১৯৮৭ সালের এপ্রিলে কাকতালীয়ভাবে মিনার মাহমুদের সঙ্গে পরিচয় হয়। আঠার মাসে সারাদেশ পায়ে হেঁটে ঢাকা এসেছি।
সেখানে আড্ডা দিতে এসেছিলেন মিনার মাহমুদ। কিন্তু আমি তাকে চিনি না। আড্ডার ফাঁকে তিনি আমাকে বাইরে ডেকে নিয়ে যান। পরিচয় দিয়ে বলেন, `আমি মিনার মাহমুদ। আমাকে চেনেন?` মুখের ওপর জবাব দিয়ে বলি, `না। ` কিন্তু এতে তার কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না। নিজে নিজে বলেন, `আমি এক সময় বিচিত্রায় কাজ করতাম। এখন করছি না। বেকার। ` একটা ঠিকানা দিয়ে বলেন, `কাল সকালে এ ঠিকানায় চলে আসুন। আপনার সঙ্গে কথা বলবো। `
পরের সকালে আটটার মধ্যে ৪১/২ দিলু রোডের বাসায় গিয়ে হাজির। গ্রাউন্ড ফ্লোরে গাড়ি বারান্দার সঙ্গে ছোট দু’রুমের বাসা। আমি বেডরুমের দরজাতেই নক করেছি। আরেক পাশে যে আরেকটা দরজা আছে জানি না। ঘুম ঘুম একজন সুন্দরী নারী দরজা খুলে দাঁড়ালেন। মিনার ভাই আসতে বলেছেন বলায় তিনি বলেন, `আপনি ওপাশের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ান। আমি খুলে দিচ্ছি। ` ইনি কবিতা ভাবী। মিনার মাহমুদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রেম। প্রথম স্ত্রী। ওপাশের দরজায় ঢুকতেই দেখি, শুয়ে আছেন মিনার মাহমুদ। আমাকে বলেন, `রাতে আমার ভালো ঘুম হয়নি। আপনি বসে পেপার পড়ুন। আমি একটু ঘুমিয়ে নিই। ` তাই করতে থাকি। আমার চাই ঢাকায় একটু কদর। এই লোকটাতো অন্তত যেচে আমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছেন।
ঘুম শেষ হয় মিনার মাহমুদের। আমাকে বলেন, `আমি `বিচিন্তা` নামের একটা পত্রিকার ডিক্লারেশনের জন্য আবেদন করেছিলাম। ডিক্লারেশন পাচ্ছি না। আমি হতাশ। আপনাকে দেখে একটা আইডিয়া মাথায় আসলো। আমরা বিচিন্তা নিউজ এজেন্সি নামের একটা বার্তা সংস্থার কাজ শুরু করতে পারি। সেখানে আপনার সারাদেশের কালেকশন আমরা বিক্রি করবো। জমবে ভালো। আপনি কী আমার সঙ্গে কাজ করতে রাজি?`
মাথা নেড়ে বলি, `হ্যাঁ। ` এরপর বলেন, `আচ্ছা বলেনতো এখন আপনার ঢাকা শহরে থাকা-খাওয়ার জন্য কতো টাকা লাগবে? বুয়েটের স্টাফ কোয়ার্টারে পেয়ারো জাবেদ নামের এক যুবকের রুমে থাকি-খাই। কক্সবাজারে পরিচয় হয়েছিল। ঢাকায় ঘরভাড়া, খাই খরচ কোন কিছু নিয়ে কোনো ধারণা নেই। আমি তাকে বলি, `এই মনে করেন আমাকে মাসে পনেরশ টাকা দিলে চলবে। ` তিনি সঙ্গে সঙ্গে রাজি---`ঠিক আছে, আমি আপনাকে পনেরশ টাকাই দেব। কিন্তু একসঙ্গে দেব না। মাসের এক তারিখে পাঁচশ, দশ তারিখে পাঁচশ এবং কুড়ি তারিখে পাঁচশ। ` যুক্তি হিসাবে বলা হয় একসঙ্গে টাকা দিলে আমি তা খরচ করে ফেলতে পারি। আমি সবকিছুতেই রাজি। আমার দরকার ঢাকায় একটা খুঁটি। কোথাও একটু চান্স পাওয়া।
মিনার মাহমুদ বললেন, `আপনি বসুন, আমি একটু রেডি হয়ে নেই। আপনাকে নিয়ে এক জায়গায় যাবো। ` তিনি তৈরি হয়ে আমাকে তার মোটর সাইকেলের পিছনে বসিয়ে রওয়ানা হলেন। বিচিন্তার পাঠকদের চেনা সেই লাল মোরগের মতো মোটর সাইকেল! পথেই নানা নির্দেশনা দিচ্ছিলেন: `এভাবে ঝুঁকে বসতে হয় না। এভাবে বসতে হয়। ` আদেশ পালন করি। ঠাওর করতে পারি, আমি আপাদমস্তক স্মার্ট একজনের পাল্লায় পড়েছি। আমি সে তুলনায় গেঁয়ো। ধানমণ্ডির পুরনো তিন নম্বর সড়কের একটি বাড়ির ভিতর ঢুকে যায় মোটর সাইকেল। এক ভদ্রমহিলার সামনে আমাকে বসিয়ে তিনি গল্প জুড়ে দেন। সেখানে আগে থেকে ছিলেন অভিনেতা আফজাল হোসেন। তারা তিনজনেই রাজ্যের কথা বলছিলেন। আমাকে কেউ কিছু শেয়ার বা জিজ্ঞেসও করেন না। আমি বসে বসে তখন শুধু ম্যাগাজিনে চোখ বোলাই। এই ভদ্র মহিলাই বিচিন্তার ফাইন্যান্সার। মিনার মাহমুদ তাকে ম্যাডাম ডাকতেন। আমরাও ডাকতাম ম্যাডাম। পরে শুনেছি আমাকে যে সেখানে নেয়া হয়েছিল সেটা ছিল আমার ইন্টারভ্যু। আমি ইন্টারভ্যুতে পাশ করেছি। সে আড্ডা থেকে বেরিয়ে মিনার মাহমুদ বলেন, `আপনি এখানে খেয়ে যান। ডাইনিং টেবিলে বসিয়ে হাতে একটা চিরকুট ধরিয়ে দিয়ে বলেন, আপনি খেয়ে আবার দিলু রোডে চলে যাবেন। এ কাগজটা আপনার ভাবীকে দিলে উনি আপনাকে দু’শ টাকা দেবেন। আপনার কিছু পকেট মানি দরকার। `
আবার দিলু রোডে গিয়ে কবিতা ভাবীর কাছ থেকে দু’শ টাকা নিয়ে ভালোই লাগে। সেটিই ঢাকার মিডিয়ায় আমার প্রথম রোজগার।
এরপর প্রতিদিন দিলু রোডে যাই আসি। কাজের কোনো খবর নেই। একদিন মিনার মাহমুদ জিজ্ঞেস করেন, বদরুল (আমার ডাক নাম) আপনি টাইপ জানেন? না বলতেই কিছু টাকা দিয়ে বলেন কোনো একটা টাইপ রাইটিং শেখার স্কুলে ভর্তি হয়ে যান। টাইপিংটা শিখে নিলে কাজে লাগবে। মগবাজারের গলিতে একটা টাইপিং স্কুলে ভর্তি হয়ে যাই। দু’দিন পর জিজ্ঞেস করেন, `টাইপ শিখতে আপনার কেমন লাগছে। ` বললাম, `ভালো না। ` মিনার মাহমুদ বললেন, `তাহলে কাল থেকে ওখানে যাবেন না। ` `কেন?`-- জিজ্ঞেস করলে বলেন, `যখন যা ভালো লাগবে না তা করবেন না। ` আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকি। ইনি মিনার মাহমুদ। প্রতিদিন দিলু রোডে আসার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো একটা হলের পত্রিকা পড়ার জায়গাটা ঘুরে আসি। একসঙ্গে অনেক কাগজ পড়া যায়। একদিন তেমন পত্রিকা পড়ার সময় একটা বিজ্ঞাপন দেখে চোখ ছানাবড়া হয়। বিচিন্তার বিজ্ঞাপন। সাংবাদিকতা করতে ইচ্ছুক একদল নতুন ছেলেমেয়ে চাওয়া হয়েছে। বিজ্ঞাপনটা দেখে মনটা খারাপও হয়। আমিই তো আছি, আর নতুন ছেলেমেয়ের দরকার কী? আসলে আমার তখন ভয়ও করেছে। অনেক লোকজন চলে এলে প্রতিযোগিতায় যদি না টিকতে পারি!
মিনার মাহমুদের সঙ্গে দেখা হতেই খুশিখুশি ভাব নিয়ে বলেন, `বদরুল, খুশির একটা খবর আছে। বিচিন্তার ডিক্লারেশন হয়ে গেছে। আমাদের আর নিউজ এজেন্সি করা লাগবে না। এখন আমরা পত্রিকাই করবো। তার দু’রুমের বাসার একটি রুমে করা হয় পত্রিকার অফিস। দুটো টেবিল আসে সেখানে। একটি তার একটি আমার। আর কয়েকটা চেয়ার। আমাকে দু’শ টাকা দিয়ে বলেন, এটি আপনার পুঁজি। লোকজন এলে চা খাওয়াবেন। `
যায়যায়দিন তখন বন্ধ। বিচিন্তার বিজ্ঞাপন দেখে এজেন্টরা হুমড়ি খেয়ে পড়েন। অফিসে এসে প্রতিযোগিতা করে জমা দিতে থাকেন অ্যাডভান্সের টাকা! প্রতিদিন আমার ছোট টেবিলটার ড্রয়ার টাকায় ভর্তি হয়ে যায়! আমি সেখানে রিসেপশনিস্ট, সার্কুলেশনস ম্যানেজার, ক্যাশিয়ার সবকিছু!
আরেকটা ঘটনা ঘটে, পত্রিকা সাংবাদিকতা সাধারণ চাকরির বিজ্ঞাপন মনে করে বস্তা বস্তা আবেদনপত্র আসতে থাকে। সঙ্গে নানান সার্টিফিকেটের সত্যায়িত কপি। এসব দেখে কিন্তু সাংবাদিক খোঁজার চেষ্টাও করা যায়নি। অফিসে যারা আসতেন তাদের বসিয়ে আমাকে ইন্টারভ্যু নিতে হতো। মিনার মাহমুদ শুধু আরেক টেবিলে বসে মুচকি মুচকি হাসতেন। বিজ্ঞাপন দেখে যারা অফিসে পরিচিত হতে আসেন, তাদের মধ্যে আমিনুর রশীদ, জিল্লুর রহমান, আনিস আলমগীর, দীপু হাসানসহ অনেকের কথা মনে পড়ে। আবিদ রহমান, আমান-উদ-দৌলা, আনোয়ার শাহাদাত, আশরাফ কায়সার এরা মিনার মাহমুদের সঙ্গে আগে থেকে পরিচিত ছিলেন। কিছুদিন পর আসা শুরু করেন সৈয়দ বোরহান কবীর, আসিফ নজরুল, শাহনেওয়াজ প্রমুখ।
আসিফ নজরুল তখনও নজরুল ইসলাম নামে বিভিন্ন পত্রিকায় লিখতেন। বিচিন্তায় তার জন্য আসিফ নজরুল নামটি ঠিক করেন মিনার মাহমুদই। ১৯৮৭’র ১০ জুন পত্রিকার প্রথম সংখ্যা বেরোয়। আমি সারাদিন অফিস সামাল দিই আর নিজের ব্যাগ খুঁজে নানা রিপোর্ট লিখি। এভাবে প্রথম সংখ্যায় আমার বারোটি লেখা ছাপা হয়। ফারহীম ভীনা, মুনিমা সুলতানা, পাপড়ি ওরফে কবিতা, সাবা নামের চারজন মেয়েও তখন আমাদের সঙ্গে কাজ করতে আসেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে লিখতেন পাপড়ি। শুরু থেকে আরেক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র মানিক রহমান। বাণিজ্যিক বিষয়াদি দেখতেন মানিক। আরও কিছু অনিবার্য চরিত্র ছিলেন আক্কাস মাহমুদ, চট্টগ্রামের শহীদুল ইসলাম বাচ্চু, এজাজ মাহমুদ, কামরুল হাসান বাদল।
অভিজ্ঞতার অভাবে প্রথম সংখ্যার পেস্টিং টেবিলে গিয়ে দেখা যায় বিরাট সমস্যা। ফটো কম্পোজের জায়গায় এত ম্যাটার পাঠানো হয়েছে, কিন্তু পেস্টিং’এর সময় দেখা গেল ৩২ পৃষ্টার পত্রিকার অনেক পাতাই খালি! তখন বিভিন্ন কাগজের বিজ্ঞাপন কেটে পজিটিভ করে পাতা ভরানো হয়। প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদ করেন উন্মাদের আহসান হাবীব। কিন্তু পত্রিকার আঙ্গিক মান ছিল খুব দুর্বল। প্রথম সংখ্যাটা আমরা কমলাপুর রেল স্টেশনসহ বিভিন্ন বাস টার্মিনালে নিয়ে গিয়ে ফ্রি বিলিও করি। লোকজনকে বলি, ভাই আমরা একটা পত্রিকা বের করেছি। ভালো লাগলে পরের সংখ্যা কিনে পড়বেন। প্রথম সংখ্যায় বঙ্গবন্ধুর খুনি ফারুকের একটা ইন্টারভ্যু ছিল। তাই এভাবে ফ্রি পত্রিকা বিলি করা নিয়ে সমালোচনাও হয়। একদল প্রচার করেন ফ্রিডম পার্টি একটা পত্রিকা বের করেছে! লোকজনকে ফ্রি দিচ্ছে! প্রথম সংখ্যার চাইতে বিচিন্তার পোস্টারটিই ছিল বেশি সাড়া জাগানো। স্ট্যাচু অব লিবার্টির চোখ বেঁধে দিয়ে পোস্টারে বলা হয়েছে, ‘আমাকে দেখতে দাও, আমাকে বলতে দাও’। দেশে তখন স্বৈরাচারী এরশাদের শাসন। এ পোস্টার আর মিনার মাহমুদের লেখা সৃষ্টিসুখের উল্লাসী বিজ্ঞাপনের ভাষা দেশের তরুণ প্রজন্মকে শুরু থেকেই টনিকের মতো টেনেছে। দ্বিতীয় সংখ্যা থেকে শিল্পী মাসুক হেলাল, চিত্রা সুলতানা যোগ দিলে বদলে যায় পত্রিকার আঙ্গিক । প্রতিটি সংখ্যাতেই লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে পত্রিকার সার্কুলেশন! বিচিন্তা সম্ভবত দেশের প্রথম প্রথাবিরোধী পত্রিকা। এর সম্পাদক মিনার মাহমুদ সেখানে সবচেয়ে বয়সী। কিন্তু তখনও তার বয়স তিরিশ হয়নি। সম্পাদক, আবিদ রহমান ছাড়া আর কারও পত্রিকায় কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিলো না। প্রেসক্লাবভিত্তিক সিনিয়র সাংবাদিকদের অনেকে শুরুর দিকে এ পত্রিকাকে গুরুত্ব দেন নি। তাচ্ছিল্যসহ তাদের কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেছেন, `পোলাপান শখ কইরা সংকলন বাইর করছে। কয়দিন পর বন্ধ হয়ে যাবে। ` কিন্তু বিচিন্তার সাফল্য ছিল ধারণাতীত।
বিচিন্তার সাফল্যের কারণ কী? সোজা উত্তর-- এর তারুণ্য। সময়ের প্রতিনিধিত্ব। মিনার মাহমুদের নেতৃ্ত্ব। একদল তরুণ সংবাদকর্মীর উদয়াস্ত ভালোবাসা। সংবাদকর্মী বলার কারণ বিচিন্তার প্রায় কর্মী রিপোর্ট লেখা থেকে শুরু করে পত্রিকার পেস্টিং-প্রিন্টিংসহ নানা কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এই কর্মীদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও অফিসের ভিতরে। এরশাদবিরোধী আন্দোলন যত তুঙ্গে উঠেছে। আন্দোলনের নেতারা গ্রেফতার এড়াতে আত্মগোপনে। গেরিলা কায়দায় তাদের ইন্টারভ্যু করে আসা, আন্দোলনের মিছিল থেকে এসে লেখা, এসব সেই সময়কে প্রতিনিধিত্ব করেছে। নূর হোসেন শহীদ হয়েছেন, তাকে গুলি করার পর যে কিশোর ধরে রিকশায় তুলে হাসপাতালে নিয়ে গেছে, সেই সুমনকে খুঁজে বের করে নূর হোসেনের শেষ কথাগুলো মানুষকে জানানো, জুরাইন গোরস্তানে তার কবর খুঁজে বের করা, এসব করেছে বিচিন্তা। আবার এরশাদ পলিটিক্যাল রিপোর্ট ছাপতে নিষেধ করেছে, আমরা পাবনার হেমায়েতপুর মানসিক হাসপাতালে চলে গিয়ে মানসিক রোগীদের পলিটিক্যাল ইন্টারভ্যু করেছি। সিলেটে সিমিটারবিরোধী তেল-গ্যাস রক্ষার আন্দোলনটিও বিচিন্তার সমর্থনে জোরালো হয়।
বিচিন্তার সাফল্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক ছিলেন সম্পাদক মিনার মাহমুদ, বিচিন্তা কর্মীদের বয়স-সাহস। খুব স্বপ্ন দেখতেন মিনার মাহমুদ। স্বপ্ন দেখাতে জানতেন। সম্পাদক হিসাবে কোনো বাড়তি অথবা উটকো খবরদারি তার মধ্যে ছিলো না। সবকিছু তিনি সবার সঙ্গে শেয়ার করতেন। সবার মতামতকে গুরুত্ব দিতেন। সম্পাদকের আলাদা রাজনৈতিক ফ্যাসিনেশন ছিলো না। একটাই দুর্বল জায়গা ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, শহীদজননী জাহানারা ইমাম। আমাদের বিচিন্তা পরিবারের সবার আম্মা। এরশাদের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ-বিএনপি দু’দলেরই কট্টর সমালোচনা করতো বিচিন্তা। এজন্য আওয়ামী লীগ-বিএনপি নেতারা এ পত্রিকাকে দেখতে পারতেন না। বামপন্থী দলগুলো বিশেষ করে তখনকার পাঁচদলীয় জোটের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল বিচিন্তা কর্মীদের। ওয়ার্কার্স পার্টির তখনকার তরুণ নেতা নুরুল ইসলাম তথা ছোটন ভাই’র সঙ্গে বিচিন্তা পরিবারের বন্ধুত্বও ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সেই বিচিন্তা নিষিদ্ধ, মিনার মাহমুদকে গ্রেফতারের মাধ্যমে তারুণ্যের আন্দোলনটিকেই হত্যা করেন আজকের সুবোধ-সুশীল, সংবাদপত্রপ্রেমী(!) মহাজোটনেতা পতিত স্বৈরাচারী এরশাদ।
দ্বিতীয়-তৃতীয় পর্যায়ের বিচিন্তা সাড়া জাগাতে পারলো না কেন? বিচিন্তার পুরনো টিমটি তখন নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিল। পরিবর্তিত সময় ধরে-বুঝে আমরা কাজ করতে পারি নি। ব্যক্তিগত জীবনে বিপর্যস্ত মিনার মাহমুদও চলে যান বিদেশে। আঠারো বছর পর দেশে এসে তিনি দেখেন ভিন্ন আরেক সময়। তার হাতে তৈরি কর্মীরা সব নানা জায়গায় প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু সে তুলনায় তিনি নিজের একটি স্বতন্ত্র-মর্যাদার জায়গা খুঁজে পাননি। অথবা কেউ তাকে দেয় নি। দাসত্ব কোনদিন তিনি পছন্দ করতেন না। সুইসাইডাল নোটেও তা লিখে গেছেন। স্বাধীনচেতা, আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন, স্বপ্নচারী মিনার মাহমুদ, নিজের স্বপ্ন হারিয়ে কারো করুণা নিয়ে বেঁচে থাকতে চাননি। স্বপ্ন হারিয়ে কত অসহায় হয়ে গেলে মিনার মাহমুদ লিখতে পারেন, আমার ব্যাংকে মাত্র চার হাজার টাকা! একদা তারুণ্যকে স্বপ্ন দেখানো মিনার মাহমুদ যে বাঁচতে পারলেন না, আত্মহননের মাধ্যমে আমাদের নীচতাকে চটেপাঘাত করে গেলেন, এর দায় কী আমাদের নিতে হবে না? শেখ হাসিনা-খালেদা জিয়া বা দেশের রাজনৈতিক দলগুলো তার মৃত্যুতে যে একটা শোক বিবৃতি পর্যন্ত দিলেন না! এদেশে সাগর-রুনিরা বিদেশ থেকে ফিরে খুন হয়ে যায়, আমান-উদ-দৌলার মতো আদর্শবান একজন সাংবাদিক বিদেশ থেকে ফিরে দেশে জনেজনে মিনতি করেও কোন জায়গা করতে না পেরে আবার পাড়ি জমান বিদেশে! মিনার মাহমুদের মতো একজন সাংবাদিক দেশে ফিরে দেশের কাছে যোগ্য একটি মর্যাদার চেয়ার-জীবিকার মতো একটি বেতনের ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হয়ে অভিমান করে আর বিদেশ চলে যাননি। দেশেই নিজে নিজে মরে গেলেন!
সুইসাইডাল নোট লিখে বাঁচিয়ে দিয়ে গেলেন শেখ হাসিনা আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে। তার জন্য আর কাউকে কিছু করতে হবে না। কিন্তুস মিনার মাহমুদের হত্যাকারী যে এই রাষ্ট্র আর সমাজই এতে কী কোনো সন্দেহ আছে ? যেখানে যোগ্য লোকের দাম-কদর নেই। এখানে কদর শুধু তেলবাজ-দলবাজ-ধান্ধাবাজ কিম্ভূতকিমাকারদের! এমন একটি সমাজে বাঁচতে চাননি তারুণ্যকে স্বপ্ন দেখানো একজন আধুনিক মানুষ মিনার মাহমুদ। স্বপ্ন হারিয়ে গেলে মানুষ বাঁচে না। জীবনঘাতী হয়ে বলে গেলেন এই অযোগ্যদের উল্লাসের নৃত্যের দেশ তার না। এমন অপমানের জীবনের চেয়ে মৃত্যু ভালো। পচাগলা সমাজের পাপতাপ ধারণ করে যীশুর মতো প্রাণ দিয়ে গেলেন মিনার মাহমুদ। তোমাকে ভুলবো না মিনার ভাই। তোমার প্রতিবাদী মৃত্যুকে স্যালুট। আমাদের অযোগ্যতা-ব্যর্থতাকে ক্ষমা করে দিও। এরপরও যদি যোগ্যদের কদরে এই রাষ্ট্র-সমাজব্যবস্থার হুঁশ হয়!
ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক
সম্পাদনা: মাহমুদ মেনন, হেড অব নিউজ;
জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর।