের ওপরে অবস্থান করবে তখন শত্রুপক্ষ বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী নিচ থেকে ওপরে ওঠার সময় তাদেরকে ঘায়েল করা সহজ হবে। এমনকি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হেলিকপ্টারে এলেও সেটি ভূপাতিত করা যাবে।

মরুভূমিতে অবস্থান করে যুদ্ধ করা কষ্টসাধ্য হলেও আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে মরুভূমিতেও প্রশিক্ষণ নিতে বলা হয়েছে।

নির্দেশনা অনুযায়ী, সর্বশেষ জনভূমি বা যেখানে জনগণের সমাগম রয়েছে সেখানেও গেরিলা যুদ্ধ বা বিভিন্নভাবে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি নিতে হবে। সেখানে ছদ্মবেশে বা বিভিন্ন কৌশলে মানুষের সঙ্গে মিশে গিয়ে গেরিলা যুদ্ধ বা সাংগঠনিক কার্যক্রম বা নাশকতার প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য প্রশিক্ষণের কথা বলা হয়েছে।

হিজরতে যাওয়া সদস্যদের অবস্থান প্রসঙ্গে জানতে চাইলে খন্দকার আল মঈন বলেন, আমরা এখন পর্যন্ত ঘরছেড়ে যাওয়া যে ৫৫ জনের তালিকা সুনির্দিষ্টভাবে দিয়েছি, সেখান থেকে একজনকেও আটক করা সম্ভব হয়নি। তারা এখনো পার্বত্য চট্টগ্রামের ভেতরে আছেন, নাকি বিভিন্নভাবে বের হয়ে এসেছেন বিষয়টি নিশ্চিত নয়। পার্বত্য বনাঞ্চলে অরক্ষিত বর্ডারও রয়েছে অনেক। বিভিন্নভাবে তারা সেখানে অবস্থান করতে পারেন, তারা অন্য কোথাও চলেও যেতে পারেন। একইভাবে তারা ছদ্মবেশে বা কোনো উপায়ে পুনরায় সমতলে চলেও আসতে পারেন।

যে চারজনকে সর্বশেষ আটক করেছি তারা বিভিন্ন সময় এই পার্বত্য চট্টগ্রামে গহীন অঞ্চলে গিয়েছেন প্রশিক্ষণ নিয়ে পুনরায় তারা এসছেন। সোহেল এবং হানজালা সেখানে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধদের নিয়ে গেছেন, পৌঁছে দিয়ে আবার ফিরে এসেছেন।

বাংলাদেশ সময়: ১০৫২ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৫, ২০২২
পিএম/ এসআইএস
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।