ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

নিউইয়র্ক

ধপাস পতন আমেরিকার!

বিশেষ সংবাদদাতা | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯২৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ৯, ২০১৪
ধপাস পতন আমেরিকার!

ঢাকা: ধপাস পতন হলো আমেরিকার। বিশ্বে ‘এক নম্বর অর্থনীতি’ নয় আর তারা।

সব ধারণাকে পিছে ফেলে অনেক আগেভাগেই আমেরিকাকে টপকে গেছে কমিউনিস্ট চীন। ১৪২ বছর পর পশ্চিমের দেশ যুক্তরাষ্ট্র তার শীর্ষ অবস্থানটি হারালো পুবের দেশ চীনের কাছে। এর মধ্য দিয়ে পাশ্চাত্য তার প্রতিপত্তি ও জৌলুস হারালো। আর পুবে উঁকি দিলো অর্থনীতির নতুন এক সূর্যালোক।

১৮৭২ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রই ছিলো বিশ্বসেরা অর্থনীতি। কিন্তু ২০১৪ সালে এসে চীনের অর্থনীতি আজ ১৭.৬ ট্রিলিয়ন ডলারের। আর সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ১৭.৪ ট্রিলিয়ন ডলারের। খোদ আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) এই তথ্য দিচ্ছে।

আইএমএফ’র নতুন হিসাবে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের পর তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে দেখানো হচ্ছে ভারতকে। এরপর চতুর্থ জাপান, পঞ্চম জার্মানি। পরে যথাক্রমে রয়েছে রাশিয়া, ব্রাজিল, ফ্রান্স, ইন্দোনেশিয়া। আর সেরা দশের শেষ নামটি যুক্তরাজ্য।

১৮৭২ সালে এই যুক্তরাজ্যকে পেছনে ফেলেই শীর্ষে অবস্থান নিয়েছিলো যুক্তরাষ্ট্র।

সাম্প্রতিক বছরগুলো ধরে চীনের অর্থনীতি ধাই ধাই করে অগ্রগতির পথে রয়েছে। তাদের যেমন বাড়ছে শিল্পায়ন, তেমনি অন্যান্য খাতেও এগিয়ে যাচ্ছে। আর ধারণাই করা হচ্ছিলো চীনই হতে যাচ্ছে বিশ্বের সেরা অর্থনীতি। তেমনটাই হলো। আইএমএফ’র হিসাবমতে, ২০১৯ সালের মধ্যে দেশটির অর্থনীতির মোট আকার দাঁড়াবে ২৬.৮ ট্রিলিয়ন ডলারের। আর ততদিনে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ২২.১ ট্রিলিয়নের ওপরে উঠবে না। আর তখন চীন চলে যাবে ধরা-ছোঁয়ার সম্পূর্ণ বাইরে। যুক্তরাষ্ট্র চীনের চেয়ে পিছিয়ে পড়বে অন্তত ২০ভাগ।

জনগোষ্ঠীর ক্রয়ক্ষমতা দিয়ে মাপা হচ্ছে এই অর্থনীতির শক্তি। আর দেখা যাচ্ছে দ্রব্যমূল্য আজ যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে চীনেই সস্তা। আর সেই সব হিসেব কষেই চীনকে উপরে তুলে দিচ্ছে আইএমএফ।
 


সহজ যুক্তি। সব দেশে দ্রব্যের দাম সমান হবে না- একটি শার্ট সাংহাইতে যে দামে মিলবে সে দামে পাওয়া যাবে না সান ফ্রান্সিসকোতে। আর সে কারণে দেখতে হবে ক্রেতার ক্রয়ক্ষমতা। ডলারের হিসাবে চীনের একজন সাধারণ মানুষ যত আয় করবে তার চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একজন হয়তো বেশিই করবে। কিন্তু এই আয় দিয়ে যখন কি কেনা যায় কতটুকু কেনা যায় তার হিসাব কষা হবে তখনই বের হয়ে আসবে দেশটির অর্থনৈতিক শক্তি।

অর্থনীতির এই জটিল হিসাব কষেছে আইএমএফ। তারা দুই দেশেরই বাজারদরের সঙ্গে ক্রয়ক্ষমতার সামঞ্জস্য টেনে তার ভিত্তিতে জিডিপি মেপে দেখেছে। আর বলে দিয়েছে, ২০১৪ সালের শেষ নাগাদ এসে বিশ্বের ১৬.৪৮ শতাংশ ক্রয়ক্ষমতা একা চীনের দখলে গেছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের দখলে রয়েছে ১৬.২৮ শতাংশ।

তবে জীবনযাত্রার মূল্য ও মানের সার্বিক বিচারে যুক্তরাষ্ট্র এখনো বিশাল ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপি ১৭.৪ ট্রিলিয়ন ডলারের সেখানে চীনের ১০.৪ ট্রিলিয়ন ডলার। মূদ্রার মানেরও বৃহত্তম ভাগের অধিকারী যুক্তরাষ্ট্র।    

এর পরেও অর্থনীতিবিদরা এই সময়টিকে বিশ্ব অর্থনীতির জন্য একটি প্রতিকী বলে উল্লেখ করেছেন।

বিশ্বমন্দার আগে তিন দশক ধরেই চীন দুই অংকের প্রবৃদ্ধির হার গুনে আসছিলো। শিল্পায়ন আর অব্যাহত অর্থনৈতিক সংস্কার দেশটিকে পূবের একটি পাওয়ার হাউজে পরিণত করেছিলো। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রবৃদ্ধি কিছুটা শ্লথ হয়ে আসে। তবে পশ্চিমের চেয়ে তা শক্তিশালী ছিলো সবসময়ই। আইএমএফ চীনে এই প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ২০১৪ সালের জন্য ৭.৪ এবং ২০১৫ সালের জন্য ৭.১ শতাংশ ধরে রেখেছে। পক্ষান্তরে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য তা যথাক্রমে ২.২ এবং ৩.১ শতাংশ মাত্র। পশ্চিমা আরেক শক্তিশালী দেশ যুক্তরাজ্যের জন্য এই প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে যথাক্রমে ৩.২ ও ২.৭ শতাংশ।

আইএমএফ বলছে, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য কিছুটা হলেও অর্থনীতিতে এগিয়ে যেতে শুরু করেছে। কিন্তু নতুন শতাব্দীর প্রথম দশকে যেমনটি ছিলো সেখানে পৌঁছাতে পারছে না।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য খবর যে পুরোটাই খারাপ তা নয়। ক্রয়ক্ষমতার এই হিসাব নিকেশকে বাদ দিলে যুক্তরাষ্ট্র এখনো অনেক এগিয়ে। সেই হিসাবে চীনের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি এখনো অন্তত ৬.৫ ট্রিলিয়ন ডলার বড়। আর সে বিশাল ব্যবধান ঘোচাতে চীনের ম্যালা সময়ই লাগবে।  

একটু পেছনে ফিরে তাকানো যাক। আঠারো শতকের মাঝের দিকের কথা। শিল্প বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সেসময় ব্রিটেন বিশ্ব অর্থনীতির নেতৃত্ব নিয়ে নেয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তখনই মাথাচাড়া দিতে শুরু করেছে। গৃহযুদ্ধের সফল অবসানের পর ১৮৬৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র ব্যাপক শিল্পায়ন ঘটায়। একই সঙ্গে চলতে থাকে দ্রুত শহরায়ন আর জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রকল্পগুলো। সবচেয়ে বড় উদ্যোগটি ছিলো অভিবাসন। যার মাধ্যমে তিন কোটি ইউরোপীয়কে যুক্তরাষ্ট্র তার নিজভূমিতে স্থান দেয়। ১৮৭২ সালে এসে যায় সেই কাঙ্ক্ষিত দিন। ওই বছর বিশ্বের এক নম্বর অর্থনীতি হয়ে ওঠে যুক্তরাষ্ট্র। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকায় নি প্রায় দেড় শতাব্দীকাল।

উৎপাদনশীলতা, বিশ্বসেরা ব্র্যান্ডগুলোর জন্ম দেওয়া, অভিনব সব উদ্ভাবন আমেরিকাকে এক পর্যায়ে বিশ্বের মোট অর্থনৈতিক মজুদের ৬২ ভাগের মালিক করে তোলে। আর তা দেশটিকে শীর্ষে ধরে রাখে দশকের পর দশক ধরে।

এর মধ্যে ব্রিটেনসহ ইউরোপের অন্য বড় শক্তিগুলোতে ধস আসে দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধের কারণে। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে ব্রিটেন। পরে ১৯৪৫ সালে আরও ৪.৩ বিলিয়ন ডলার ধার করে বসে।

আর যদি আরও একটু পেছনে দেখা যায় তাহলে বলা যাবে, চীন আসলে তার হারানো গৌরবই ফিরে পেলো। আঠারো শতকে দেশটির বন্দর আর বাণিজ্যগুলো ইউরোপীয়রা দখলে নিয়ে নেওয়ার আগে চীনই ছিলো বিশ্বের সেরা বেনিয়া দেশ। পরে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত কমিউনিস্টদের হাতে পরিচালিত চীন অন্তর্মুখীই থেকে গেছে। তবে ওই বছরই চীন সরকার বিদেশে বিনিয়োগে অনুমতি দেয়। এরপর থেকে চীনের অর্থনীতি বড় থেকে আরও বড় হতে থাকে। আর সেই পথ ধরে ১৪২ বছর পর ইতিহাস নতুন করে রচিত হলো।

বাংলাদেশ সময় ১৯২৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৯, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

নিউইয়র্ক এর সর্বশেষ