২৯ মার্চের হরতাল প্রত্যাহার করে ইতিবাচক রাজনীতির দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছিল বিএনপি। লাঙ্গলবন্দের পুণ্যস্নান আর ধর্মীয় কর্মসূচির কথা বলা হলেও ওয়াকিফহালরা জানেন, হরতাল যেদেশের মানুষ পছন্দ করে না তা অনুধাবন করেই সিদ্ধান্তটি নিয়েছেন বিএনপির চেয়ারপার্সন ও বিরোধীদলের নেতা খালেদা জিয়া।
বাবু গয়শ্বর চন্দ্র রায়’কে দিয়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের একটি প্রতিনিধিদলকে ম্যাডাম খালেদার সঙ্গে সাক্ষাৎ আর তাদের দিয়ে অনুরোধ করানোর ব্যবস্থা করানো হয়। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের প্রতি সহানুভূতিশীল-শ্রদ্ধাশীল ‘ইতি ম্যাডামে’র ওপর খুশি হয়ে তারা নিশ্চয় পুণ্যস্নানে নেমে তার জন্য প্রার্থনাও করেছেন। কিন্তু সেই পুণ্য কী অবশেষে জলে গেল? বৃহস্পতিবার আবার সংসদে যাওয়া বন্ধ করে দেয় বিএনপি। তাও আবার অধিবেশনের শেষদিনটিতে! কী কারণে সংসদে তারা যাচ্ছেন না তা সংসদে নয়, বলা হয়েছে প্রেসক্লাবের সামনে রাজপথে। সংসদে চিহ্নিত সমস্যাগুলো সংসদে দাঁড়িয়ে বলে স্পিকারের কাছে প্রতিকার চাইলে তা হরতাল প্রত্যাহারের মতো আরেকটি ইতিবাচক কাজ হতো। স্পিকার যদি তাদের যৌক্তিক বক্তব্যকে আমল না নিতেন তাহলে বিএনপির সঙ্গে স্পিকারের নিন্দা করতো দেশের মানুষও। কিন্তু সংসদ বর্জনের মতো একটি নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নেবার আগে সে চেষ্টাটিও করা হলো না! যারা খালেদা জিয়াকে সিদ্ধান্তটি দিয়েছেন, তারা ঠিক কাজটি করেন নি। এর জন্যে কিন্তু তাদেরকেও ভবিষ্যতে পস্তাতে হবে। যেমন আজ পস্তাচ্ছে আওয়ামী লীগ!
সেই ১৯৯১ সালে দেশের দুই নেতার ‘রাজত্বের’ শুরু থেকে ইনারা দেশের গণতন্ত্রের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও যে যখন বিরোধীদলে যান, নানা বাহানায় তিনি আর সংসদে যান না। যেন আল্লাহপাক প্রধানমন্ত্রিত্বের ক্ষমতার মসনদটি শুধু তাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন! বিরোধীদলের নেতার আসনটি এরা রাগ করে দলের আর কারও হাতে ছাড়েনও না বা হালাল করেন না! এভাবে প্রতিবার একেকজন নির্বাচনে হারার পর ‘সংসদীয় বিরোধীদলীয় রাজনীতি, বাংলাদেশ স্টাইল’ জাতীয় মুখস্ত একটি রাজনৈতিক ধারাপাত অথবা ‘স্বরচিত এথিক্স’ও চালু করেছেন! যেমন, ইনাদের এথিক্সটি হলো যিনি যখন নির্বাচনে জেতেন, তখন তার কাছে সে নির্বাচন ঐতিহাসিক গণরায়, অবাধ আর নিরপেক্ষ মনে হয়! হারলে সেটি মনে হয় সুক্ষ্ণ অথবা ডিজিটাল কারচুপি! শুধু যেন মনে হয়, প্রতিপক্ষ আইএসআই’র বা র’র টাকা খেয়ে নির্বাচন করেছেন, জিতেছেন! দেশের কোনো মানুষ ভোট দেয়নি বা সেদিন কেউ ভোটকেন্দ্রে যায়ওনি! ভোটের দিন যে কোটি কোটি মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দিয়ে গেল, হেরে গেলে মনে হয়, তারা আসলে দেশের মানুষ ছিলো না! আইএসআই অথবা র’র জ্বীন ছিল! এরা জনগণের ভোট উল্টে দিয়েছে বলেই বুঝিবা তিনি আর প্রধানমন্ত্রী- সংসদনেতা হতে পারেন নি!
সেই ১৯৯১ থেকে প্রতিটি নির্বাচনের পর এভাবে গণরায়কে কারচুপির অপবাদের এসিডে ঝলসে দিয়েছেন আমাদের দুই নেত্রী আর তাদের চেলাচামুন্ডা গং! মজার ব্যাপার প্রতিবার এভাবে একজন হারার পর পূর্বাণী অথবা সোনারগাঁও হোটেলের প্রেস কনফারেন্সে কারচুপির অভিযোগ করলেও তারা কিন্তু পুরো ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেন না; বিরোধীদলের নেতা হিসাবে শপথ গ্রহণ আর সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে কখনো ভুল করেন না! এরপর নানা বাহানায় সংসদ বর্জন, আবার ৯০ দিনের হিসাব করে একদিন সংসদে চলে গিয়ে আবার বেতন-ভাতার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নির্লজ্জ্ ধারাবাহিকতা চালিয়েই যাচ্ছেন! এটি বিরোধীদলের নেতা থাকা অবস্থায় শেখ হাসিনাও করেছেন। এখন করছেন খালেদা জিয়া। এভাবে দুই নেত্রীর পালাক্রমে সংসদ বর্জন আর বেতন-ভাতা সুযোগ সুবিধা ভোগ করার নির্লজ্জ ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্র কার্যত অকার্যকর! এভাবে জনগণের সঙ্গে ধারাবাহিক মিথ্যাচার আর ক্ষমতার দাম্ভিকতার পরিণামে একবার ১/১১ এনে দু’জন গ্রেফতার হয়েও তাদের হুঁশ হয়নি! শেখ হাসিনা মুখে যাই বলুন না কেন বিরোধীদল সংসদে না থাকলে কেমন লাগে তা তা ঠিকই টের পান। সে কারণে বিরোধীদল সংসদে না থাকলে তাদের বারবার করে আসতে বলেন। বিরোধীদল কী কারণে সংসদ থেকে বেরিয়ে যেতে পারে, এটি নিজের অভিজ্ঞতায় জেনেও সে রকম বুঝেশুনে চলেন না। বুঝেশুনে কথা বলেন না। খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থাকতেও একই ভুল করতেন। এখন যে ভুল করছেন, এর পরিণামও আগামীতে ক্ষমতায় গেলে টের পাবেন। কারণ বিরোধীদলের নেত্রী হিসাবে সংসদে থেকে গরিব জনগণের টাকা হালাল করে খাওয়ার কোনো ইতিবাচক সংস্কৃতি তিনি এখন তৈরি করছেন না।
বিরোধীদলের চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক প্রেসক্লাবের সামনের এক সমাবেশে বলেছেন, সংসদনেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর ধন্যবাদ প্রস্তাবের বক্তব্যে আইএসআই’র টাকা নিয়ে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান সম্পর্কে অসত্য বক্তব্য রেখেছেন। এসব বক্তব্য সংসদের কার্য বিবরণী থেকে এক্সপাঞ্জ না করা পর্যন্ত সংসদে যাবেন না। বিরোধীদল কী এসব বক্তব্য সংসদে গিয়ে বলতে পারতো না? তারা তো ক্ষমতায় ছিলেন এবং হয়তো আগামীতেও যাবেন। স্পিকার কি পত্রিকা পড়ে তাদের দাবিমতো কিছু এক্সপাঞ্জ করতে পারেন? না করা উচিত? সংসদে ফিরে তাদের দুই সংরক্ষিত আসনের নারী এমপি যে কী সব ভাষা ব্যবহার করেছেন, আর তারা টেবিল চাপড়েছেন, এসবের পরিণতি দেশকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে তা কী ভেবেছেন? সংসদে না যাবার সিদ্ধান্তের সঙ্গে যদি আরেকটি ঘোষণা দিতে পারতেন যে, যখন তারা সংসদে যাবেন না, তখন আর নানা বাহানায় হারাম খাবেন না, অর্থাৎ সংসদের বেতন-ভাতা সহ কোন সুবিধা নেবেন না, বরং সংসদে না গিয়ে এর আগে যা যা নিয়েছেন, তা সবই ফেরত দেবেন। এমন ঘোষনা দিলে কিন্তু তা শুধু ইতিবাচকই নয়, ঐতিহাসিক হয়ে যেত! আওয়ামী লীগ আগামীতে বিরোধীদলে গেলে সংসদ বর্জন নিয়ে বিপদে পড়তো। ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গেলে শান্তিতে থাকার কোনো ফর্মূলা কি জাতির সামনে তারা রাখতে পারছেন?
সরকার এত হাজার হাজার মেগাওয়াট নতুন বিদ্যুতের ব্যবস্থার কথা বলছে, এরপরও লোডশেডিং’এর যে কোনো কুলকিনারা হচ্ছে না, আবার বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কথা সংসদে দাঁড়িয়ে বললে ভালো হতো না? সরকারি দলকে বলছি, বিরোধীদল সংসদে আসে কীনা এটা দেখার জন্যেই কী বৃহস্পতিবারের বৈঠক রাখা হয়েছিল? বিরোধীদল আসছে না দেখেই কী অধিবেশন বৃহস্পতিবারই শেষ করে দেবার সিদ্ধান্ত হয়েছে? সংসদ নিয়ে এসব চালাকি করা হয়ে থাকলে কিন্তু এর ফল ভালো হবার কথা নয়! এত মানুষের রক্তের অক্ষরে কেনা গণতন্ত্রের আন্দোলন, এমন একটি অস্বাভাবিক সংসদ টেকে কী করে, যে সংসদে সংসদনেতা, বিরোধীদলের নেতার মধ্যে সৌজন্যের মুখ দেখাদেখি বা হাই-হ্যালোর সম্পর্ক পর্যন্ত নেই? এরা ঈদে-নববর্ষে একজন-আরেকজনের সঙ্গে দেখা হবে না জেনেই লোক দেখানো কার্ড পাঠান, ইফতারের দাওয়াতে যাবেন না জেনেই দাওয়াত দেন, বিরোধীদলের নেতা দেশের জাতীয় ক্রিকেট দলের ফাইন্যাল খেলা দেখতে স্টেডিয়ামে গেলে সংসদনেতা উপহাস করে বলেন, তিনি আরেক দেশের সমর্থনে মাঠে গিয়েছিলেন! এভাবে কী এই সংসদীয় গণতন্ত্র অথবা তাদের আজীবন নেতৃত্ব বেশিদিন টিকবে মনে করা হচ্ছে? এরা এমন গণতন্ত্রী(!) যে, ক্ষমতায় গেলেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার আর পছন্দ করেন না, অসাংবিধানিক মনে করেন; বিরোধীদলে গেলেই শুধু তত্ত্বাবধায়ক শব্দটি সাংবিধানিক আর সুমধুর মনে হয়! কিন্তু এই রোগের স্থায়ী দাওয়াইটাই বা কী?
খালেদা জিয়ার অঘোষিত উপদেষ্টা কাম ভবিষ্যতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইচ্ছুক শফিক রেহমান যে বলেছেন, শেখ হাসিনার পরিণতি পচাত্তরের চাইতে খারাপ হবে, এর মানে কী পচাত্তরের হত্যাকান্ডের চেয়েও খারাপভাবে মারা হবে শেখ হাসিনাকে! বা একুশ আগস্টের গ্রেনেড অ্যাটাকটি মিস হয়ে যাওয়াতেই আজ শত আফসোস? তেমন অভিযানে ভবিষ্যতে সফল হয়ে গেলে তারাই যে ক্ষমতা পেয়ে যাবেন, এই গ্যারান্টি কে তাকে দিয়েছে? গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বিপন্ন হলে দলীয় রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতায় রেখে কী ক্ষমতায় থাকতে পেরেছিল বিএনপি? নাকি আগামীতে পারবে? শেখ হাসিনার অনির্বাচিত উপদেষ্টাদের কারণে দেশ আজ অনেক নেতিবাচক বিষয় টের পাচ্ছে। শফিক রেহমানের অনুষ্ঠানে বাধাদাতারা কিন্তু তার জাতও দেশের মানুষকে নতুন করে চিনিয়েছেন! প্রকাশ পেয়ে গেছে যে, খালেদা জিয়ার এই রেহমান জাতীয় উপদেষ্টারা নির্বাচনের মাধ্যমে নয়, পচাত্তরের চাইতে খারাপভাবে শেখ হাসিনাকে কতল করার তথা উৎখাত করার পক্ষে! এমন দুষ্ট লোকদের দুর্যোগ থেকে দেশকে বাঁচাতে পারে শুধু দুইদলের নেতৃ্ত্বে-কর্তৃত্বে শুভবাদী রাজনীতিকদের প্রাধান্য ও একটি কার্যকর সংসদ। কিন্তু প্রধান দুটি দলেই এখন তা অনুপস্থিত! এই সংসদ, সংসদীয় গণতন্ত্রকে বাঁচাতে দেশের মানুষের সামনে আমাদের এই দুই আজীবন-নেত্রীর কার্যকর ইতিবাচক কোনো ফর্মূলাও নেই। নেতিবাচক ম্যাডাম আর আপা, আপনারা কোথায় হাঁটা দিয়েছেন জানেন কী?
ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর।