ঢাকা : সমাজের মৌলিক উপাদান মানুষ এবং মানুষের মূল পরিচয় উৎসারিত একজন ব্যক্তি মানুষের মনোজগতের ভেতর একটি একক অনুভবের মোড়কে ভাবনার সঞ্চালন। মানুষের সেই ভাবনা যখন বিশ্লেষিত হয়ে তার কাজের ভেতর মননশীল ছন্দে প্রকাশিত বা বিকশিত হয়ে সমাজে ছাপ রাখে সেটাই সংস্কৃতি।
একটু সরলভাবে বললে এভাবে বলা যায়, সংস্কৃতি মানুষের আত্মার খাদ্য। মানুষ তার জীবনবোধে যত বৈচিত্রময় হয়, বৈচিত্র পিয়াসী হয়, তার মাঝে ততই একটি সত্যিকারের সুস্থ্য ধারার সংস্কৃতি পাখা মেলে। মানুষের মাঝে সংস্কৃতির বৈচিত্রময়তা বহুমাত্রিক। জীবন সংগ্রাম, আচার অনুষ্ঠান, নৈতিকতা, সংগীত, শিক্ষা, জীবনবোধ এবং বিশ্ব মানচিত্রে নিজেকে দেখার বা মেলানোর প্রবণতা একটি একক ব্যক্তিসত্তায় সংস্কৃতির সঠিক বিকাশ জারিত করে। মানুষ হয়ে ওঠে মানবিক এবং সৃষ্টিশীল।
মানুষ যেহেতু প্রকৃতির সন্তান, তাই তার সংস্কৃতিময় মনের মাধুর্য মিশেলে নির্মিত সমাজের চিত্রে একটি প্রাকৃতিক রঙ আছে। এটা আবার এমনভাবেও প্রকাশ করা যায়- মানুষ নানাবিধ আধুনিক শিক্ষায় প্রশিক্ষিত হয়ে সুশৃঙ্খল সমাজে বাস করার আগে থেকেই আপন নিয়মে ক্রমবিন্যাসিত একটি প্রাকৃতিক শৃঙ্খলাময় সমাজ রচনা করেই অগ্রসর হয়েছে এবং ফলে এর মাঝে একটা প্রাকৃতিক ছন্দ আছে।
একটি সুশৃঙ্খল সমাজে রাষ্ট্রের কাঠামোয় আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মানুষ হিসেবে তার প্রকাশ ঘটায় এবং একই সাথে তার অন্তরে লালিত সংস্কৃতির আলোয় অন্য মানুষের অন্তরকে উজ্জীবিত করে সত্যের লড়াইয়ে।
ওপরের বলা কথাগুলোই যদি একটি মৌলিকত্ব হয়, তবে এটাতো একটি স্বাভাবিকতাও বটে যে, সংস্কৃতি সমাজকে প্রভাবিত করে। আর তাই যদি হবে, তবে ধরেই নিতে হয়, আমাদের সমাজ বিনির্মাণে সংস্কৃতির ভূমিকা আছে।
তবে এ নিয়ে আর আলোচনার বুদ্ধি প্রয়োগের দরকার কী ! কিন্তু আলোচনার প্রস্তাবিত প্রপঞ্চে একটি বাড়তি পরিভাষা যুক্ত রয়েছে - গণতন্ত্র বা সামগ্রিক রপরেখায় বলা হচ্ছে ‘গণতান্ত্রিক সমাজ’। এই পরিভাষাটি দেখা মাত্র খুব দ্রুতই একটি স্বাভাবিক প্রশ্ন উপস্থিত হয়ে পরে, এই বিষয়বস্তুর আলোচনার জটিলতা কী এখানেই ? কোনো কিছুর মাঝে সরলীকৃত কোনো উপাদান থাকলে তো আর সেটা নিয়ে আলোচনা ফাঁদবার প্রয়োজন দেখা দেয় না। তাহলে কী মানতেই হচ্ছে যে, এখানে একটা জট আছে এবং সে কারণেই এর ওপর আলোচনার আলোর প্রক্ষেপণ জরুরি।
দেখা যাচ্ছে সমাজটাকে ‘গণতান্ত্রিক সমাজ’ আখ্যা দিয়ে একটি মার্জিত অলংকার দেওয়া হয়েছে। এটা ধর্মীয় সমাজ নয়, সমাজতান্ত্রিক সমাজ নয়, কমিউনিষ্ট সমাজ না। এটা একটা গণতান্ত্রিক সমাজরূপ এবং সেই ধারার সমাজ বিনির্মাণের সম্ভাবনার স্বীকৃতি।
তাহলে আবারো প্রশ্ন চলে আসে আমরা কী তবে খাঁটি গণতন্ত্রকামী, গণতন্ত্রকেই একমাত্র রাষ্ট্রব্যবস্থার উপাদান বলে বিবেচনা করি নাগরিকের মৌলিক অধিকার বান্তবায়নের জন্যে? উত্তরটা সম্ভবত এ রকম, গণতন্ত্রকে একটি পরিভাষা বা এই বিধিকেই মেনে নিয়ে কথা বলাটা এখন সত্য বলেই প্রতিষ্ঠিত। ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পনেরো টুকরো হলে আমাদের দেশে লাল পতাকার মিছিলেও গণতন্ত্রের অভিঘাত লাগলো। লালপতাকা বহনকারীরাও এখন গণতন্ত্র নামক পরিভাষাটি লালের সাথে মিশেল দিয়ে দৃঢ়ভাবে উচ্চারণ করতে ভালোইবাসেন।
যদি তাই হয়ে থাকে সমাজরূপরেখার অলংকৃত পরিণতি, যদি রাষ্ট্রব্যবস্থায়, যদি সমাজ কাঠমোতে গণতন্ত্রই একটি সঠিক এবং একমাত্র খাঁটি উপাদান হয়ে থাকে; আর সেটাই যদি মানুষের জীবনযাপনের প্রশান্তময় শৃঙ্খলা নির্মাণে ভিত্তিভূমি হয়ে থাকে তবে প্রথমেই হাতের মুঠোয় পুরে রাখা গণতন্ত্রটিকে নিরীক্ষণ করতে হয় যে তার শরীরটা মজবুত তো! না কী ঢিলেঢালা, নড়বড়ে! এর উত্তর পাওয়া গেলেই বোঝা যাবে গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণে সংস্কৃতি কীভাবে বা কতখানি প্রভাব রাখছে।
যদি না রাখে বা রাখতে ব্যর্থ হয়, তবে পরের ধাপে ভাবনাব অবকাশ তৈরি হয় আমাদের চলমান সংস্কৃতিটি কী দুর্বল? যদি দুর্বল বলে বিবেচিত হয়, তবে প্রশ্ন চলে আসে, কেন দুর্বল? এটা কী সমাজের দর্শনগত দুর্বলতা? এটা কী শক্তিশালি সংস্কৃতি নির্মাণে সমাজের উপাদান হিসেবে মানুষের রুচিগত দুর্বলতা? অথবা যে সংস্কৃতি সমাজ গঠনে সহযোগিতা করলো, সেই সংস্কৃতি আর গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণে দৃপ্ত ভূমিকা রাখতে পারছে না, কেননা চলমান ধারায় বিকশিত গণতন্ত্র আদর্শের মাঝে ক্রিয়াশীল পুঁজিবাদী ব্যবস্থার দানবাকৃতি শক্তির বিকৃত ক্রিয়ায় সমাজের মানুষগুলোকে লোভী বানিয়ে সংস্কৃতি বিকাশের ধারা গিলে খাচ্ছে!
পুরোটার উত্তর এবং উত্তরণ খুঁজতে গেলে সনাতন প্রক্রিয়ায় গুটিকয় প্রশ্ন নির্মাণ জরুরি। আমাদের গণতন্ত্রের বিকাশ বা শক্তি কোন স্তরে অপেক্ষমান? আমাদের এই চলমান সমাজ মূল্যবোধের কোন স্তরে দাঁড়িয়ে রয়েছে? এই উত্তরগুলো নির্ণয়ের পর আমরা হয়তো দেখতে পাবো সংস্কৃতি এবং গণতান্ত্রিক সমাজ কাঠামো বিনির্মাণ এখন কী প্রক্রিয়ায় সচল এবং সফল।
বাংলাদেশের গণতন্ত্র নেহাতই শিশু এবং এখনো ভালো করে হাঁটতে শেখেনি। কেনো এমনটা হলো? জবাবটা পেতে প্রয়োজন পেছন ফেরার। একটি গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে পেতে আমাদের যে সংগ্রামটা শুরু পাকিস্তান আমলে, সেই সংগ্রামের নেতৃত্বের মানুষগুলো ছিলেন গণতন্ত্রমনা। কিন্তু সেই সমাজের ভেতর বেশীরভাগ মানুষের সংস্কৃতির মুক্ত আত্মাটা তখনো তৈরি হয়নি। ইতিহাস বলে, পাকিস্তান জন্মলাভের পর এই ভূখেণ্ডের ভেতর বুদ্ধিজীবীদের একাংশ সামরিক আমলাতন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদীদের যোগসাজসে এদেশের সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়াটিকে গভীর হতে দেয়নি, কেননা তারা কখনোই গণতন্ত্রের সেবক বা ধারক ছিলো না, ছিলো কেবল নিজেদের স্বার্থসংরক্ষক। আর এখনকার বাস্তবতা এই, মধ্যবিত্ত এবং কৃষক শ্রমিক জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা করে ৫২’র ভাষা আন্দোলনের সফলতার পথ ধরে মুক্তিযুদ্ধ এবং ভুখণ্ডের স্বাধীনতা অর্জিত হলেও রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে সেই শ্রেণীটিকে কখনোই ক্ষমতা থেকে দূরে রাখা যায়নি বা সরানো যায়নি। ফলে বাংলাদেশে একটি সঠিক ধারার সংস্কৃতির গতিপথ নির্ণিত হয়নি এবং একই সূত্রে গ্রথিত হয়ে এখানে একটি স্বাস্থ্যকর গণতান্ত্রিক ধারাও তৈরি হয়নি। বিষয়টিকে একটু বিস্তৃত করে বলি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা উত্তর যুদ্ধ ফেরত একদল মধ্যবিত্ত তরুণ যুদ্ধের অভিঘাতজাত নতুন চেতনাকে ধারণ করে দেশের কৃষক শ্রমিকের মতো তারাও প্রত্যাশা করতে শুরু করে এই মুক্তিযুদ্ধ আমাদের হাতে একটি পরিণত বিপ্লব উপহার দেবে যেখানে ভূমির সঠিক বণ্টন, সামন্তবাদী কাঠামোর পরিবর্তন হবে এবং দেশের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করবে জনগণ। কিন্তু রাষ্ট্রকাঠামোতে প্রোথিত হয়ে থাকা সুবিধাবাদী শ্রেণীটি তা হতে দেয়নি। তারাই মূলত সকল কিছুর নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে।
মধ্যবিত্তের এবং তরুণ স্বপ্নবাজদের প্রত্যাশা বন্দি রয়ে গেলো। অচলায়তনের বাইরে আর ওরা বেরিয়ে আসতে পারলো না। গ্রামীণ-সমাজ কাঠামোর ভেতর অর্থনৈতিক গতিশীলতার পরিবর্তনও এলো না। ফলে সদ্যস্বাধীন রাষ্ট্রটির মৌলিক পরাজয় নির্ধারিত হলো এবং ঘোরতর দুর্বিপাকে পড়লাম। আমরা দোমড়ানো হৃদয় দিয়ে প্রত্যক্ষ করলাম একটি কালো আগস্ট।
দেশ এবং জনতার আপনজন হতে চেয়ে অভিনয় করা তখনকার সামরিক উর্দিপরা জেনারেলরা সত্যিকারভাবেই গণতন্ত্রকে গলাটিপেই মারলো এবং বাংলাদেশের সমাজ কাটামোতে যেনো আপন আত্মার সৃষ্টিশীল আলোয় মানুষগুলো আর বেড়ে উঠতে না পারে, তার জন্যে তারা এদেশের সমাজ কাঠামোতে ক্রমান্বয়ে একদিকে ধর্মীয় গোঁড়ামী চর্চার আয়োজন করলো। উৎসাহ যোগালো ধর্মীয় কট্টোরবাদীতাকে এবং একইসাথে ব্যক্তি মুনাফার লোভটাকে নানান ধারায় উস্কে দিলো নিজেদেরকে ক্ষমতায় সুসংহত করে রাখতে।
একই সাথে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে মুছে ফেলে আমাদেরকে বাংলাদেশি বলে আমাদের কপালে মার্কা এঁকে আমাদের জাতি পরিচয়ের প্রকট সংকট সাজালো। ‘ধর্মনিরপেক্ষতাকে নাস্তিক্যবাদের সমান্তরাল বা পরিপূরক বা একই পরিভাষা আখ্যা দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা ভাবনার সমাজিক অগ্রসরমানতাকে সামরিক কায়দায় ভস্ম করলো। আমরা হারালাম একটি সঠিক রাজনৈতিক পরিকাঠামো।
এখানে এসেই আমরা আমাদের সংস্কৃতির সুরক্ষা, এর লালন পালন এবং আমাদের চিরায়ত সংস্কৃতির বর্ধিষ্ণু হবার পথটাতে দিকনির্দেশনার কম্পাসটা হারিয়ে ফেলতে শুরু করলাম। কেউ কেউ তো হারিয়েও ফললো। আর সে সময়ের শাসকরা তাদের বন্দুকের নলের মুখে আমাদের অনেকের বাঙালি হিসেবে আত্মগরিমাকে, আত্মার অহংকারকে ধমক দিতে কার্পণ্য করলো না। পরাজিত হলো অথবা বলা যায়, ক্ষয়ে যেতে শুরু করলো মুক্তিযুদ্ধের মূল ধ্বনি এবং শক্তিটা।
এটাতো ঠিক, পুরো বিশ্ব জুড়েই স্বীকৃত সঠিক নেতৃত্ব গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে এবং রাষ্ট্রব্যবস্থায় গণতন্ত্র যদি না কেবলমাত্র ব্যক্তিপুঁজির বিকাশকে সহায়তা করে, তবে সে গণতন্ত্র একটি সর্বজনীন সংস্কৃতি গড়ে দিতে সঠিক পথে সামজাকে সহায়তা করতে পারে। কেননা নেতৃত্বের উদারনৈতিক মানবিক ভাবনায় পরিচালিত গণতন্ত্র সত্যিকারের জীবনমুখি রূপলাভ করে। ফলে সে গণতন্ত্র রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় জনগণের অন্তরকে, তাদের ভাবনাকে, তাদের সৃষ্টিশীলতাকে সহায়তা করে প্রশ্রয় দেয় একটি লালিত্যময় সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্যে।
কিন্তু বাংলাদেশের কৈশোর পেরুনো গণতন্ত্র নানাবিধ নেতিবাচক উপাদানে বড়োমাপের একটা ঝুঁকির ভেতর রয়েছে। এই নেতিবাচক উপাদান রাষ্ট্রকে ক্রমধারায় বিপন্ন করে তুলছে। এই নেতিবাচক উপাদানের অন্যতম উপাদানগুলো খুব সরলভাবে বলা যায়, সাংস্কৃতিক উপাদান। তা হলো- রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা, উগ্রধর্মীয় ভাবনার আগ্রাসন, ধনীক শ্রেণির ভেতর বাঙালি হিসেবে নিজের মাঝে হিনমন্যতা কাটাতে ইংরেজি নির্ভরতা, আপন সংস্কৃতির মাধুর্য ছেটে হিন্দি সিরিয়ালে নিমজ্জিত হওয়ার মহামারী প্রবণতা।
একটু বিস্তৃত করে এভাবে বলা যায়, এই আবহটা রাষ্ট্র এবং তার নাগরিকদের সংস্কৃতিকে সুরক্ষা দিতে এবং একই সাথে এই বিকাশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে প্রবল বাধা। ১৯৯০ পরবর্তী গণতন্ত্র এখনো একটি কৃত্রিম জলাধারে পরিপূর্ণভাবে বেড়ে ওঠার জন্যে সাঁতার কাটছে। কিন্তু এখানে পুঁজির বিনিয়োগে মুনাফর দাপট ভয়াবহ, আবার উঠতি ধনীক শ্রেণির অসৎ পথে অর্জিত অর্থের শ্রেণিস্বার্থ রক্ষার আয়োজন নিরন্তর জন্ম দিচ্ছে একটি উৎকট নেংটোমার্কা সংস্কৃতি।
এই আজব সংস্কৃতিতে কেউ কেউ বাংলা ভাষার ভেতর ইংরেজি শব্দের জগাখিচুড়ি অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে বহুজাতিক কোম্পানিতে উচ্চ বেতনে চাকুরে হবার আশায় এক উদ্ভট এবং বড়ই নিন্দনীয় আচার আচরণ অনুসরণ করছে।
এর সাথে তো রয়েছেই আপন প্রপিতামহের অনুসরণ করা ধার্মীকতার নিয়ম কানুন ছুঁড়ে ফেলে তালেবানীয় বা লাদেনীয় উগ্রধর্মীয় অনুশাসনের মত এবং পথের অনুসারীর সংখ্যা বৃদ্ধি। মুসলমান হয়ে মুসলমানদের বোমা ফাটিয়ে হত্যা করার চর্চা। এটা এমন যে, ধর্ম পালনে তাদের এই উগ্রধারার মতবাদ প্রতিষ্ঠা প্রক্রিয়ার আগে তাদের পিতামাতা, পূর্বপুরুষেরা যেনো ধর্মের সঠিক অনুসারি ছিলেন না! তারা যেনো অধার্মিক ছিলেন!
এই যে বিপুল পরিমান মুনফালাভের স্বার্থপর কাজ, আল্লাহর নৈকট্যলাভের অধর্মীয় অযৌক্তিক ভাবনা, ভিন্ন ভাষার শব্দ নিজের ভাষায় টেনে এনে আপন ভাষার কদর্য ব্যবহার আমাদেরকে একটি জাতি হিসেবে শক্তিশালী হতে দিচ্ছে না। এই সকল নেতিবাচক মনোজাগতিক ভাবনা এদেশের সমাজ কাঠামোতে ক্ষতি ছড়াচ্ছে, এই সকল কালো সংস্কৃতির উপাদান এ দেশের আবহমান সংস্কৃতির বুকে খাঁমচি মারছে।
বাংলাদেশের চলমান গণতন্ত্রে একদিকে যদিও অদেশজ এবং সাম্প্রদায়িক চর্চাকে প্রত্যাখান করে অসাম্প্রদায়িকতাকে রাষ্ট্রীয় নীতিমালায় অন্যতম অংশরূপে গ্রহণ করা হয়েছে, তবুও ওইসব নেতিবাচক সাংস্কৃতিক উপাদান এই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোর ক্ষতি করছে।
ক্ষতি হচ্ছে কিভাবে? এই প্রক্রিয়ায় আমরা অন্ধকারের দিকে হাঁটছি। এটাকে অন্ধকার হিসেবে এ কারণেই চিহ্নিত করা, উল্লিখিত অসঙ্গত ধারা আমাদের সমাজের ভেতর নিজেদেরকে সুসংহত করার চিরায়ত উপাদানগুলোর সাথে বিরোধিতার সৃষ্টি করছে। ফলে গণতন্ত্র ভঙ্গুর হয়ে পড়ছে।
বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে, আমাদের গণতন্ত্রকে শক্তিশালিভাবে গড়ে তুলে এগিয়ে নিতে গেলে গণতন্ত্রের বিপক্ষে ওই সব অপ-উপাদান বা অপক্রিয়াকে হটানোর কাজটা জরুরি। আর সেটা করতে গেল একটা সৃজনশীল লড়াই দরকার। প্রয়োজন সুগ্রন্থিতভাবে আমাদের মুক্তচিন্তা, অর্থাৎ বাংলাদেশের মানুষের জাতিপরিচয়ের আবহমান সংস্কৃতির গৌরবটাকে মানুষের ভেতর ছড়িয়ে দেওয়া। এই কর্মযজ্ঞটির মাধ্যমে গণতন্ত্রের বিকাশ ও তার সুরক্ষায় তরুণ প্রজন্মকে মানবিক এবং উদারনৈতিক হতে শেখানো।
এই পর্যায়ে আমি আবারো সংস্কৃতি পরিভাষাটিকে এভাবে বিবৃত করতে চাই :
‘সংস্কৃতি হলো এমন একটি ধ্রুপদী বিন্যাস, যেখানে সমাজের সকল সদস্য আপন বিশ্বাস, মূল্যবোধ, রীতি, প্রথা, আচার আচরণ এবং নান্দনিকতাকে সাথে করে নিয়ে হাঁটে এবং একে অপরের সাথে অনুভবগুলো ভাগ করে নেয় তাদের একটি আপন জগত তৈরি করে পারস্পরিকভাবে সম্পর্কের নিগূঢ়তার আকাঙ্খায় এবং এই অর্জিত সংস্কৃতি তারা প্রতিদিনের ব্যাবহারিক কার্যক্রমের প্রক্রিয়ায় পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দেয় এবং তাদেরকে সেই আবহে গড়ে তোলে। ’
এ কারণেই আমাদের প্রয়োজন সংস্কৃতির মূল জায়গাটাতে স্থির হওয়া। মৌলিক ভিত্তিটাকে ধরে রাখা, সুসংহত করা। তা করতে গেলে প্রয়োজন মনোজাগতিক ভাবনার পরিবর্তন। কেননা, সংস্কৃতি হলো মানুষের সৃষ্টি করা একগুচ্ছ ভাবনা, মূল্যবোধ।
আশাবাদের কথা এদেশে যারা সংস্কৃতির সুস্থ ধারাকে এবং এর বিকাশটাকে এগিয়ে নিতে চান, তারাও ক্রমান্বয়ে আবার সংগ্রামী হচ্ছেন ঠিক যেমন নাকি আমাদের দেশের শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক এবং বুদ্ধিজীবিরা সুসংহত হয়ে বাংলার সংস্কৃতি রক্ষায় আন্দোলন করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি লগ্নে এবং মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে। আশার কথা এই সংগ্রামের সাথে ক্রমান্বয়ে যুক্ত হচ্ছে সৃষ্টিশীল তরুণ প্রজন্ম। এরাই এদেশে সুস্থ্য সংস্কৃতির বিকাশকে লালন করে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সমাজকে শক্তিশালী করবে।
আমার কথাগুলোর উপসংহার কবিগুরুর উচ্চারিত বিশ্বাস দিয়েই টানতে চাই। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বাস করতেন, ‘আমরা মৃত্যুকে জিতিব। ... মনুষ্যের অভ্যন্তরে এক সেনাপতি আছে, সে দৃঢ় বিশ্বাসে যুদ্ধ করিতেছে। ... অনেক মরিয়া তবে বাঁচিবার উপায় বাহির হইবে। ’ (এ বছর রাজশাহী সাংস্কৃতিক উৎসবের সেমিনারের মূল প্রবন্ধ)
লেখক : কবি, কথা সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
ইমেইল: kobimujtoba.murshed@gmail.com
সম্পাদনা: মারিয়া সালাম ও আহমেদ জুয়েল, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর