সময় পেলেই আশেপাশের কিছু কাউন্সিল-লাইব্রেরিতে ঢুঁ মারা আমার একটা শখ। প্রায় সময়ই সঙ্গে আমার ছোট্ট কন্যাটি থাকে।
বৃহস্পতিবার একটা কাজে আমার বন্ধু এবং এক সময়ে আমার শিক্ষাকালীন প্লেসমেন্ট সুপারভাইজারের অফিসে দেখা করতে গেলাম। যাওয়াটা হঠাৎ করেই। গিয়ে দেখি তার একটা অ্যাপয়নমেন্ট আছে। কী করে যে ১টা ঘণ্টা কাটানো যায়!রাস্তা পেরিয়ে চলে গেলাম সেখানকার কাউন্সিল-লাইব্রেরিতে। গিয়ে বেশ অবাকই হলাম! বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ভাষার বই, মুভি এবং আরো অনেক কিছু। সাধারণতঃ বেশিরভাগ লাইব্রেরিতেই খুব বেশি ভাষার সংগ্রহ থাকে না। কিন্তু এখানে অনেক, অনেক ভাষার সংগ্রহ। বাংলা অস্ট্রেলিয়ার কম্যুনিটি ল্যাংগুয়েজ হিসেবে স্বীকৃত গুটিকয় ভাষার একটি। ভাষার টানে খুঁজতে লাগলাম বইয়ের সারির শুরুতে কোথায় ‘বাংলা’ কথাটা লেখা আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পেয়ে গেলাম। গিয়ে দেখলাম, সেখানে বাংলা আছে, কিন্তু বাংলাদেশ নেই। বই, মুভি আর গানের সিডি সবই কোলকাতার। বাংলা দেখে খুশি হলেও পুরোটা হতে পারলাম না। ভাষা এখানে শুধু ভাষাভাষীর নয়; একটা দেশের প্রতিনিধিত্বও করে। সেই হিসেবে বাংলাকে কেন্দ্র করে যে বাংলাদেশ তার ঠিকানা কোথায় এই লাইব্রেরিতে? বাংলাকে বাঁচিয়ে রাখতে জীবন দিয়েছে যেখানকার মানুষ, সেই ভুখণ্ডের কোনো লেখকের কোনো লেখা বই নেই। কী আশ্চর্য!
ছুটে গেলাম ফ্রন্ট ডেস্কে। বললাম, আমার কিছু মতামত এবং কথা ছিল। দয়া করে কারো সংগে কি কথা বলতে পারি। বিষয়টা বলতেই তিনি সেই নির্দিষ্ট দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিটিকে ফোন করলেন। ভদ্রলোক আসতেই তাকে সব খুলে বললাম। আমার উৎকন্ঠাকে সম্মান দেখিয়ে তিনি বললেন, এর আগেও আমার মতো কিছু বাংলাদেশি একই মতামত প্রকাশ করেছেন। তার ভিত্তিতে কিছুদিন হলো লাইব্রেরি কিছু বই কিনে সেগুলো আলাদা সেলফে সাজিয়ে রেখেছে। আমাকে নিয়ে সেগুলো দেখালেন। বললাম, বাংলা লেখা কর্নারে বাংলাদেশের কোনো বই নেই। অথচ তোমরা আলাদা করে যেখানে বাংলাদেশের বইগুলো রেখেছো, সেখান থেকে খুঁজে বের করা খুবই কঠিন। তাছাড়া এখানে বাংলাদেশের কোনো ডিভিডি কিংবা সিডিও দেখছি না। বাংলাদেশকে পরিচিত করাতে হলে তোমাদের তো অন্ততঃ কিছু ডকুমেন্টারি রাখতে হবে। আরো বললাম, তুমি বাংলাদেশি যে লেখকদের লেখা বই রেখেছো, এদের মধ্যে খুব সামান্য সংখ্যকই পাঠকের পরিচিত। বইগুলোরও তেমন কোনো পাঠকস্বীকৃতি নেই। বাংলাদেশে অনেক ভাল ভাল লেখক আছেন যাদের অনেক সুন্দর সুন্দর বই আছে। বইগুলো তোমরা নির্বাচন করলে কি করে?
তার উত্তরটা ছিল হতাশাজনক। উনি বললেন যে, প্রতিটা শহরে সাধারণতঃ বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিজস্ব কম্যুনিটি থাকে। তারাই এসব ব্যাপারে সবাইকে সাহায্য করে। হঠাৎ তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের কি এখানে তেমন কম্যুনিটি নেই?
কী করে বলি যে, এ শহরে (অ্যাডিলেইড) বাংলাদেশিদের সংখ্যা যতোই নগণ্য হোক, কম্যুনিটির সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। বাংলাদেশিদের তিন তিনটা কম্যুনিটি। দুটো কম্যুনিটি খুবই কাছাকাছি দূরত্বে এবং আজ থেকে বেশ কয়েক বছর আগের কোন্দল থেকে সৃষ্ট। তৃতীয়টার সৃষ্টিও ওই কোন্দল থেকেই। বাংলাদেশ এবং পশ্চিম বাংলার হিন্দু কম্যুনিটির জন্য ছিল একটা কম্যুনিটি। সেখানেও কিছুদিন হলো ভাগাভাগি হয়ে দুই বাংলা আলাদা হয়ে গেছে।
নিজেদের দুর্বলতা তো সব জায়গায়, সবার কাছে বলা যায় না। বাংলাদেশের কম্যুনিটি থাকে পারস্পরিক রাজনীতিতে ব্যস্ত---কে কোন স্বদেশিকে নিজের দলে বাগিয়ে দল ভারী করবে সেই প্রতিযোগিতায়। তাদের কি আর এসব ফালতু কাজে সময় দেবার সময় আছে!
মূল কথায় ফিরছি। লাইব্রেরীর ঐ ব্যক্তি তখন আমাকে বললেন, বাংলাদেশের বইগুলো তারা কিনেছেন সাপ্লায়ারের মাধ্যমে। বাংলাদেশের সাহিত্য কিংবা মুভি সম্পর্কে যেহেতু তাদের কোনো ধারণা নেই এবং কোনো বাংলাদেশি কম্যুনিটি যেহেতু তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেনি, তাই সাপ্লায়াররা যেভাবে দিয়েছে, তারা সেভাবেই কিনেছে। কিন্তু সাপ্লায়ারের মাধ্যমে কিনতে যাওয়ায় অন্য কি যেন ঝামেলা আছে! তাই বই কেনার পরে এখন থেকে তারা সরাসরি কিনতে চান বাকি সব কিছু ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে। লাইব্রেরির পক্ষ থেকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ই-বাজার থেকে বাংদেশের মুভি কেনার জন্য চেষ্টা করছেন। কিন্তু সে রকম কোনো ই-বাজার তারা খুঁজে পান নি। আমাকে তিনি তার ফোন নাম্বার এবং ই মেইল অ্যাড্রেস দিয়ে বলেছেন, আমি যদি খোঁজ পাই তাহলে যেন তাকে দিই। লাইব্রেরি সরাসরি ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে মুভি, গানের সিডি কিংবা ভবিষ্যতে আরো বই কিনতে চায়।
আমার কাছে সেই মুহুর্তে কোনো লিঙ্ক জানা ছিল না। সময় করে খুঁজে দেখব কিংবা বন্ধুদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলে এলাম।
আমি এখনো খুঁজছি। পাঠকের কাছে কোনো লিঙ্ক থাকলেও সেটা আমাকে দিতে পারেন। খুবই ভাল লেগেছে ভদ্রলোকের একটা কথা শুনে। ওনাকে ফোনে জানানো হয়েছিল যে, আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। দোতলা থেকে নেমেই হ্যান্ডশেক করতে করতে বললেন ‘ইউ প্লেইড ভেরি ওয়েল ক্রিকেট! ইউ বিট ইন্ডিয়া, শ্রীলংকা অ্যান্ড নিয়ারলি বিট পাকিস্তান। ওয়েল ডান!”
গর্বে মনে হচ্ছিল গায়ের জামাটা বুকের ফুলে ওঠা ছাতির চাপে ছিঁড়ে যাচ্ছে।
ভাগ্যিস, ছোট্ট শহর অ্যাডিলেইডেই যে তিন তিনটে বাংলাদেশি কম্যুনিটি আছে সে বিষয়ে ভদ্রলোকের কোনো ধারণা নেই।
এবার কৌতুক নয়। একটা ধাঁধা।
কোথাও দু’জন বাঙালি থাকলে কি হয়?
ক্রিকেট?
উহু!
ফুটবল?
উহু!
গল্প?
গল্পতো বটেই! তবে তিনটা দল হয়। দু’জনে আলাদা আলাদা দুটো দল এবং দুজন মিলে তৃতীয় দল। অন্ততঃ দেশে এবং দেশের বাইরের অভিজ্ঞতা সেটাই বলে।
তবে এগুলো পুরনো গল্প। নতুন প্রজন্মের সন্তানেরা আমাদের মতো মধ্য প্রজন্ম কিংবা আগের প্রজন্ম থেকে অনেক ভিন্ন হবে বলেই মনে হয়। এরই মধ্যে তাদের চেতনার প্রকাশ সেই ইতিবাচক পরিবর্তনের কথাই জানান দিচ্ছে। এইতো ঘন্টাখানেক আগে হবে। ফেইসবুকে এক বন্ধুর একটা পোস্টিং দেখে ঘুঁ মারলাম সেখানে। ক্যাডেট কলেজ ব্লগে রেজা শাওন নামের এই প্রজম্মের একজন এক মুক্তিযোদ্ধার কথা লিখেছেন। মোমেন নামের একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার কথা। লেখাটা মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়তে থাকলাম। শেষটায় এসে থমকে গেলাম। মনে হলো, খানিকটা সময়ের জন্য আমার অনুভূতির একটা বিশাল অংশ শাওন কেড়ে নিয়েছেন তার লেখার মধ্য দিয়ে। শাওন লিখেছেন:
‘‘আমার খুব ভাবতে ইচ্ছে করে প্রবল বর্ষার কোনো এক দিনে করতোয়ার উপরের রেলসেতুটা ধরে হেঁটে হেঁটে মোমেন বাড়ি ফিরছে। চলন বিলের ভেজা বাতাস বার বার মোমেনের চুল এলোমেলো করে দিচ্ছে। সূর্যকে ছুঁয়ে বাড়ি ফেরা মোমেনরা আজ বড় ক্লান্ত। ”
শাওন, আপনার রাজনৈতিক পরিচয় কি আমি জানতে চাই না। গণতান্ত্রিক দেশে একটা মানুষ যে কোনো গণতান্ত্রিক মতাদর্শে বিশ্বাসী হতেই পারে। কিন্তু আমাদের অস্তিত্বের যে জায়গা সেখানে কোনো বিভেদ অমার্জনীয়। শাওন, আপনার বর্ণিত শহীদ মোমেন আর কোনদিনও ফিরবে না। কিন্তু আমি দিব্যি দেখতে পারছি, এ প্রজন্মের কোটি কোটি মোমেনের হাতের ছোঁয়ায় আমাদের দেশ আবারো ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। একটা যুদ্ধের জন্য। সেই যুদ্ধ হচ্ছে, ক্ষুধা-দরিদ্রতার বিরুদ্ধে, সামাজিক অসমতার বিরুদ্ধে। আজকের মোমেনদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বাইরেও বিশ্বকে জানান দেবে। শুধু ক্রিকেটে নয়, জীবনের সবখানেই আমরা সাকিব, আমরা তামিম!
সেদিন লাইব্রেরির সেই ভদ্রলোককেও কষ্ট করে বাংলাদেশের মুভি কিনতে আমার মতো মানুষকে অনুরোধ করতে হবে না। বাইরের সবাই বুঝবে, বাংলা আর বাংলাদেশ এক হয়েও আলাদা। তাই লাইব্রেরিতে বাংলা বই যেমন থাকবে, ঠিক তেমনি বাংলাদেশের বইও থাকবে।
mahalom72@yahoo.com
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর।